বিরোধীদলীয় মহাসমাবেশ-স্বস্তির পরিবেশে আলোচনায় বসুন
বিরোধীদলীয় জোটের 'চলো চলো ঢাকা চলো' কর্মসূচি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে যতখানি উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছিল, তা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর যেন ততখানিই স্বস্তি ফিরে এসেছে। নানা শঙ্কার মধ্যেও এমনটি প্রত্যাশাই করেছিল রাজনীতি ও রাজনীতির বাইরের অঙ্গনের প্রায় সব মানুষ।
বস্তুত মহাসমাবেশটি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হলেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল দেশজুড়ে এবং এর দায় ক্ষমতাসীনদেরই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে ঢাকাকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল, তার বিরূপ প্রভাব কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থায় পড়েনি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নাগরিক অধিকার। বিরোধীদলীয় কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখতে গিয়ে প্রকারান্তরে নাগরিক স্বাধীনতাই খর্ব করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে সরকার পক্ষ যতই উদ্বেগের কথা বলুক, তাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির ন্যায্যতা প্রমাণ হয় না। মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর ওপর পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের অ্যাকশন সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাবই স্পষ্ট করেছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণকারী দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির জনভিত্তি কি এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে? কেউ কেউ ঠাট্টা করে মহাসমাবেশের দিনকে যে 'সরকারি হরতাল' বলে আখ্যা দিয়েছে, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নাশকতার যে অভিযোগ করে এসেছে, তাও কেউ বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না। বিশ্বাসযোগ্যতার পাশাপাশি সরকার সাধারণ নাগরিকের সমর্থনও হারিয়েছে। রাজনীতির মাঠে মানুষ সরকারের কাছ থেকেই সহিষ্ণুতা প্রত্যাশা করে। বড় কথা, এত বাধাবিঘ্ন দিয়েও মহাসমাবেশের আকার ছোট রাখা যায়নি। সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি সরকারের নৈতিক পরাজয়ের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভাষণ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারে যে বিঘ্ন ঘটেছে, তার দায়ও সরকার এড়াতে পারে না। এতদিন জোর গলায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও এসব অঘটনের মধ্য দিয়ে কার্যত বিপরীত বার্তাই দেওয়া হচ্ছে। সমাবেশকে ঘিরে সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপের মতো এ ক্ষেত্রেও প্রজ্ঞার অভাব দেখা গেছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে এভাবে তথ্যপ্রবাহ রোধ করার চেষ্টা বোকার স্বর্গে বসবাস করা ছাড়া আর কিছু নয়। নয়াপল্টনের ওই মহাসমাবেশের খুঁটিনাটি এবং সেখানে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভাষণ কি কারও অজানা রয়েছে? ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তার দল কী কী করবে_ এই বক্তব্যও বিবেচক নাগরিকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিরোধী দল ২৯ মার্চ যে হরতালের ডাক দিয়েছে তাও অতীতের মতো সমালোচিত হচ্ছে না। এ ধরনের কর্মসূচির ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতিবাচক অবস্থান থাকলেও মহাসমাবেশ ঘিরে সরকারের বাড়াবাড়ি তা টলিয়ে দিয়েছে। আমরা চাই, বিরোধী দল সংসদে গিয়েও কথা বলুক। সরকারের ব্যর্থতা, ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরুক। তাতে করে বিরোধী দলের দায়িত্বশীলতাই কেবল প্রমাণ হবে না, ভোটের বাজারেও পাল্লা ভারী হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, এই ঘটনা থেকে সরকারও শিক্ষা নেবে। দমন-পীড়ন চালিয়ে যে বিরোধী আন্দোলন দমন করা যায় না, ছয় দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের চেয়ে সেটা আর কে বেশি বুঝবে? নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি নিয়েও সরকারকে বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। এই প্রশ্নে বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি জোটের শরিকদের মনোভাবও আওয়ামী লীগকে আমলে নিতে হবে। আমরা আশা করি, সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষই শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে। দুই পক্ষের ঐকমত্য ছাড়া গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা কঠিন।
No comments