দিল্লির চিঠি-পাচার হওয়া অর্থ কার? by কুলদীপ নায়ার
দক্ষিণ এশিয়ায় এমন কোনো শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা কিংবা শীর্ষ রাজনীতিক পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকার অভিযোগ নেই। পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কায় এ ব্যাপারে কাউকে প্রতিবাদে সরব হতে দেখা যায় না। তবে ভারতের অবস্থা কিছুটা ভিন্ন।
বিদেশে সঞ্চিত কালোটাকা ফিরিয়ে আনতে মনমোহন সিং সরকারের ওপর তীব্র চাপ। কালোটাকা ফিরিয়ে আনার দাবি দুর্নীতি নির্মূল আন্দোলনেরই অংশ হয়ে গেছে।
মনমোহন সরকার কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে বরং কালোটাকার আদ্যন্ত যেন সামনে না আসতে পারে, সেই চেষ্টারত বলে মনে হয়। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘বিদেশি ব্যাংকে কোনো ভারতীয় এবং অন্য কোনো বৈধ সত্তা হিসাবের বাইরে অর্থ জমা রাখলে সে বিষয়টি নাগরিকের কল্যাণে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ তাই কেন সরকার এ কথার ব্যাখ্যা চাইছে, সেটা বোধগম্য।
দুর্নীতির ব্যাপারে গড়িমসির কারণে সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তিরস্কারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিছুদিন আগে হাসান আলী ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মামলায় সরকারের তদন্ত-প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট। সতর্ক করে বলেন, সুইজারল্যান্ডে লুকিয়ে রাখা অর্থ যে কেবল কর ফাঁকি থেকে আসা, এমনটা যেন সরকার না ভাবে। এটা অস্ত্র চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাস বা অন্য কোনো অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে পাচার করা অর্থও হতে পারে। কর ফাঁকিদাতাদের নাম জানার জন্য ভারত সরকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে এখন যেভাবে দ্বিগুণ করচুক্তি সম্পাদন করছে, তার কোনো যৌক্তিকতা এখন দেখায়নি।
সুইস ব্যাংকে ভারতীয় কালোটাকার পরিমাণ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। সুইস ব্যাংকিং অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার পরিমাণ এক হাজার ৪৫৬ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ এত বিপুল যে বাদবাকি সব দেশের আমানত একত্র করলেও এর নাগাল পায় না। এই পরিমাণ অর্থ ভারতের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১৩ গুণ। এই অর্থ দিয়ে ভারতে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষের প্রত্যেককে এক লাখ রুপি করে দেওয়া যায়। বিদেশি অ্যাকাউন্টের অর্থ কর ফাঁকি অথবা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পাওয়া ঘুষ থেকে আসা।
এই অর্থ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার পর যে বিপুল অর্থ রয়ে যাবে, তা আমাদের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১২ গুণ। এই উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগ করা হলে যে মুনাফা পাওয়া যাবে, তা কেন্দ্রীয় সরকারের বার্ষিক বাজেটের থেকেও বেশি হবে। সুতরাং, সব ধরনের কর তুলে নিলেও সরকারকে বিপদে পড়তে হবে না। এ হিসাব ২০০৬ সালের সুইস ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া উপাত্তভিত্তিক। তারপর নিশ্চয়ই আরও অনেক অর্থ জমা হয়েছে।
এবারের তদন্তগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট আস্থা না দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সাবেক দুই বিচারপতির নেতৃত্বে বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করেছে কালোটাকা-সংশ্লিষ্ট সব মামলার তদন্ত করার জন্য। সুপ্রিম কোর্ট নিজেই তদন্তের গতির ওপর নজর রাখছেন। রায় ঘোষণাকালে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল: রাজনীতিক, আমলা এবং ব্যবসায়ীরা তহবিল বাইরে চালান করেন। তারপর বৈদেশিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পথ মাড়িয়ে সেই অর্থ দেশের ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
এই পর্যবেক্ষণ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সরকারের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ছে কি না, জানি না। বিদেশে পাচার করা কালোটাকার ব্যাপারে সরকার তো তেমন তৎপরতা দেখায়নি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার কতকগুলো নাম বেরিয়ে আসুক, তা চায় না। কেননা নামগুলো তাদের জন্য অস্বস্তিকর হবে।
এখন সরকার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেছে। কিছুদিন আগে দ্বিগুণ করচুক্তির আওতায় জার্মানির কাছ থেকে ২৬ জনের নাম পাওয়া গিয়েছিল। বার্লিনের হাতে ছিল কয়েক শ সুবিধাভোগীর নামের তালিকা। জার্মানি তাদের নাম ভারতের জনগণের কাছে প্রকাশ করতে দিয়েছিল। কিন্তু নয়াদিল্লি তা করতে পারেনি। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি কেন বলছেন সুবিধাভোগীদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। নাম না প্রকাশ করার কোনো বাধ্যবাধকতা যদি থেকে থাকে, তবে সেটা আর কারও নয়, নয়াদিল্লির নিজেরই। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের যুক্তি খারিজ করে দিয়েছেন। আর সরকারকে বলেছেন নামগুলো প্রকাশ করে দিতে। তার পরও সরকার তা করতে রাজি নয়।
ভাগ্য ভালো, কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সোনিয়াতনয় রাহুল গান্ধী বলেছেন, বিদেশে সঞ্চিত অর্থের মালিক জনগণ। আর সেই অর্থ অবশ্যই ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে। গোপনীয়তা আর হাত করে ফেলার কালো ছায়ার ভেতর রাহুলের এই কথা আশার আলো। তিনি বলেছেন, তাঁর পরিবার কোনো বিষয় হাতে নিলে তার যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যায়। এবার তিনি প্রমাণ দিন। ভারতবাসী ফল দেখতে চায়।
বিজেপি এবং তার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সভুক্ত মিত্ররা বলেছে, তাদের কোনো অর্থ বিদেশে নেই। কংগ্রেস ও তার মিত্রদের ওপর এ কথাটি চাপ হিসেবে কাজ করা উচিত। কিছু কিছু মিত্র হয়তো মনমোহন সরকারের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করবে। ২৬ জনের নাম প্রকাশ না করা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। আর তখনই ঘটবে সংকটের সূচনা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
কুলদীপ নায়ার: প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।
মনমোহন সরকার কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে বরং কালোটাকার আদ্যন্ত যেন সামনে না আসতে পারে, সেই চেষ্টারত বলে মনে হয়। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘বিদেশি ব্যাংকে কোনো ভারতীয় এবং অন্য কোনো বৈধ সত্তা হিসাবের বাইরে অর্থ জমা রাখলে সে বিষয়টি নাগরিকের কল্যাণে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ তাই কেন সরকার এ কথার ব্যাখ্যা চাইছে, সেটা বোধগম্য।
দুর্নীতির ব্যাপারে গড়িমসির কারণে সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তিরস্কারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিছুদিন আগে হাসান আলী ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মামলায় সরকারের তদন্ত-প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট। সতর্ক করে বলেন, সুইজারল্যান্ডে লুকিয়ে রাখা অর্থ যে কেবল কর ফাঁকি থেকে আসা, এমনটা যেন সরকার না ভাবে। এটা অস্ত্র চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাস বা অন্য কোনো অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে পাচার করা অর্থও হতে পারে। কর ফাঁকিদাতাদের নাম জানার জন্য ভারত সরকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে এখন যেভাবে দ্বিগুণ করচুক্তি সম্পাদন করছে, তার কোনো যৌক্তিকতা এখন দেখায়নি।
সুইস ব্যাংকে ভারতীয় কালোটাকার পরিমাণ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। সুইস ব্যাংকিং অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার পরিমাণ এক হাজার ৪৫৬ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ এত বিপুল যে বাদবাকি সব দেশের আমানত একত্র করলেও এর নাগাল পায় না। এই পরিমাণ অর্থ ভারতের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১৩ গুণ। এই অর্থ দিয়ে ভারতে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষের প্রত্যেককে এক লাখ রুপি করে দেওয়া যায়। বিদেশি অ্যাকাউন্টের অর্থ কর ফাঁকি অথবা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পাওয়া ঘুষ থেকে আসা।
এই অর্থ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার পর যে বিপুল অর্থ রয়ে যাবে, তা আমাদের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ১২ গুণ। এই উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগ করা হলে যে মুনাফা পাওয়া যাবে, তা কেন্দ্রীয় সরকারের বার্ষিক বাজেটের থেকেও বেশি হবে। সুতরাং, সব ধরনের কর তুলে নিলেও সরকারকে বিপদে পড়তে হবে না। এ হিসাব ২০০৬ সালের সুইস ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া উপাত্তভিত্তিক। তারপর নিশ্চয়ই আরও অনেক অর্থ জমা হয়েছে।
এবারের তদন্তগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট আস্থা না দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সাবেক দুই বিচারপতির নেতৃত্বে বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করেছে কালোটাকা-সংশ্লিষ্ট সব মামলার তদন্ত করার জন্য। সুপ্রিম কোর্ট নিজেই তদন্তের গতির ওপর নজর রাখছেন। রায় ঘোষণাকালে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল: রাজনীতিক, আমলা এবং ব্যবসায়ীরা তহবিল বাইরে চালান করেন। তারপর বৈদেশিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পথ মাড়িয়ে সেই অর্থ দেশের ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
এই পর্যবেক্ষণ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সরকারের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ছে কি না, জানি না। বিদেশে পাচার করা কালোটাকার ব্যাপারে সরকার তো তেমন তৎপরতা দেখায়নি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার কতকগুলো নাম বেরিয়ে আসুক, তা চায় না। কেননা নামগুলো তাদের জন্য অস্বস্তিকর হবে।
এখন সরকার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেছে। কিছুদিন আগে দ্বিগুণ করচুক্তির আওতায় জার্মানির কাছ থেকে ২৬ জনের নাম পাওয়া গিয়েছিল। বার্লিনের হাতে ছিল কয়েক শ সুবিধাভোগীর নামের তালিকা। জার্মানি তাদের নাম ভারতের জনগণের কাছে প্রকাশ করতে দিয়েছিল। কিন্তু নয়াদিল্লি তা করতে পারেনি। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি কেন বলছেন সুবিধাভোগীদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। নাম না প্রকাশ করার কোনো বাধ্যবাধকতা যদি থেকে থাকে, তবে সেটা আর কারও নয়, নয়াদিল্লির নিজেরই। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের যুক্তি খারিজ করে দিয়েছেন। আর সরকারকে বলেছেন নামগুলো প্রকাশ করে দিতে। তার পরও সরকার তা করতে রাজি নয়।
ভাগ্য ভালো, কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সোনিয়াতনয় রাহুল গান্ধী বলেছেন, বিদেশে সঞ্চিত অর্থের মালিক জনগণ। আর সেই অর্থ অবশ্যই ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে। গোপনীয়তা আর হাত করে ফেলার কালো ছায়ার ভেতর রাহুলের এই কথা আশার আলো। তিনি বলেছেন, তাঁর পরিবার কোনো বিষয় হাতে নিলে তার যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যায়। এবার তিনি প্রমাণ দিন। ভারতবাসী ফল দেখতে চায়।
বিজেপি এবং তার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সভুক্ত মিত্ররা বলেছে, তাদের কোনো অর্থ বিদেশে নেই। কংগ্রেস ও তার মিত্রদের ওপর এ কথাটি চাপ হিসেবে কাজ করা উচিত। কিছু কিছু মিত্র হয়তো মনমোহন সরকারের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করবে। ২৬ জনের নাম প্রকাশ না করা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। আর তখনই ঘটবে সংকটের সূচনা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।
কুলদীপ নায়ার: প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments