বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৪০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. তবারক উল্লাহ, বীর প্রতীক রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত। মুক্তিযোদ্ধা অনেকে শহীদ ও আহত। মো. তবারক উল্লাহ দমে গেলেন না।
হাতেগোনা কয়েকজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে বীর বিক্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন। একসময় তিনি একা হয়ে পড়লেন। তার পরেও বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে একাই পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে আপ্রাণ যুদ্ধ করতে থাকেন; কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাওয়ে পড়ে গেলেন। এ ঘটনা বালিয়াডাঙ্গায়, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
বালিয়াডাঙ্গা সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার অন্তর্গত। এর পশ্চিমে ভারত সীমান্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মুক্তিবাহিনীর একটি দল (কোম্পানি) ভারত থেকে এসে বালিয়াডাঙ্গায় শিবির স্থাপন করে। এই দলের সহ-দলনেতা ছিলেন মো. তবারক উল্লাহ। তাঁরা বালিয়াডাঙ্গায় অবস্থান করে আশপাশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালান।
বালিয়াডাঙ্গার অদূরে হঠাৎগঞ্জে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারির সহায়তা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বালিয়াডাঙ্গার অবস্থানে পাল্টা আক্রমণ করে। মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ ও মো. তবারক উল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ওই এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করার জন্য তারা বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ধরে রাখেন।
১৮ সেপ্টেম্বর মো. তবারক উল্লাহর অধিনায়ক আহত হলে সাময়িক সময়ের জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। যুদ্ধ চলতে থাকে। পরে অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন মাহাবুব উদ্দীন আহমেদ (বীর বিক্রম)। তিনিও যুদ্ধে আহত হন। দুজন অধিনায়ক আহত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁদের ফায়ার পাওয়ার কিছুটা কমে যায়। এ সুযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।
মো. তবারক উল্লাহ সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। প্রায় ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে শহীদ হন। অনেকে আহত হন। আহতদের বেশির ভাগ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। একপর্যায়ে তবারক উল্লাহ একা হয়ে যান। তখন তিনি একাই যুদ্ধ করছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁর অজান্তে তাঁকে ঘিরে ফেলে। পরে আহত অবস্থায় তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে। আটক তবারক উল্লাহকে পাকিস্তানিরা ব্যাপক নির্যাতন করার পর জেলে পাঠায়। ১৬ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান।
মো. তবারক উল্লাহ চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন যশোর ইপিআর সেক্টরের অধীন কালীগঞ্জে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তিনি একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে ৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. তবারক উল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭০।
মো. তবারকউল্লাহ স্বাধীনতার পর সুবেদার মেজর হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। ২০০৪ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার এখলাসপুর গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বাস করতেন ঢাকার ডেমরার অন্তর্গত শেখদী পূর্বপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম মো. বসরত আলী মাস্টার। মা রাবেয়া বেগম। স্ত্রী আলফাতুন নেছা। তাঁর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: মো. মিজানুর রহমান (তবারক উল্লাহ বীর প্রতীকের ছেলে) এবং মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টর, বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ, কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
tৎৎashed@gmail.com
বালিয়াডাঙ্গা সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার অন্তর্গত। এর পশ্চিমে ভারত সীমান্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মুক্তিবাহিনীর একটি দল (কোম্পানি) ভারত থেকে এসে বালিয়াডাঙ্গায় শিবির স্থাপন করে। এই দলের সহ-দলনেতা ছিলেন মো. তবারক উল্লাহ। তাঁরা বালিয়াডাঙ্গায় অবস্থান করে আশপাশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালান।
বালিয়াডাঙ্গার অদূরে হঠাৎগঞ্জে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর্টিলারির সহায়তা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বালিয়াডাঙ্গার অবস্থানে পাল্টা আক্রমণ করে। মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ ও মো. তবারক উল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ওই এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করার জন্য তারা বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ধরে রাখেন।
১৮ সেপ্টেম্বর মো. তবারক উল্লাহর অধিনায়ক আহত হলে সাময়িক সময়ের জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। যুদ্ধ চলতে থাকে। পরে অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন মাহাবুব উদ্দীন আহমেদ (বীর বিক্রম)। তিনিও যুদ্ধে আহত হন। দুজন অধিনায়ক আহত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁদের ফায়ার পাওয়ার কিছুটা কমে যায়। এ সুযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।
মো. তবারক উল্লাহ সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। প্রায় ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে শহীদ হন। অনেকে আহত হন। আহতদের বেশির ভাগ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। একপর্যায়ে তবারক উল্লাহ একা হয়ে যান। তখন তিনি একাই যুদ্ধ করছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁর অজান্তে তাঁকে ঘিরে ফেলে। পরে আহত অবস্থায় তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে। আটক তবারক উল্লাহকে পাকিস্তানিরা ব্যাপক নির্যাতন করার পর জেলে পাঠায়। ১৬ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান।
মো. তবারক উল্লাহ চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন যশোর ইপিআর সেক্টরের অধীন কালীগঞ্জে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তিনি একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে ৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. তবারক উল্লাহকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭০।
মো. তবারকউল্লাহ স্বাধীনতার পর সুবেদার মেজর হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন। ২০০৪ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার এখলাসপুর গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বাস করতেন ঢাকার ডেমরার অন্তর্গত শেখদী পূর্বপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম মো. বসরত আলী মাস্টার। মা রাবেয়া বেগম। স্ত্রী আলফাতুন নেছা। তাঁর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: মো. মিজানুর রহমান (তবারক উল্লাহ বীর প্রতীকের ছেলে) এবং মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টর, বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ, কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
tৎৎashed@gmail.com
No comments