বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই জরুরি by ড. তুলসী কুমার দাস
বাংলাদেশ পরিবেশ পরিষদ (বাপা), বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন) ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) যৌথ উদ্যোগে গত ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি তিন দিনব্যাপী 'আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও সিলেটের পরিবেশ' শীর্ষক প্রথম কনভেনশন অনুষ্ঠিত হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কনভেনশনে যোগ দিতে দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন।
আরো এসেছিলেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ব্যাপকসংখ্যক আদিবাসী জনতা। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরাও এই কনভেনশনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। কনভেশন শুরুর আগের দিন ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয় এবং কনভেশন নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ছাত্রদের হলগুলোয় ব্যাপক গোলযোগ হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক ছাত্র তাৎক্ষণিক এবং পরের দিন ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। এতদসত্ত্বেও সুষ্ঠুভাবে এবং আনন্দমুখর পরিবেশে পরের দিন ১২ জানুয়ারি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের নেতৃত্বে কনভেনশন উপলক্ষে এক বিশাল আনন্দ শোভাযাত্রা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে এসে জড়ো হয়। মুক্তমঞ্চে সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান 'আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও সিলেটের পরিবেশ' শীর্ষক প্রথম কনভেনশনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
এই কনভেনশনে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ অংশ নেন। একাডেমিক, শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনীতিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী, ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা কনভেনশনে উপস্থিত হয়ে আদিবাসীদের সার্বিক অবস্থা এবং পরিবেশ নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন।
কনভেনশনটিতে সব আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগণের নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত এবং তাদের সঙ্গে পরিবেশের যোগসূত্র-বিষয়ক। প্রায় সব বক্তাই বাংলাদেশে আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় হতাশ ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। আমরা জানি, আমাদের আদিবাসীরা নানাভাবে বঞ্চিত এবং ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। অত্যাচার, নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিতাড়ন, ভূমিদখল ইত্যাদি নানাবিধ নিপীড়ন তাদের নিত্যসঙ্গী। রাষ্ট্রও তাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী জনগণ আমাদের এই মাতৃভূমিতে বড়ই অসহায়! তারা যেমন নিজ দেশে পরবাসী! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক সংখ্যালঘু বা ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘুরা কখনো বৈষম্য বা বঞ্চনার শিকার হয় না। সব ধরনের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের জীবনাচরণকে সসম্মানে প্রতিপালন করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য। সংখ্যালঘুরা যেন কোনোমতেই নিজেদের অপাক্তেয় ও অগ্রহণীয় মনে না করে, সেদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রের আচরণে যদি সংখ্যালঘুরা কষ্ট পায়, তাদের যদি মনোবেদনা সৃষ্টি হয় কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণ বা সরকারের মনোভাব যদি তাদের হতাশার কালো অন্ধকারে নিক্ষেপ করে, তাহলে যে রাষ্ট্রে তারা বসবাস করে, সেই রাষ্ট্রটিকে তারা ভালোবাসবে কী করে? আদিবাসীরা জাতিগতভাবে এবং ভাষাগতভাবে এ দেশে সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে আদিবাসীদের অবস্থা অন্য যেকোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে আরো খারাপ। অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত আদিবাসীরা মাতৃভূমিকে দুই বাহুর বন্ধনে জড়িয়ে ধরতে দ্বিধা করবেন_সেটাই তো স্বাভাবিক। কনভেনশনে বক্তারা পুরনো কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, একটি দেশ কতটুকু গণতান্ত্রিক তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কেমন আছে তার ওপর ভিত্তি করে। সংখ্যালঘুরা যদি মনে করে তারা ভালো নেই, তার মানে ওই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রটি আদিবাসীদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে চলেছে। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমি সব মানুষের অধিকার চাই।' স্বাধীনতার পর একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে অত্যন্ত অগ্রসরমান একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। পরবর্তীকালে সেনাশাসনের যাঁতাকলে আদিবাসীদের দুর্দশা আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে এলেও আদিবাসীদের সত্যিকারের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনো সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে আদিবাসীদের যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তাতে আদিবাসীদের প্রতি সরকারের নেতিবাচক মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। এই সংশোধনীটিও আদিবাসীদের জন্য আরো একবার মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও সেটাকে সামনের দিকে অগ্রসর করানোর জন্য 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য' (Unity in Diversity) দর্শনটি উপস্থাপন করেছিলেন। ভারতীয় সমাজ নানা ধর্ম-বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। দূরদর্শী জওহর লাল নেহরু ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারতীয় সমাজে ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখতে হলে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য' দর্শনটি অনুশীলন করা খুবই জরুরি। আজকের দুনিয়ায় এটি প্রমাণিত সত্য যে মানবসভ্যতার অস্তিত্বের স্বার্থেই সমাজে বৈচিত্র্যকে যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখা দরকার। বৈচিত্র্য প্রকৃতপক্ষে সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করে, সমাজ জীবনকে একঘেয়েমি থেকে রক্ষা করে। তা ছাড়া বৈচিত্র্য আছে বলেই আমরা একে অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারি, জানতে পারি এবং আমাদের জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একক জাতীয়তাবাদের দর্শন একটি ভয়ংকর দর্শন। একক জাতীয়তাবাদ মানেই অন্যকে অস্বীকার করা, ধ্বংস করা_যা মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। মানবসমাজ টিকে থাকতে পারে বৈচিত্র্যের ওপর ভর করেই। আমাদের সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে বলেই আমাদের সমাজে কিছুটা বৈচিত্র্য আছে। সেই বৈচিত্র্যকে ধরে রাখতে হলে আমাদের আদিবাসীদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি তথা তাদের সার্বিক জীবনাচরণকে সংরক্ষণ করা ও তার উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক দেশ, বহু ভাষাভাষীর দেশ। এখানে বসবাসরত প্রায় ৪৫টির মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতি, এমনকি নানা ধর্ম। পাশাপাশি রয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাদের প্রায় সবাই বাঙালি, বাংলা তাদের মাতৃভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তা ছাড়া রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের অনেক মানুষ। কাজেই আমাদের সমাজ বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি। এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা নয়, বরং একে সংরক্ষণ করা এবং যথার্থ মর্যাদা দেওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি হওয়া দরকার। আদিবাসীরা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নাগরিক নানা অধিকার থেকে তারা আজও বঞ্চিত। আদিবাসীরা বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে বসবাস করে; কিন্তু তারা বন-জঙ্গল উজাড় করে না, পাহাড়-পর্বত ধ্বংস করে না। তারা বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সংরক্ষণ করে। তারা নদী-নালা, খাল-বিল রক্ষা করে। কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী সঞ্জীব দ্রং বলেছিলেন, 'আদিবাসীরা কখনো বলে না এই নদী আমার, বরং বলে আমি নদীর...। তারা কখনো বলে না, এই গাছ আমার, বরং বলে আমি গাছের...। তারা বলে না, এই বন এই পাহাড় আমার, বরং বলে আমি এই বনের, আমি এই পাহাড়ের।' আমাদের দেশের বনখেকো, নদী-নালা ও পাহাড়-পর্বত দখল করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, আদিবাসীদের ভূমি দখল করে তাদের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে তুলছে, পরিবেশের ভয়ানক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, তখন মনে হয় আদিবাসীদের জীবন প্রণালি থেকে আমাদের কত কিছুই না শেখার আছে। সে জন্য বলা যায়, যে সমাজের বৈচিত্র্য যত বেশি, সে সমাজের সংস্কৃতি তত উন্নত। আদিবাসী সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে এবং সব সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের জীবনকে আরো উদার ও মহীয়ান করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
tulshikumardas@gmail.com
এই কনভেনশনে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ অংশ নেন। একাডেমিক, শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনীতিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী, ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা কনভেনশনে উপস্থিত হয়ে আদিবাসীদের সার্বিক অবস্থা এবং পরিবেশ নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন।
কনভেনশনটিতে সব আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগণের নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত এবং তাদের সঙ্গে পরিবেশের যোগসূত্র-বিষয়ক। প্রায় সব বক্তাই বাংলাদেশে আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় হতাশ ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। আমরা জানি, আমাদের আদিবাসীরা নানাভাবে বঞ্চিত এবং ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। অত্যাচার, নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিতাড়ন, ভূমিদখল ইত্যাদি নানাবিধ নিপীড়ন তাদের নিত্যসঙ্গী। রাষ্ট্রও তাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী জনগণ আমাদের এই মাতৃভূমিতে বড়ই অসহায়! তারা যেমন নিজ দেশে পরবাসী! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক সংখ্যালঘু বা ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘুরা কখনো বৈষম্য বা বঞ্চনার শিকার হয় না। সব ধরনের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের জীবনাচরণকে সসম্মানে প্রতিপালন করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য। সংখ্যালঘুরা যেন কোনোমতেই নিজেদের অপাক্তেয় ও অগ্রহণীয় মনে না করে, সেদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রের আচরণে যদি সংখ্যালঘুরা কষ্ট পায়, তাদের যদি মনোবেদনা সৃষ্টি হয় কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণ বা সরকারের মনোভাব যদি তাদের হতাশার কালো অন্ধকারে নিক্ষেপ করে, তাহলে যে রাষ্ট্রে তারা বসবাস করে, সেই রাষ্ট্রটিকে তারা ভালোবাসবে কী করে? আদিবাসীরা জাতিগতভাবে এবং ভাষাগতভাবে এ দেশে সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে আদিবাসীদের অবস্থা অন্য যেকোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে আরো খারাপ। অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত আদিবাসীরা মাতৃভূমিকে দুই বাহুর বন্ধনে জড়িয়ে ধরতে দ্বিধা করবেন_সেটাই তো স্বাভাবিক। কনভেনশনে বক্তারা পুরনো কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, একটি দেশ কতটুকু গণতান্ত্রিক তা বোঝা যায় সে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কেমন আছে তার ওপর ভিত্তি করে। সংখ্যালঘুরা যদি মনে করে তারা ভালো নেই, তার মানে ওই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রটি আদিবাসীদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে চলেছে। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমি সব মানুষের অধিকার চাই।' স্বাধীনতার পর একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে অত্যন্ত অগ্রসরমান একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। পরবর্তীকালে সেনাশাসনের যাঁতাকলে আদিবাসীদের দুর্দশা আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে এলেও আদিবাসীদের সত্যিকারের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনো সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে আদিবাসীদের যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তাতে আদিবাসীদের প্রতি সরকারের নেতিবাচক মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। এই সংশোধনীটিও আদিবাসীদের জন্য আরো একবার মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও সেটাকে সামনের দিকে অগ্রসর করানোর জন্য 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য' (Unity in Diversity) দর্শনটি উপস্থাপন করেছিলেন। ভারতীয় সমাজ নানা ধর্ম-বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। দূরদর্শী জওহর লাল নেহরু ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারতীয় সমাজে ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখতে হলে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য' দর্শনটি অনুশীলন করা খুবই জরুরি। আজকের দুনিয়ায় এটি প্রমাণিত সত্য যে মানবসভ্যতার অস্তিত্বের স্বার্থেই সমাজে বৈচিত্র্যকে যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখা দরকার। বৈচিত্র্য প্রকৃতপক্ষে সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করে, সমাজ জীবনকে একঘেয়েমি থেকে রক্ষা করে। তা ছাড়া বৈচিত্র্য আছে বলেই আমরা একে অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারি, জানতে পারি এবং আমাদের জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একক জাতীয়তাবাদের দর্শন একটি ভয়ংকর দর্শন। একক জাতীয়তাবাদ মানেই অন্যকে অস্বীকার করা, ধ্বংস করা_যা মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। মানবসমাজ টিকে থাকতে পারে বৈচিত্র্যের ওপর ভর করেই। আমাদের সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে বলেই আমাদের সমাজে কিছুটা বৈচিত্র্য আছে। সেই বৈচিত্র্যকে ধরে রাখতে হলে আমাদের আদিবাসীদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি তথা তাদের সার্বিক জীবনাচরণকে সংরক্ষণ করা ও তার উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক দেশ, বহু ভাষাভাষীর দেশ। এখানে বসবাসরত প্রায় ৪৫টির মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতি, এমনকি নানা ধর্ম। পাশাপাশি রয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাদের প্রায় সবাই বাঙালি, বাংলা তাদের মাতৃভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তা ছাড়া রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের অনেক মানুষ। কাজেই আমাদের সমাজ বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি। এই বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা নয়, বরং একে সংরক্ষণ করা এবং যথার্থ মর্যাদা দেওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি হওয়া দরকার। আদিবাসীরা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নাগরিক নানা অধিকার থেকে তারা আজও বঞ্চিত। আদিবাসীরা বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে বসবাস করে; কিন্তু তারা বন-জঙ্গল উজাড় করে না, পাহাড়-পর্বত ধ্বংস করে না। তারা বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সংরক্ষণ করে। তারা নদী-নালা, খাল-বিল রক্ষা করে। কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী সঞ্জীব দ্রং বলেছিলেন, 'আদিবাসীরা কখনো বলে না এই নদী আমার, বরং বলে আমি নদীর...। তারা কখনো বলে না, এই গাছ আমার, বরং বলে আমি গাছের...। তারা বলে না, এই বন এই পাহাড় আমার, বরং বলে আমি এই বনের, আমি এই পাহাড়ের।' আমাদের দেশের বনখেকো, নদী-নালা ও পাহাড়-পর্বত দখল করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, আদিবাসীদের ভূমি দখল করে তাদের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে তুলছে, পরিবেশের ভয়ানক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, তখন মনে হয় আদিবাসীদের জীবন প্রণালি থেকে আমাদের কত কিছুই না শেখার আছে। সে জন্য বলা যায়, যে সমাজের বৈচিত্র্য যত বেশি, সে সমাজের সংস্কৃতি তত উন্নত। আদিবাসী সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে এবং সব সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের জীবনকে আরো উদার ও মহীয়ান করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
tulshikumardas@gmail.com
No comments