সপ্তাহের হালচাল-আওয়ামী লীগের পায়ে বিএনপির জুতা by আব্দুল কাইয়ুম

বিএনপির রাজনীতিতে ১২ মার্চ একটি বিভাজনরেখা টেনে দিল। আগের দিন ছিল কিছুটা আশা-নিরাশায়। আর পরদিনই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল। বিএনপি এখন বেশ দাপটের সঙ্গে বলতে পারবে যে হাজার দমন-পীড়ন চালিয়েও সরকার ঢাকা চলো অভিযান ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। তার মানে, সামনে তাদের জন্য আরও বড় সাফল্য অপেক্ষা করছে।

মজার ব্যাপার হলো, এই সাফল্যের জন্য তাদের তেমন কোনো চেষ্টা করতে হয়নি। আওয়ামী লীগই ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে বিএনপির ঢাকা চলো অভিযানকে এমন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সামনে এনেছে যে সবাই ভাবতে শুরু করল, দেখি কী হয়! এই দেখতে দেখতেই নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনের চত্বর ভরে গেল।
আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত যে ঢাকাতেই প্রায় দেড় কোটি মানুষ থাকে। বাইরের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় মানুষকে আসতে না দিলেও ঢাকার মানুষকে আটকাবে কীভাবে? সরকার যদি ধর-মার করে নামে, তা হলে ঢাকার মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত কৌতূহল সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। তা ছাড়া শুধু সরকারের বাড়াবাড়ির কারণে বিরক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতেও মানুষ নয়াপল্টনের সমাবেশে যেতে পারে। সরকারের ওপর মানুষের খুশি থাকার তো কোনো কারণ নেই। জিনিসপত্রের দাম তো বাড়ছেই। তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নতুন যোগ হয়েছে, কিন্তু লোডশেডিং তো কমেনি। তা হলে? বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে দেবে না, পুলিশ ও প্রশাসন লাগিয়ে গণগ্রেপ্তার করবে, দলীয় কর্মীদের দিয়ে বিরোধী দলের মিছিলে হামলা চালাবে, ভয়ভীতি সৃষ্টি করে বিরোধী দলকে দমনের চেষ্টা করবে—এটা কোন গণতন্ত্র?
পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে গিয়ে যে নিজের নাক কাটা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সে হুঁশটুকুও নেই। সমাবেশ তো হলোই, মানুষের স্রোত আটকানো গেল না, উল্টো মানুষের চোখে সরকারি দলের ভাবমূর্তি খাটো হলো। তারা না পারল দেখাতে যে বিরোধী দলের সমাবেশ ফাঁকা, না পারল বোঝাতে যে পুলিশি ব্যবস্থা না নিলে মানুষের জানমাল রক্ষা পেত না। সরকারি দলের একূল-ওকূল দুই-ই গেল।
প্রথমে তারা বলার চেষ্টা করেছিল যে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায় বলে ঢাকা চলো অভিযানে নেমেছে। হালে পানি পায়নি। এরপর বলা শুরু করল, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে, তাই মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সবকিছু করতে হবে। নিরীহ মানুষজনকে তথাকথিত নাশকতার অভিযোগে যখন ধরপাকড় শুরু করল, তখন বুঝতে বাকি রইল না যে সরকার মহাসমাবেশ-আতঙ্কে ভুগছে। কেউ যখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। এমন সব কাণ্ড করে বসে, যার পরিণাম নিজের জন্যই খারাপ হয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের কাজ-কারবার দেখলে সে রকমই মনে হয়।
বিরোধী দল হরতাল ডাকেনি। কিন্তু সরকারের চোটপাটে বাস-ট্রাক-লঞ্চ সব বন্ধ হয়ে সারা দেশে হরতালের চেয়েও বড় হরতাল হয়ে গেল। বলা চলে সরকারি হরতাল। ঢাকার রাস্তায় এমনকি রিকশা পর্যন্ত কম চলেছে। অথচ অন্যান্য হরতালের সময় অন্তত রিকশা, যাত্রীবাহী ভ্যান, কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশা, কিছু বাস চলাচল করে। মানুষ জরুরি কাজগুলো সেরে নিতে পারে। এবার কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি। হরতাল ডাকলে মানুষ বকাবকি করে, তাই বিএনপি এবার ঢাকা অভিযানের কর্মসূচি নিয়েছিল। এখন সরকার কোন মুখে হরতালের বিরুদ্ধে বলবে? তারা নিজেরাই তো সভা-সমাবেশের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে হরতালের মতো পরিস্থিতি ডেকে আনল। বিরোধী দলের জন্য সরকারের এটাই ছিল ১২ মার্চের উপহার। এর প্রতিদানস্বরূপ বিএনপি ২৯ মার্চ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। এখন সরকার কী বলে সেটাই দেখার বিষয়।
কেউ বলতে পারেন ২০০১-০৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যখন সমাবেশ, হরতাল, মিছিল করত, তখন তাদের ঠেকাতে বিএনপি সরকারও তো একই রকম বা এর চেয়েও বেশি দমন-পীড়ন চালিয়েছে। বিরোধী দলকে ঠান্ডা করার জন্য আমাদের দেশে এটাই তো চিরায়ত ওষুধ। তা হলে আওয়ামী লীগ বহুল প্রচলিত ওষুধটি ব্যবহার করে কী দোষ করল? আশা করি, আওয়ামী লীগ এ রকম বোকার মতো প্রশ্ন তুলবে না। কারণ, বিএনপি সরকার ওই সব পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধী দলকে কি ঠেকাতে পেরেছিল? নাকি তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল? কোনোটাই হয়নি, বরং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপিকে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগও কি সেই পথে যেতে চায়?
যদি না চায় তা হলে আওয়ামী লীগকে বুঝেশুনে চলতে হবে। বিএনপির খারাপ দিকগুলো বাদ দিতে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির এত কম আসন পাওয়ার কারণ ছিল, তাদের সরকারের আমলে দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অপশাসন, সরকারের সমান্তরালে হাওয়া ভবনের শাসন প্রভৃতি। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেলেই শুরু হতো গণগ্রেপ্তার, পুলিশি নির্যাতন। আওয়ামী লীগকে ঠিক করতে হবে, ওরা কোন পথে যাবে। বিএনপির পথ ধরে আওয়ামী লীগও পুলিশি ব্যবস্থা, গণগ্রেপ্তার শুরু করেছে। এই পথে কি ওরা আরও অগ্রসর হবে? দুর্নীতি, দলীয়করণ কমবেশি চলছে। খুনের আসামিদের সাজা মওকুফ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগকেই ঠিক করতে হবে, তারা কোন পথ বেছে নেবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, সমাবেশ তাঁরা বারবার করবেন, পারলে সরকার বারবার ঠেকানোর চেষ্টা করুক। মনে হয় সরকারের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। আর ঠেকানোর চেষ্টা না করে বরং সুশাসন নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিরোধী দলের কাজই তো সরকারের বিরুদ্ধে লাগা। তারা যদি সংসদে যায়, ভালো। যদি না যায়, রাস্তায় থাকে, থাকতে দিন। মহাসমাবেশ সব সময়ই হয়। এটা বিরোধী দলের সাধারণ কর্মসূচি। একে আটকাতে গিয়ে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা মানে বিরোধী দলের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
বিরোধী দলের এক মহাসমাবেশের ধাক্কায় সরকার কেন এমন আতঙ্কতাড়িত হয়ে পড়ল, সেটা বোঝা কঠিন। রজ্জুতে সর্পভয় বলে একটা কথা আছে। হয়তো কেউ ভেবেছেন আরবের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের জন্য জন-জাগরণের মতো এখানেও কিছু ঘটে যাবে। আরব-বসন্তের মতো করে এখানেও কোনো বসন্ত লাগার আশঙ্কা কেউ হয়তো করেছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার নামে এ রকম একটা গোপন উদ্যোগ নিয়েছিল। মানুষ দেখবে হঠাৎ হাজার হাজার লোক রাজপথে ঘাঁটি গেড়ে বসে গেছে, ওরা সরকারের পতন না ঘটা পর্যন্ত যাবে না। এই ছিল পরিকল্পনা। এটাই আরব-বসন্তের বাংলাদেশি সংস্করণ বলে দাবি করা হয়। তিন মাস আগে যেটা পারেনি, সেটা এবার বিএনপি করতে পারবে বলে যদি সরকার ভেবে থাকে, ভুল করবে।
এ দেশে মানুষ বসন্তে কোকিলের সুমধুর ডাক শুনতেই অভ্যস্ত। আর যত দিন পর্যন্ত নিয়মিত নির্বাচন ও নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে, এখানে রাজনৈতিক বসন্তের আগমন সম্ভবত কঠিন।
তবে একটা কথা। আওয়ামী লীগের ফেলে দেওয়া একটা খুব মূল্যবান রাজনৈতিক হাতিয়ার বিএনপি হাতে তুলে নিয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপিকে রাজপথে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল। সেই ধারাতেই এসেছিল আওয়ামী লীগের বিরাট বিজয়। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাটি মানুষ গ্রহণ করেছিল। আর এর পুরো কৃতিত্ব নিতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষে পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসা সম্ভব হয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগ সেটা বাদ দিয়েছে। আর বিএনপি তা লুফে নিয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি মহাসমাবেশ করেছে। আরও করবে। এই দাবিতে এবার বসন্ত লাগলেও লাগতে পারে।
সম্ভাব্য বাংলাদেশি বসন্তের আগমন রোধের জন্য পুলিশ না লাগিয়ে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হবে। এ জন্য আলোচনার পথ খোলা রাখা দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.