মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ-জার্মানিতে আন্তর্জাতিক আদালতে আজ রায়
প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে বাংলাদেশের মামলার রায় আজ বুধবার। জার্মানির হামবুর্গে সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের (ইটলস) প্রধান হলরুমে বিকেল সাড়ে ৪টায় (স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টা) আদালত বসবে। রায় ঘোষণা করবেন আদালতের সভাপতি হোসে লুইস জেসাস।
রায় ঘোষণা অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হবে ইটলসের ওয়েবসাইটে (www.itlos.org)। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ চাইছে ন্যায্যতাভিত্তিক পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। অন্যদিকে মিয়ানমারের দাবি, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ হোক। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হলে বাংলাদেশের সাগর এলাকা ভারত ও মিয়ানমারের সাগর এলাকা দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশের সাগর এলাকার পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১৩০ নটিক্যাল মাইল। অন্যদিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ ৪৬০ নটিক্যাল মাইল সাগর এলাকা পাবে।
সরকারের অতিরিক্ত সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ন্যায্যতাভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ মহীসোপান (কন্টিনেন্টাল শেলফ) ও 'এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন-ইইজেড' (স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল)- এই দাবি অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর ও তৎসংশ্লিষ্ট সব সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিশ্বে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের প্রায় সবই নিষ্পত্তি হয়েছে সমদূরত্বের ভিত্তিতে। অপরদিকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের নজির নগণ্য। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টির উল্লেখ করে ন্যায্যতার দাবি তুলেছে। অন্যদিকে ন্যায্যতার সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞাও নেই। তাই ইটলসে আজ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিরোধ নিয়ে মামলার রায় নিয়ে অন্য দেশগুলোরও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আজ রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত থাকবেন। বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কূটনীতিকেরও রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মামলার রায় ন্যায্যতার ভিত্তিতে হলে বাংলাদেশকে তার কয়েকটি গ্যাস ব্লকের দাবি ছাড়তে হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ সাগরে যে ২৮টি গ্যাস ব্লক ঘোষণা করেছে তার ১৭টি নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, বিরোধ মীমাংসার আগেই গ্যাস ব্লক ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে ওই ২৮টি গ্যাস ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা না করেই তার বা তাদের দাবি আছে এমন এলাকায় গ্যাস ব্লক ঘোষণা করে বাংলাদেশ। আজকের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে গ্যাস ব্লক নিয়ে বিরোধেরও নিরসন হতে যাচ্ছে।
বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ যেভাবে : মিয়ানমারের প্রস্তাব অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইটলসে সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর সমঝোতার ভিত্তিতে আইটিএলওএসে এই মামলা করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। এরপর ২০১০ সালের ১ জুলাই মিয়ানমার এবং ওই বছরই ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নিজেদের দাবির পক্ষে নথিপত্র জমা দেয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দুই দফায় শুনানি হয়। প্রথম দফায় বাংলাদেশের মৌখিক শুনানি ৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। আর ১৫ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারের বক্তব্য শোনে ট্রাইব্যুনাল। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় আবারো বাংলাদেশ তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। মিয়ানমার ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় তার বক্তব্য তুলে ধরে।
চূড়ান্ত শুনানিতে বাংলাদেশের যুক্তি : বাংলাদেশ যে তিনটি যুক্তি তুলে ধরেছে সেগুলো হলো- এক. ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সাগর এলাকার যে সীমানার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল ২০০৮ সালে এসে আবারো সেই সীমার ব্যাপারে পুনরায় সম্মত হয়েছে। সমুদ্রসীমা ওই সীমানার ভিত্তিতেই নির্ধারণ হওয়া উচিত। দুই. বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা সম্মত (১৯৭৪ ও ২০০৮ সাল) সীমারেখার সাত নম্বর পয়েন্ট থেকে ২১৫ ডিগ্রি বরাবর যাওয়া উচিত। তিন. ওই পয়েন্ট (সাত নম্বর) থেকে সীমারেখা নির্ধারিত হলে মিয়ানমারও ২০০ নটিক্যাল মাইল সাগর এলাকা পায়।
মিয়ানমারের যুক্তি : মিয়ানমার যে দুটি দাবি করেছে সেগুলো হলো- এক. বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের একক সমুদ্রসীমা 'এ' থেকে 'জি' (সাতটি পয়েন্ট) পর্যন্ত বিস্তৃত। দুই. 'জি' পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সমদূরত্ব রেখা ২৩১ ডিগ্রি ৩৭ মিনিট বরাবর অগ্রসর হয়ে এমন স্থান পর্যন্ত হওয়া উচিত যে পর্যন্ত গেলে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের অধিকার লংঘিত হয় না।
যে কারণে মামলা : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আলোচনা শুরু করে। ওই আলোচনায় ফলপ্রসূ কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০৯ সালের জুলাই, ২০১০ সালের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণে মিয়ানমারের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করে। অন্যদিকে ২০০৯ সালের মার্চ ও ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের অনন্য ভৌগোলিক ও ভূতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যগুলো আমলে নিয়ে ন্যায্যতাভিত্তিক উপায়ে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। অন্যদিকে মিয়ানমার ও ভারত বাংলাদেশের দাবি প্রত্যাখ্যান করে সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পক্ষে অবস্থান নেয়।
সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ দরপত্র আহ্বান করার পর প্রতিবেশী দেশগুলো তাতে আপত্তি জানায়। এ নিয়েই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাসব্লকের ১০টি ভারত ও ১৭টি মিয়ানমার তার নিজের বলে দাবি করে। এরপরই সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয়। জাতিসংঘ সমুদ্র আইন (আনক্লস) ১৯৮২ অনুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর মিয়ানমার ও ভারতের বিরুদ্ধে সালিসি নোটিশ পাঠায় বাংলাদেশ। মিয়ানমার ও ভারত ওই নোটিশে ইতিবাচক সাড়া দেয়। পাশাপাশি তারা আলোচনার দরজাও খোলা রাখে।
ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তির আশা : সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিয়ে মামলা চলছে নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক স্থায়ী সালিস ট্রাইব্যুনালে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন-১৯৮২-এর অ্যানেক্স সেভেনের অধীনে গঠিত সালিস ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলায় বাংলাদেশ তার দাবি-দাওয়াসমেত 'মেমোরিয়াল' গত বছরের ৩১ মে ট্রাইব্যুনালের কাছে জমা দিয়েছে। চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত পাল্টা মেমোরিয়াল জমা দেবে। সব লিখিত ও মৌখিক শুনানি শেষে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি ওই মামলার রায় পাওয়া যাবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।
মহীসোপানের মালিকানা নিয়ে অবস্থানপত্র : বঙ্গোপসাগরের সম্প্রসারিত মহীসোপানে বাংলাদেশের দাবিসংক্রান্ত ভূ-তাত্তি্বক উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ২০১০ সালের মার্চ মাসে একটি নিবেদিত সাইসমিক জরিপ এবং ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে সমুদ্রের গভীরতা নিরীক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যথিমেট্রিক জরিপ সম্পাদন করা হয়। এরপর বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের মালিকানা নিয়ে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহীসোপানের সীমানির্ধারক কমিশনে (সিএলসিএস) অবস্থানপত্র জমা দেয় বাংলাদেশ। এতে সাগরের সীমানা নির্ধারণের সূচনা বিন্দু থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় বাংলাদেশের মালিকানা রয়েছে বলে দাবি করা হয়। ওই অবস্থানপত্রে বলা হয়, 'মহীসোপানে বাংলাদেশের মালিকানা সাগরের ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার সমান।' কিন্তু গত ৩১ মার্চ জাতিসংঘে এক আপত্তিপত্রে মিয়ানমার দাবি করে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের পর মহীসোপানে বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই। ভারতও গত ২০ জুন এ বিষয়ে জাতিসংঘে আপত্তিপত্র দেয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ সমুদ্রসীমার সূচনাবিন্দু নির্ধারণে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন (আনক্লজ) মানেনি। মহীসোপানে বাংলাদেশের সীমানার এই দাবি নিয়ে জাতিসংঘে শুনানি হয় গত আগস্ট মাসে।
বাংলাদেশ চাইছে ন্যায্যতাভিত্তিক পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। অন্যদিকে মিয়ানমারের দাবি, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ হোক। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হলে বাংলাদেশের সাগর এলাকা ভারত ও মিয়ানমারের সাগর এলাকা দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশের সাগর এলাকার পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১৩০ নটিক্যাল মাইল। অন্যদিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ ৪৬০ নটিক্যাল মাইল সাগর এলাকা পাবে।
সরকারের অতিরিক্ত সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ন্যায্যতাভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশ মহীসোপান (কন্টিনেন্টাল শেলফ) ও 'এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন-ইইজেড' (স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল)- এই দাবি অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর ও তৎসংশ্লিষ্ট সব সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিশ্বে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের প্রায় সবই নিষ্পত্তি হয়েছে সমদূরত্বের ভিত্তিতে। অপরদিকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের নজির নগণ্য। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টির উল্লেখ করে ন্যায্যতার দাবি তুলেছে। অন্যদিকে ন্যায্যতার সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞাও নেই। তাই ইটলসে আজ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিরোধ নিয়ে মামলার রায় নিয়ে অন্য দেশগুলোরও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আজ রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত থাকবেন। বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কূটনীতিকেরও রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মামলার রায় ন্যায্যতার ভিত্তিতে হলে বাংলাদেশকে তার কয়েকটি গ্যাস ব্লকের দাবি ছাড়তে হতে পারে। কেননা বাংলাদেশ সাগরে যে ২৮টি গ্যাস ব্লক ঘোষণা করেছে তার ১৭টি নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, বিরোধ মীমাংসার আগেই গ্যাস ব্লক ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে ওই ২৮টি গ্যাস ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসা না করেই তার বা তাদের দাবি আছে এমন এলাকায় গ্যাস ব্লক ঘোষণা করে বাংলাদেশ। আজকের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে গ্যাস ব্লক নিয়ে বিরোধেরও নিরসন হতে যাচ্ছে।
বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ যেভাবে : মিয়ানমারের প্রস্তাব অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইটলসে সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর সমঝোতার ভিত্তিতে আইটিএলওএসে এই মামলা করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। এরপর ২০১০ সালের ১ জুলাই মিয়ানমার এবং ওই বছরই ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নিজেদের দাবির পক্ষে নথিপত্র জমা দেয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দুই দফায় শুনানি হয়। প্রথম দফায় বাংলাদেশের মৌখিক শুনানি ৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। আর ১৫ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারের বক্তব্য শোনে ট্রাইব্যুনাল। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় আবারো বাংলাদেশ তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। মিয়ানমার ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় তার বক্তব্য তুলে ধরে।
চূড়ান্ত শুনানিতে বাংলাদেশের যুক্তি : বাংলাদেশ যে তিনটি যুক্তি তুলে ধরেছে সেগুলো হলো- এক. ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সাগর এলাকার যে সীমানার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল ২০০৮ সালে এসে আবারো সেই সীমার ব্যাপারে পুনরায় সম্মত হয়েছে। সমুদ্রসীমা ওই সীমানার ভিত্তিতেই নির্ধারণ হওয়া উচিত। দুই. বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা সম্মত (১৯৭৪ ও ২০০৮ সাল) সীমারেখার সাত নম্বর পয়েন্ট থেকে ২১৫ ডিগ্রি বরাবর যাওয়া উচিত। তিন. ওই পয়েন্ট (সাত নম্বর) থেকে সীমারেখা নির্ধারিত হলে মিয়ানমারও ২০০ নটিক্যাল মাইল সাগর এলাকা পায়।
মিয়ানমারের যুক্তি : মিয়ানমার যে দুটি দাবি করেছে সেগুলো হলো- এক. বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের একক সমুদ্রসীমা 'এ' থেকে 'জি' (সাতটি পয়েন্ট) পর্যন্ত বিস্তৃত। দুই. 'জি' পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সমদূরত্ব রেখা ২৩১ ডিগ্রি ৩৭ মিনিট বরাবর অগ্রসর হয়ে এমন স্থান পর্যন্ত হওয়া উচিত যে পর্যন্ত গেলে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের অধিকার লংঘিত হয় না।
যে কারণে মামলা : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আলোচনা শুরু করে। ওই আলোচনায় ফলপ্রসূ কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০৯ সালের জুলাই, ২০১০ সালের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণে মিয়ানমারের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করে। অন্যদিকে ২০০৯ সালের মার্চ ও ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের অনন্য ভৌগোলিক ও ভূতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যগুলো আমলে নিয়ে ন্যায্যতাভিত্তিক উপায়ে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। অন্যদিকে মিয়ানমার ও ভারত বাংলাদেশের দাবি প্রত্যাখ্যান করে সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পক্ষে অবস্থান নেয়।
সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ দরপত্র আহ্বান করার পর প্রতিবেশী দেশগুলো তাতে আপত্তি জানায়। এ নিয়েই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাসব্লকের ১০টি ভারত ও ১৭টি মিয়ানমার তার নিজের বলে দাবি করে। এরপরই সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয়। জাতিসংঘ সমুদ্র আইন (আনক্লস) ১৯৮২ অনুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর মিয়ানমার ও ভারতের বিরুদ্ধে সালিসি নোটিশ পাঠায় বাংলাদেশ। মিয়ানমার ও ভারত ওই নোটিশে ইতিবাচক সাড়া দেয়। পাশাপাশি তারা আলোচনার দরজাও খোলা রাখে।
ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তির আশা : সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিয়ে মামলা চলছে নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক স্থায়ী সালিস ট্রাইব্যুনালে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন-১৯৮২-এর অ্যানেক্স সেভেনের অধীনে গঠিত সালিস ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণী মামলায় বাংলাদেশ তার দাবি-দাওয়াসমেত 'মেমোরিয়াল' গত বছরের ৩১ মে ট্রাইব্যুনালের কাছে জমা দিয়েছে। চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত পাল্টা মেমোরিয়াল জমা দেবে। সব লিখিত ও মৌখিক শুনানি শেষে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি ওই মামলার রায় পাওয়া যাবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।
মহীসোপানের মালিকানা নিয়ে অবস্থানপত্র : বঙ্গোপসাগরের সম্প্রসারিত মহীসোপানে বাংলাদেশের দাবিসংক্রান্ত ভূ-তাত্তি্বক উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ২০১০ সালের মার্চ মাসে একটি নিবেদিত সাইসমিক জরিপ এবং ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে সমুদ্রের গভীরতা নিরীক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যথিমেট্রিক জরিপ সম্পাদন করা হয়। এরপর বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের মালিকানা নিয়ে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মহীসোপানের সীমানির্ধারক কমিশনে (সিএলসিএস) অবস্থানপত্র জমা দেয় বাংলাদেশ। এতে সাগরের সীমানা নির্ধারণের সূচনা বিন্দু থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় বাংলাদেশের মালিকানা রয়েছে বলে দাবি করা হয়। ওই অবস্থানপত্রে বলা হয়, 'মহীসোপানে বাংলাদেশের মালিকানা সাগরের ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার সমান।' কিন্তু গত ৩১ মার্চ জাতিসংঘে এক আপত্তিপত্রে মিয়ানমার দাবি করে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের পর মহীসোপানে বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই। ভারতও গত ২০ জুন এ বিষয়ে জাতিসংঘে আপত্তিপত্র দেয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ সমুদ্রসীমার সূচনাবিন্দু নির্ধারণে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন (আনক্লজ) মানেনি। মহীসোপানে বাংলাদেশের সীমানার এই দাবি নিয়ে জাতিসংঘে শুনানি হয় গত আগস্ট মাসে।
No comments