মেঘনায় গেল কত প্রাণ-৩২ লাশ উদ্ধার, আজ আবার অভিযান
মুন্সীগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীতে আনুমানিক ৩০০ যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে লঞ্চ শরীয়তপুর-১। এ ঘটনায় নারী, শিশুসহ এ পর্যন্ত মোট ৩২ জনের লাশ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। লঞ্চটি গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় শরীয়তপুরের সুরেশ্বর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। যাত্রীদের বেশির ভাগই শরীয়তপুরের বাসিন্দা।
মেঘনায় লঞ্চডুবির ঘটনায় বাংলাভিশনের জ্যেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক মাসুদ চৌধুরী সপরিবারে নিখোঁজ রয়েছেন। এ ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মর্মস্পর্শী এ দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
শরীয়তপুরের সুরেশ্বর এলাকার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাট থেকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে দোতলা লঞ্চটি তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিনি আরো জানান, লঞ্চটিতে ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার, রামভদ্রপুর, কার্তিকপুর ও ঘড়িসার অঞ্চলের যাত্রী ছিল বেশি। যাত্রীরা বলছেন, দোতলা এ লঞ্চটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিল। ফলে ধাক্কা লাগার পর ডুবে যায়।
দুর্ঘটনার পর রাতেই খালিদ হাসান ও লিটন মিয়া নামের লঞ্চের দুই যাত্রী সাঁতরে একটি ট্রলারে উঠতে পারায় প্রাণে বেঁচে যান। ওই দুই যাত্রী পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাত ২টার দিকে তেলবাহী একটি নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি। এ সময় তাঁরা দুজন সাঁতরে একটি ট্রলারে ওঠেন। তাঁরা বলেন, সাঁতার কেটে আরো ৪০-৫০ জন তীরে উঠেছে। এ ছাড়া ঢাকাগামী মিতালী নামের একটি লঞ্চ প্রায় ৩০-৩৫ জনকে উদ্ধার করেছে। অন্যরা লঞ্চেই আটকে আছে বলে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা এবং একই পরিবারের একাধিক সদস্য হলে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া দাফন-কাফনের জন্য অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
গতকাল বিকেল পর্যন্ত উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। একপর্যায়ে উদ্ধারকাজ হামজা না আসা পর্যন্ত স্থগিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। বিআইডাবি্লউটিএর জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক (ট্রাফিক-সদরঘাট) মো. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, সকালে বরিশাল থেকে রওনা হয়েছে জাহাজ হামজা। জাহাজটি পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টা-রাত ৮টা বেজে যেতে পারে। তবে রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হামজা আসার খবর পাওয়া যায়নি।
সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে প্রায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ডুবে যায়। গজারিয়া উপজেলার লঞ্চঘাটের কাছাকাছি চরযাত্রা এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে লঞ্চটির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। এরপর উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম শরীয়তপুরের গজারিয়া লঞ্চঘাটের কাছাকাছি চরযাত্রা এলাকায় পৌঁছে কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও বিআইডাবি্লউটিএর সহযোগিতায় উদ্ধারকাজ শুরু করে। বিআইডাবি্লউটিএর চেয়ারম্যান সামসুজ্জোহা খন্দকার জানান, লঞ্চটি প্রায় ৭০ ফুট পানির নিচে রয়েছে।
জানা যায়, বিআইডাবি্লউটিএর ডুবরিরা মায়ের কোলে শিশুসহ ২৬টি লাশ লঞ্চের ভেতর থেকে উদ্ধার করে। লাশ উদ্ধারকাজ বন্ধ করার পর আরো ছয়টি লাশ বিকেলের দিকে ভেসে ওঠে। লাশের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ ও তিনজন নারী, এক কিশোরী ও পাঁচ শিশু। ৩২টি লাশের মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে এবং ২৪টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
যাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রিপন, বদরুন্নেসা, শাবনূর, শাহজামাল; সখীপুরের হজরত আলী, মিনহাজুল; চরচান্দার রছিতন ও আমিন; ডামুড্যার বাপ্পি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার রুবেল, পারভেজ, বিয়ানা আক্তার; ঢাকার পোস্তগোলার সিরাজ দেওয়ান, গোপীবাগ এলাকার ফয়সাল, রিন্টু; নড়িয়ার পতিসারের আলী আহম্মেদ, শিফাত, ইসমাইল মাঝি, শাহরিয়ার বাদশা মাঝি; সুরেশ্বরের আলমগীর মীর, সাদেক, মিলন খান, আবদুল লতিফ, রূপবান বিবি ও ডিঙ্গা মানিকের সালাউদ্দিন।
মেঘনাতীরে আহাজারি : স্বজনের খোঁজে সুরেশ্বর লঞ্চঘাটে চলছে স্বজনদের কান্না, আহাজারি। আবদুল গনি আকন্দ নামের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী বলেন, 'আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গায়ে পানি লাগলে বুঝতে পারি লঞ্চ ডুবে গেছে। কোনো রকমে পানির নিচ থেকে ভেসে উঠি। সঙ্গে আমার বন্ধু আবুল হোসেন ছিল, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।'
লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী দুলাল দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ভাই আমেরিকা যাবে, তাকে বিদায় জানাতে পরিবারের আটজন লঞ্চে ছিলাম। আমি বের হতে পারলেও বাকিরা ক্যাবিনে থাকায় বের হতে পারেনি।' দুলাল জানান, যাত্রীদের বেশির ভাগই দুর্ঘটনার সময় ঘুমিয়ে ছিল।
নাসির নামের এক ব্যক্তি জানান, তাঁর ভাগিনা শামিম, বোন পলি, খাদিজা ও রিপাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে আত্মীয়দের খুঁজতে আসা নাসির খান জানান, তাঁর পাঁচ স্বজন ছিল ক্যাবিনে। এদের মধ্যে তাঁর বোন, ভাগি্ন ও ভাগ্নের আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল।
খবর পেয়ে ঢাকার মালিবাগ থেকে ছুটে এসেছেন আবুল কালাম। তিনি জানান, তাঁর ১৭ জন আত্মীয় ছিল। তাদের মধ্যে চারজন জীবিত উদ্ধার হয়েছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী রাজু সাংবাদিকদের বলেছেন, রাত ২টার দিকে বালুবাহী একটি বলগেটের ধাক্কায় লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যায়। এ সময় অন্য একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিতালী-৩ একজন শিশুসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে। তিনি জানান, সঙ্গে থাকা তাঁর ভাই সেলিমকে (২২) এখনো পাওয়া যায়নি।
মিতালী লঞ্চের আনসার কমান্ডার আবদুল হালিম বলেন, 'শরীয়তপুর-১ ডুবে যাচ্ছে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের লঞ্চের সবগুলো বয়া নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে প্রায় ৩০ জনকে উদ্ধার করা গেছে।'
যাত্রীর স্বজন শহীদুল হক কালের কণ্ঠের শরীয়তপুর প্রতিনিধিকে বলেন, 'মানিকগঞ্জ থেকে ইতালিপ্রবাসী রিংকু ও আমিন আমাদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসে। তাদের গতকাল এ লঞ্চের ক্যাবিনে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।' ভেদরগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন জানান, 'মহিষারের আমার এক আত্মীয় এ লঞ্চে ওঠেন। এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।'
নিখোঁজ যাত্রী এনামুল হক সুমনের বাবা আবদুুল হক বেপারি জানান, বুধবারের ফ্লাইটে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল সুমনের। তিন মাস আগে দেশে ফিরে বিয়ে করেন তিনি। সোমবার রাতে স্ত্রী আর শাশুড়িকে নিয়ে লঞ্চে ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। বিকেল পর্যন্ত নদীর তীরে অপেক্ষা করেও তাঁদের কারো খোঁজ পাননি আবদুল হক।
দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া নড়িয়া উপজেলার হাকিম নামের এক যাত্রী আমাদের লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধিকে বলেন, 'রাতে প্রায় সব যাত্রীই ঘুমিয়ে ছিল। তেলবাহী কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর ব্যাপক হুড়োহুড়ি শুরু হলে আমি জানালা দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিই।'
জানা যায়, বিআইডাবি্লউটিএর কর্মী এবং কোস্টগার্ড সদস্যরা গতকাল সকালে উদ্ধার অভিযান শুরু করলেও নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির অবস্থান নির্ণয় করতেই সকাল ১১টা বেজে যায়। সকাল থেকেই লঞ্চের যাত্রীদের খোঁজে নদীর তীরে জড়ো হতে শুরু করে তাদের স্বজনরা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাবি্লউটিএ) চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার জানান, মেঘনার মূল চ্যানেলের চরকিশোরী এলাকায় প্রায় ৭০ ফুট পানির নিচে রয়েছে লঞ্চটি। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ইতিমধ্যে লঞ্চটিকে বেঁধেছে। অপর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা আসার পর টেনে তোলার কাজ শুরু হবে।
চেয়ারম্যান আরো বলেন, ডুবে যাওয়া লঞ্চটির ওজন অন্তত ২০০ টন। রুস্তম ও হামজার সম্মিলিত উদ্ধার ক্ষমতা ১২০ টনের মতো। ফলে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি উদ্ধারে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। এতে অনেক সময় লাগবে বলেও মনে করছেন তিনি।
বিকেল সাড়ে ৩টায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের কমান্ডার ফজলুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, রুস্তমের পক্ষে এককভাবে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করা সম্ভব নয়। হামজা আসার পর লঞ্চটির দুই পাশে রশি বেঁধে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হবে। ফজলুর রহমান আরো জানান, রুস্তমের উদ্ধার ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬০ টন। কিন্তু এমভি শরীয়তপুরের মতো লঞ্চগুলোর ওজন প্রায় দেড় শ টন। লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা কলিমুল্লাহ ঘটনাস্থল থেকে বাংনিউজকে জানান, লঞ্চের মালিক শরীয়তপুরের ফিরোজ চৌধুরী।
মরিচের বস্তার কারণে : এদিকে লঞ্চে আরো অনেক লাশ রয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের এক ডুবুরি। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে প্রথম লাশ উদ্ধারকারী ডুবুরি আলাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চের জানালায় মরিচের বস্তা স্তূপ করে রাখার কারণে দুর্ঘটনার সময় অনেকেই চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি। এমনকি দুর্ঘটনার পর লাশ উদ্ধারকাজও ব্যাহত হচ্ছে ওই মরিচের বস্তার কারণে। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের চারজন ডুবুরি অংশ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
অফিসে জানাজা : অফিসে যোগদান করা হলো না সিরাজ দেওয়ানের (৫২)। বরং অফিসেই হলো জানাজা। সিরাজ দেওয়ান নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটিতে বিদ্যুৎ অফিসে (ডিপিডিসি) চাকরি করতেন। সিরাজ দেওয়ানের বড় ছেলে মিঠু আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিকে জানান, তাঁর বাবা ছুটি শেষে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে বিদ্যুৎ অফিসে যোগদানের উদ্দেশে সোমবার সুরেশ্বর থেকে লঞ্চে উঠেন। লঞ্চডুবির খবর পেয়ে গতকাল তাঁরা এসে লাশ শনাক্ত করেন। পরে সেখান থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সিরাজ দেওয়ানের কর্মস্থলে। রাত ৮টার দিকে ফতুল্লার পঞ্চবটি বিদ্যুৎ অফিসে তাঁর সহকর্মীরা লাশের জানাজা পড়েন। জানাজা শেষে দাফনের উদ্দেশ্যে শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার ঘড়িসার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। পঞ্চবটি ডিপিডিসির কর্মকর্তা আসাদুর রহমান জানান, নিহত সিরাজ দেওয়ান বিদ্যুৎ অফিসে ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় মেঘনা নদীতে লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। উদ্ধার অভিযান ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীও লঞ্চডুবিতে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন।
সংসদে শোক প্রকাশ : এ ছাড়া এ দুর্ঘটনায় জাতীয় সংসদে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণ পরই তিনি ওই দুর্ঘটনা সম্পর্কে সংসদকে জানান। স্পিকার বলেন, 'লঞ্চডুবিতে বেশকিছু মানুষ নিহত হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছে। সংসদ নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছে।'
ক্ষতিপূরণের আশ্বাস : মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তবে একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকলে ৪৫ হাজার টাকা করে পাবে।'
নৌপরিবহনমন্ত্রী দুপুর ২টার দিকে গজারিয়ার দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার ছাড়াও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আধা ঘণ্টা সেখানে উদ্ধারকাজ তদারকির পর ঢাকার দিকে রওনা হন মন্ত্রী। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এম ইদ্রিস আলী দুপুর আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে যান।
উঠবে কি লঞ্চটি : বিআইডাবি্লউটিএ সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌপথের দুর্ঘটনাকবলিত নৌযান উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে মাত্র দুটি সরকারি জাহাজ হামজা ও রুস্তম। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি থেকে হামজা আনা হয়। রুস্তম আমদানি হয় ১৯৮৩ সালে। দুটির উত্তোলনক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬০ টন করে মোট ১২০ টন। আর ডুবে যাওয়া শরীয়তপুরের ওজন প্রায় ২০০ টন। ফলে এর উদ্ধার নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
জাহাজ হামজার প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, জাহাজটির পাখা খুলে ফেলায় টাগবোটের 'টানা পদ্ধতি'তে এটিকে চালাতে হয়। কোথাও যেতে হলে হামজার দুই পাশে দুটি ছোট জাহাজ বেঁধে দেওয়া হয়। আর রুস্তমকে কোথাও নিতে হলে ব্যবহার করা হয় 'ঠেলা' পদ্ধতি_রুস্তমের পেছনে বেঁধে দেওয়া হয় আরেকটি জাহাজ 'অগ্রপথিক'। ওই অগ্রপথিক নিজে চলতে থাকে এবং ঠেলে নিয়ে যায় রুস্তমকে।
শরীয়তপুরের সুরেশ্বর এলাকার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাট থেকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে দোতলা লঞ্চটি তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তিনি আরো জানান, লঞ্চটিতে ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার, রামভদ্রপুর, কার্তিকপুর ও ঘড়িসার অঞ্চলের যাত্রী ছিল বেশি। যাত্রীরা বলছেন, দোতলা এ লঞ্চটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিল। ফলে ধাক্কা লাগার পর ডুবে যায়।
দুর্ঘটনার পর রাতেই খালিদ হাসান ও লিটন মিয়া নামের লঞ্চের দুই যাত্রী সাঁতরে একটি ট্রলারে উঠতে পারায় প্রাণে বেঁচে যান। ওই দুই যাত্রী পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাত ২টার দিকে তেলবাহী একটি নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি। এ সময় তাঁরা দুজন সাঁতরে একটি ট্রলারে ওঠেন। তাঁরা বলেন, সাঁতার কেটে আরো ৪০-৫০ জন তীরে উঠেছে। এ ছাড়া ঢাকাগামী মিতালী নামের একটি লঞ্চ প্রায় ৩০-৩৫ জনকে উদ্ধার করেছে। অন্যরা লঞ্চেই আটকে আছে বলে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা এবং একই পরিবারের একাধিক সদস্য হলে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া দাফন-কাফনের জন্য অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
গতকাল বিকেল পর্যন্ত উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। একপর্যায়ে উদ্ধারকাজ হামজা না আসা পর্যন্ত স্থগিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। বিআইডাবি্লউটিএর জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক (ট্রাফিক-সদরঘাট) মো. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, সকালে বরিশাল থেকে রওনা হয়েছে জাহাজ হামজা। জাহাজটি পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টা-রাত ৮টা বেজে যেতে পারে। তবে রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হামজা আসার খবর পাওয়া যায়নি।
সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে প্রায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ডুবে যায়। গজারিয়া উপজেলার লঞ্চঘাটের কাছাকাছি চরযাত্রা এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে লঞ্চটির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। এরপর উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম শরীয়তপুরের গজারিয়া লঞ্চঘাটের কাছাকাছি চরযাত্রা এলাকায় পৌঁছে কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও বিআইডাবি্লউটিএর সহযোগিতায় উদ্ধারকাজ শুরু করে। বিআইডাবি্লউটিএর চেয়ারম্যান সামসুজ্জোহা খন্দকার জানান, লঞ্চটি প্রায় ৭০ ফুট পানির নিচে রয়েছে।
জানা যায়, বিআইডাবি্লউটিএর ডুবরিরা মায়ের কোলে শিশুসহ ২৬টি লাশ লঞ্চের ভেতর থেকে উদ্ধার করে। লাশ উদ্ধারকাজ বন্ধ করার পর আরো ছয়টি লাশ বিকেলের দিকে ভেসে ওঠে। লাশের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ ও তিনজন নারী, এক কিশোরী ও পাঁচ শিশু। ৩২টি লাশের মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে এবং ২৪টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
যাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রিপন, বদরুন্নেসা, শাবনূর, শাহজামাল; সখীপুরের হজরত আলী, মিনহাজুল; চরচান্দার রছিতন ও আমিন; ডামুড্যার বাপ্পি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার রুবেল, পারভেজ, বিয়ানা আক্তার; ঢাকার পোস্তগোলার সিরাজ দেওয়ান, গোপীবাগ এলাকার ফয়সাল, রিন্টু; নড়িয়ার পতিসারের আলী আহম্মেদ, শিফাত, ইসমাইল মাঝি, শাহরিয়ার বাদশা মাঝি; সুরেশ্বরের আলমগীর মীর, সাদেক, মিলন খান, আবদুল লতিফ, রূপবান বিবি ও ডিঙ্গা মানিকের সালাউদ্দিন।
মেঘনাতীরে আহাজারি : স্বজনের খোঁজে সুরেশ্বর লঞ্চঘাটে চলছে স্বজনদের কান্না, আহাজারি। আবদুল গনি আকন্দ নামের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী বলেন, 'আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গায়ে পানি লাগলে বুঝতে পারি লঞ্চ ডুবে গেছে। কোনো রকমে পানির নিচ থেকে ভেসে উঠি। সঙ্গে আমার বন্ধু আবুল হোসেন ছিল, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।'
লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী দুলাল দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ভাই আমেরিকা যাবে, তাকে বিদায় জানাতে পরিবারের আটজন লঞ্চে ছিলাম। আমি বের হতে পারলেও বাকিরা ক্যাবিনে থাকায় বের হতে পারেনি।' দুলাল জানান, যাত্রীদের বেশির ভাগই দুর্ঘটনার সময় ঘুমিয়ে ছিল।
নাসির নামের এক ব্যক্তি জানান, তাঁর ভাগিনা শামিম, বোন পলি, খাদিজা ও রিপাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে আত্মীয়দের খুঁজতে আসা নাসির খান জানান, তাঁর পাঁচ স্বজন ছিল ক্যাবিনে। এদের মধ্যে তাঁর বোন, ভাগি্ন ও ভাগ্নের আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল।
খবর পেয়ে ঢাকার মালিবাগ থেকে ছুটে এসেছেন আবুল কালাম। তিনি জানান, তাঁর ১৭ জন আত্মীয় ছিল। তাদের মধ্যে চারজন জীবিত উদ্ধার হয়েছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী রাজু সাংবাদিকদের বলেছেন, রাত ২টার দিকে বালুবাহী একটি বলগেটের ধাক্কায় লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যায়। এ সময় অন্য একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিতালী-৩ একজন শিশুসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে। তিনি জানান, সঙ্গে থাকা তাঁর ভাই সেলিমকে (২২) এখনো পাওয়া যায়নি।
মিতালী লঞ্চের আনসার কমান্ডার আবদুল হালিম বলেন, 'শরীয়তপুর-১ ডুবে যাচ্ছে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের লঞ্চের সবগুলো বয়া নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে প্রায় ৩০ জনকে উদ্ধার করা গেছে।'
যাত্রীর স্বজন শহীদুল হক কালের কণ্ঠের শরীয়তপুর প্রতিনিধিকে বলেন, 'মানিকগঞ্জ থেকে ইতালিপ্রবাসী রিংকু ও আমিন আমাদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসে। তাদের গতকাল এ লঞ্চের ক্যাবিনে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।' ভেদরগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন জানান, 'মহিষারের আমার এক আত্মীয় এ লঞ্চে ওঠেন। এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।'
নিখোঁজ যাত্রী এনামুল হক সুমনের বাবা আবদুুল হক বেপারি জানান, বুধবারের ফ্লাইটে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল সুমনের। তিন মাস আগে দেশে ফিরে বিয়ে করেন তিনি। সোমবার রাতে স্ত্রী আর শাশুড়িকে নিয়ে লঞ্চে ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। বিকেল পর্যন্ত নদীর তীরে অপেক্ষা করেও তাঁদের কারো খোঁজ পাননি আবদুল হক।
দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া নড়িয়া উপজেলার হাকিম নামের এক যাত্রী আমাদের লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধিকে বলেন, 'রাতে প্রায় সব যাত্রীই ঘুমিয়ে ছিল। তেলবাহী কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর ব্যাপক হুড়োহুড়ি শুরু হলে আমি জানালা দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিই।'
জানা যায়, বিআইডাবি্লউটিএর কর্মী এবং কোস্টগার্ড সদস্যরা গতকাল সকালে উদ্ধার অভিযান শুরু করলেও নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির অবস্থান নির্ণয় করতেই সকাল ১১টা বেজে যায়। সকাল থেকেই লঞ্চের যাত্রীদের খোঁজে নদীর তীরে জড়ো হতে শুরু করে তাদের স্বজনরা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাবি্লউটিএ) চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার জানান, মেঘনার মূল চ্যানেলের চরকিশোরী এলাকায় প্রায় ৭০ ফুট পানির নিচে রয়েছে লঞ্চটি। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ইতিমধ্যে লঞ্চটিকে বেঁধেছে। অপর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা আসার পর টেনে তোলার কাজ শুরু হবে।
চেয়ারম্যান আরো বলেন, ডুবে যাওয়া লঞ্চটির ওজন অন্তত ২০০ টন। রুস্তম ও হামজার সম্মিলিত উদ্ধার ক্ষমতা ১২০ টনের মতো। ফলে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি উদ্ধারে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। এতে অনেক সময় লাগবে বলেও মনে করছেন তিনি।
বিকেল সাড়ে ৩টায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের কমান্ডার ফজলুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, রুস্তমের পক্ষে এককভাবে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করা সম্ভব নয়। হামজা আসার পর লঞ্চটির দুই পাশে রশি বেঁধে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হবে। ফজলুর রহমান আরো জানান, রুস্তমের উদ্ধার ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬০ টন। কিন্তু এমভি শরীয়তপুরের মতো লঞ্চগুলোর ওজন প্রায় দেড় শ টন। লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা কলিমুল্লাহ ঘটনাস্থল থেকে বাংনিউজকে জানান, লঞ্চের মালিক শরীয়তপুরের ফিরোজ চৌধুরী।
মরিচের বস্তার কারণে : এদিকে লঞ্চে আরো অনেক লাশ রয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের এক ডুবুরি। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে প্রথম লাশ উদ্ধারকারী ডুবুরি আলাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চের জানালায় মরিচের বস্তা স্তূপ করে রাখার কারণে দুর্ঘটনার সময় অনেকেই চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি। এমনকি দুর্ঘটনার পর লাশ উদ্ধারকাজও ব্যাহত হচ্ছে ওই মরিচের বস্তার কারণে। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের চারজন ডুবুরি অংশ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
অফিসে জানাজা : অফিসে যোগদান করা হলো না সিরাজ দেওয়ানের (৫২)। বরং অফিসেই হলো জানাজা। সিরাজ দেওয়ান নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটিতে বিদ্যুৎ অফিসে (ডিপিডিসি) চাকরি করতেন। সিরাজ দেওয়ানের বড় ছেলে মিঠু আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিকে জানান, তাঁর বাবা ছুটি শেষে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে বিদ্যুৎ অফিসে যোগদানের উদ্দেশে সোমবার সুরেশ্বর থেকে লঞ্চে উঠেন। লঞ্চডুবির খবর পেয়ে গতকাল তাঁরা এসে লাশ শনাক্ত করেন। পরে সেখান থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সিরাজ দেওয়ানের কর্মস্থলে। রাত ৮টার দিকে ফতুল্লার পঞ্চবটি বিদ্যুৎ অফিসে তাঁর সহকর্মীরা লাশের জানাজা পড়েন। জানাজা শেষে দাফনের উদ্দেশ্যে শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার ঘড়িসার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। পঞ্চবটি ডিপিডিসির কর্মকর্তা আসাদুর রহমান জানান, নিহত সিরাজ দেওয়ান বিদ্যুৎ অফিসে ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় মেঘনা নদীতে লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। উদ্ধার অভিযান ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীও লঞ্চডুবিতে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন।
সংসদে শোক প্রকাশ : এ ছাড়া এ দুর্ঘটনায় জাতীয় সংসদে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণ পরই তিনি ওই দুর্ঘটনা সম্পর্কে সংসদকে জানান। স্পিকার বলেন, 'লঞ্চডুবিতে বেশকিছু মানুষ নিহত হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছে। সংসদ নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছে।'
ক্ষতিপূরণের আশ্বাস : মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তবে একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকলে ৪৫ হাজার টাকা করে পাবে।'
নৌপরিবহনমন্ত্রী দুপুর ২টার দিকে গজারিয়ার দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার ছাড়াও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আধা ঘণ্টা সেখানে উদ্ধারকাজ তদারকির পর ঢাকার দিকে রওনা হন মন্ত্রী। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এম ইদ্রিস আলী দুপুর আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে যান।
উঠবে কি লঞ্চটি : বিআইডাবি্লউটিএ সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌপথের দুর্ঘটনাকবলিত নৌযান উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে মাত্র দুটি সরকারি জাহাজ হামজা ও রুস্তম। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি থেকে হামজা আনা হয়। রুস্তম আমদানি হয় ১৯৮৩ সালে। দুটির উত্তোলনক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬০ টন করে মোট ১২০ টন। আর ডুবে যাওয়া শরীয়তপুরের ওজন প্রায় ২০০ টন। ফলে এর উদ্ধার নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
জাহাজ হামজার প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, জাহাজটির পাখা খুলে ফেলায় টাগবোটের 'টানা পদ্ধতি'তে এটিকে চালাতে হয়। কোথাও যেতে হলে হামজার দুই পাশে দুটি ছোট জাহাজ বেঁধে দেওয়া হয়। আর রুস্তমকে কোথাও নিতে হলে ব্যবহার করা হয় 'ঠেলা' পদ্ধতি_রুস্তমের পেছনে বেঁধে দেওয়া হয় আরেকটি জাহাজ 'অগ্রপথিক'। ওই অগ্রপথিক নিজে চলতে থাকে এবং ঠেলে নিয়ে যায় রুস্তমকে।
No comments