রাজনীতি-সংবিধানের সমালোচনা করলে চরম দণ্ড! by বদিউল আলম মজুমদার
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। বিরোধী দলের নেত্রীর এ বক্তব্যকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাষ্ট্রদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেন। একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, সংবিধান অনুসারে এ বক্তব্যের জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায়।
আমাদের বর্তমান সংবিধানের শুধু দুটি অনুচ্ছেদেই (৬৯ ও ৭ক) দণ্ডবিধির মতো শাস্তির বিধান রয়েছে, যার একটি ‘সম্ভাব্য’ মৃত্যুদণ্ড। তবে আমরা মনে করি যে যেহেতু ৭ক(৩) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি ‘প্রচলিত আইনের’ দ্বারা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে এবং আমাদের দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড, তাই ৭ক-এর অধীনে শাস্তির পরিমাণ সাত বছর কারাদণ্ডের বেশি নয়।
সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি নিন্দনীয়ও। তবে আওয়ামী লীগের রাস্তা দেখানোর পর ক্ষমতায় গেলে তাঁর দল সংবিধান নিয়ে কী খেলা খেলবে, তা হয়তো আমাদের কল্পনাকেও হার মানাবে! (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছেন, আওয়ামী লীগ তাঁদের ভবিষ্যতের কাজ সহজ করে দিয়েছে!) কিন্তু সংবিধান ছুড়ে ফেলার বর্তমান বক্তব্যের জন্য কি বেগম জিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে? সংবিধানের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে?
না, তা করা যাবে না। এটা সম্ভব নয়। প্রজাতন্ত্রের ‘মালিক’ হিসেবে নাগরিকেরা সংবিধান নিয়ে কথা বলতে পারবে না, তা হতেই পারে না। আর তা যদি হয় অর্থাৎ আমি যদি ভুল বলে প্রমাণিত হই, তাহলে বাংলাদেশে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা বলে আর কিছুই থাকবে না এবং আমরা একটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হব।
সংবিধানে নতুন সংযোজিত ৭ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়—(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। (২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত—(ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে—তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’
সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ প্রথম পাঠের পর আমারও মনে হয়েছে, এখন সংবিধান বা সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আর কথা বলা যাবে না। কারণ, তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহ। কারণ, ৭ক(১)(খ) অনুযায়ী, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ আর ৭ক(২)-তে যুক্ত করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এ কাজে ‘সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে’ কিংবা ‘কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে—তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।’
এ বিধান অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণকারী প্র্রতিবাদী নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি সংবিধান ও সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলে কিংবা সমালোচনামূলক উপসম্পাদকীয় ছাপলে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও তা প্রয়োগ করা যাবে। সংবিধানের সমালোচনার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দেশদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে, যেমনিভাবে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে তা ব্যবহারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ৭ক অনুচ্ছেদ আমাদের ৬০ বছর পেছনে নিয়ে যাবে এবং ভাষা আন্দোলনের সময়কার মতো জনগণকে সংগঠিত করার জন্য আবারও আমাদের সম্মিলিতভাবে কণ্ঠ ধরতে হবে: ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়...’।
প্রসঙ্গত, আমাদের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদ মূলত জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে প্রণীত পাকিস্তানের ১৯৭৩ সালের সংবিধান থেকে ধার করা। পাকিস্তানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘(১) যদি কোনো ব্যক্তি সংবিধানকে ক্ষমতাবলে বাতিল করে, পরিবর্তন করে, অথবা জোর করে বা শক্তি প্রদর্শন করে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করে, সে ব্যক্তি চরম দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে। (২) কোনো ব্যক্তি (১) ধারায় উল্লেখিত কার্যক্রমের সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলে, সে ব্যক্তিও একইভাবে চরম দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে। (৩) সংসদ আইনের মাধ্যমে চরম দেশদ্রোহীদের শাস্তি নির্ধারণ করবে।’
লক্ষণীয় যে পাকিস্তানের ৬ অনুচ্ছেদে আমাদের ৭ক(১)-এ অন্তর্ভুক্ত উপ-উপধারা (খ) নেই। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কিংবা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করাকেও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করার বিধান পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এর উদ্দেশ্য কি বিরোধী দল কিংবা সচেতন নাগরিক সমাজ যাতে পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা না করতে পারে তা নিশ্চিত করা? বেগম খালেদা জিয়াকে ‘সংবিধান অনুযায়ী’ রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে শাস্তি দেওয়ার হুমকি এ সন্দেহকেই ঘনীভূত করে।
তাই ৭ক অনুচ্ছেদ আরও গভীরভাবে আবার আমি পড়ি, বিশেষত পৃথকভাবে ৭(১)(খ) উপ-উপ-অনুচ্ছেদ। পৃথকভাবে ৭(১)(খ) উপ-উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়— ... (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ এ কাজে ‘সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলে, সে ব্যক্তিও একইভাবে চরম দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে।’ অর্থাৎ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বা অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদের প্রতি নাগরিকের অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করলে বা সে লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করলে এবং এ কাজে সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলেই শুধু রাষ্ট্রদ্রোহের বিধান প্রযোজ্য হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এ বিধানের কার্যকারিতার জন্য শক্তি প্রয়োগ হতে হবে।
৭ক অনুচ্ছেদ একাধিকবার পড়ার পর আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ‘আফটার দি ফ্যাক্ট’ বা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই ৭ক(১)(খ)-এর বিধান প্রযোজ্য হবে। তবে তার সম্ভাবনা কি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায়?
আমাদের আশঙ্কা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আবারও ভেঙে পড়তে পারে। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ভবিষ্যতে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে, যা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করবে। আর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল হলেই সংবিধান বাতিল বা স্থগিতের প্রশ্ন উঠবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই পরবর্তী সময়ে যেকোনো প্রতিবাদী নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের অতীতের প্রতিবাদের জন্য ৭ক অনুচ্ছেদ অতি সহজেই ব্যবহার করা যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও এ অনুচ্ছেদ ব্যবহূত হতে পারে, যেমনিভাবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তাঁদের সময়কার করা ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনের’ অধীনে বছরের পর বছর জেল খেটেছিলেন। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিবিদেরা এখন দায়িত্বশীল আচরণ না করলে ৭ক অনুচ্ছেদ নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার প্রতি ভবিষ্যতে চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও তিনি সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির উপ-প্রধান ছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত অনেকে কিছুর সঙ্গে একমত হতে পারেননি বলে তিনি সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। ‘সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র কাছে লিখিত তাঁর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পড়ে গর্ববোধ করেছিলাম, যা নিয়ে আমি সংবাদপত্রে কলামও লিখেছিলাম। সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত না হলেও তাঁর নৈতিক অবস্থানের জন্য তিনি অনেকেরই শ্রদ্ধার পাত্র। তাই বেগম জিয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহের হুমকি দেওয়ার মতো সস্তা ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য তাঁর কাছ থেকে আশা করিনি। তাঁর জানার কথা যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কারও ক্ষমতা দখলের আগে সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না।
পরিশেষে, প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে ভবিষ্যতে অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে পাকিস্তানের ১৯৭৩ সালের সংবিধানের এ ধরনের বিধান জেনারেল জিয়াউল হক ও পরবর্তী সময়ে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান রোধ করতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানে অবৈধ ক্ষমতা দখল রোধ করা সম্ভব হয়েছে নওয়াজ শরিফ ও প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর মধ্যকার সমঝোতা ও ২০০৬ সালে তাঁদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ডেমোক্রেসি চার্টার’-এর কারণে। এ সমঝোতার ফলে তাঁরা নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসান এবং নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষের আগে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর অপসংস্কৃতি পরিহার করতে পেরেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক কালে তাঁরা পাকিস্তানের সংবিধানের অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ সংশোধনী সর্বসম্মতভাবে পাস করে পাকিস্তানের ‘ইম্পেরিয়াল’ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য এনেছেন এবং বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন।
কিন্তু আমাদের সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছে একতরফাভাবে, বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে এই সংশোধনী চরম অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি নিন্দনীয়ও। তবে আওয়ামী লীগের রাস্তা দেখানোর পর ক্ষমতায় গেলে তাঁর দল সংবিধান নিয়ে কী খেলা খেলবে, তা হয়তো আমাদের কল্পনাকেও হার মানাবে! (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছেন, আওয়ামী লীগ তাঁদের ভবিষ্যতের কাজ সহজ করে দিয়েছে!) কিন্তু সংবিধান ছুড়ে ফেলার বর্তমান বক্তব্যের জন্য কি বেগম জিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে? সংবিধানের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে?
না, তা করা যাবে না। এটা সম্ভব নয়। প্রজাতন্ত্রের ‘মালিক’ হিসেবে নাগরিকেরা সংবিধান নিয়ে কথা বলতে পারবে না, তা হতেই পারে না। আর তা যদি হয় অর্থাৎ আমি যদি ভুল বলে প্রমাণিত হই, তাহলে বাংলাদেশে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা বলে আর কিছুই থাকবে না এবং আমরা একটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হব।
সংবিধানে নতুন সংযোজিত ৭ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়—(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। (২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত—(ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে—তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’
সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ প্রথম পাঠের পর আমারও মনে হয়েছে, এখন সংবিধান বা সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আর কথা বলা যাবে না। কারণ, তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহ। কারণ, ৭ক(১)(খ) অনুযায়ী, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ আর ৭ক(২)-তে যুক্ত করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এ কাজে ‘সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে’ কিংবা ‘কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে—তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।’
এ বিধান অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণকারী প্র্রতিবাদী নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি সংবিধান ও সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলে কিংবা সমালোচনামূলক উপসম্পাদকীয় ছাপলে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও তা প্রয়োগ করা যাবে। সংবিধানের সমালোচনার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দেশদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে, যেমনিভাবে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে তা ব্যবহারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ৭ক অনুচ্ছেদ আমাদের ৬০ বছর পেছনে নিয়ে যাবে এবং ভাষা আন্দোলনের সময়কার মতো জনগণকে সংগঠিত করার জন্য আবারও আমাদের সম্মিলিতভাবে কণ্ঠ ধরতে হবে: ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়...’।
প্রসঙ্গত, আমাদের নতুন ৭ক অনুচ্ছেদ মূলত জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে প্রণীত পাকিস্তানের ১৯৭৩ সালের সংবিধান থেকে ধার করা। পাকিস্তানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘(১) যদি কোনো ব্যক্তি সংবিধানকে ক্ষমতাবলে বাতিল করে, পরিবর্তন করে, অথবা জোর করে বা শক্তি প্রদর্শন করে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করে, সে ব্যক্তি চরম দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে। (২) কোনো ব্যক্তি (১) ধারায় উল্লেখিত কার্যক্রমের সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলে, সে ব্যক্তিও একইভাবে চরম দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে। (৩) সংসদ আইনের মাধ্যমে চরম দেশদ্রোহীদের শাস্তি নির্ধারণ করবে।’
লক্ষণীয় যে পাকিস্তানের ৬ অনুচ্ছেদে আমাদের ৭ক(১)-এ অন্তর্ভুক্ত উপ-উপধারা (খ) নেই। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কিংবা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করাকেও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করার বিধান পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এর উদ্দেশ্য কি বিরোধী দল কিংবা সচেতন নাগরিক সমাজ যাতে পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা না করতে পারে তা নিশ্চিত করা? বেগম খালেদা জিয়াকে ‘সংবিধান অনুযায়ী’ রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে শাস্তি দেওয়ার হুমকি এ সন্দেহকেই ঘনীভূত করে।
তাই ৭ক অনুচ্ছেদ আরও গভীরভাবে আবার আমি পড়ি, বিশেষত পৃথকভাবে ৭(১)(খ) উপ-উপ-অনুচ্ছেদ। পৃথকভাবে ৭(১)(খ) উপ-উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়— ... (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ এ কাজে ‘সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলে, সে ব্যক্তিও একইভাবে চরম দেশদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হবে।’ অর্থাৎ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বা অসাংবিধানিক পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদের প্রতি নাগরিকের অনাস্থা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করলে বা সে লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করলে এবং এ কাজে সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করলেই শুধু রাষ্ট্রদ্রোহের বিধান প্রযোজ্য হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এ বিধানের কার্যকারিতার জন্য শক্তি প্রয়োগ হতে হবে।
৭ক অনুচ্ছেদ একাধিকবার পড়ার পর আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ‘আফটার দি ফ্যাক্ট’ বা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই ৭ক(১)(খ)-এর বিধান প্রযোজ্য হবে। তবে তার সম্ভাবনা কি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায়?
আমাদের আশঙ্কা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আবারও ভেঙে পড়তে পারে। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ভবিষ্যতে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে, যা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করবে। আর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল হলেই সংবিধান বাতিল বা স্থগিতের প্রশ্ন উঠবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই পরবর্তী সময়ে যেকোনো প্রতিবাদী নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের অতীতের প্রতিবাদের জন্য ৭ক অনুচ্ছেদ অতি সহজেই ব্যবহার করা যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও এ অনুচ্ছেদ ব্যবহূত হতে পারে, যেমনিভাবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তাঁদের সময়কার করা ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনের’ অধীনে বছরের পর বছর জেল খেটেছিলেন। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিবিদেরা এখন দায়িত্বশীল আচরণ না করলে ৭ক অনুচ্ছেদ নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার প্রতি ভবিষ্যতে চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও তিনি সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির উপ-প্রধান ছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত অনেকে কিছুর সঙ্গে একমত হতে পারেননি বলে তিনি সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। ‘সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র কাছে লিখিত তাঁর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পড়ে গর্ববোধ করেছিলাম, যা নিয়ে আমি সংবাদপত্রে কলামও লিখেছিলাম। সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত না হলেও তাঁর নৈতিক অবস্থানের জন্য তিনি অনেকেরই শ্রদ্ধার পাত্র। তাই বেগম জিয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহের হুমকি দেওয়ার মতো সস্তা ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য তাঁর কাছ থেকে আশা করিনি। তাঁর জানার কথা যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কারও ক্ষমতা দখলের আগে সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না।
পরিশেষে, প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে ভবিষ্যতে অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে পাকিস্তানের ১৯৭৩ সালের সংবিধানের এ ধরনের বিধান জেনারেল জিয়াউল হক ও পরবর্তী সময়ে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান রোধ করতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানে অবৈধ ক্ষমতা দখল রোধ করা সম্ভব হয়েছে নওয়াজ শরিফ ও প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর মধ্যকার সমঝোতা ও ২০০৬ সালে তাঁদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ডেমোক্রেসি চার্টার’-এর কারণে। এ সমঝোতার ফলে তাঁরা নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসান এবং নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষের আগে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর অপসংস্কৃতি পরিহার করতে পেরেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক কালে তাঁরা পাকিস্তানের সংবিধানের অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ সংশোধনী সর্বসম্মতভাবে পাস করে পাকিস্তানের ‘ইম্পেরিয়াল’ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য এনেছেন এবং বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন।
কিন্তু আমাদের সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছে একতরফাভাবে, বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে এই সংশোধনী চরম অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments