গদ্যকার্টুন-চক্ষু বিভাগে আরও চর্ম চিকি ৎ সক চাই by আনিসুল হক
প্রথম আলোয় কেন এ খবরটা (১৭ জুলাই ২০১১) প্রকাশিত হলো, আমাদের মাথায় ঢুকছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগে পাঠানো হয়েছে একজন চর্ম চিকি ৎ সককে। এটা কেন একটা ‘খবর’ হবে? আমরা সাংবাদিকতার পাঠ্যবইয়ে পড়েছি, কুকুর মানুষকে কামড়ালে খবর হয় না, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে খবর হয়।
চক্ষু বিভাগে চক্ষু চিকি ৎ সককে পাঠালে অবশ্যই খবর হতো না। কিন্তু চর্ম চিকি ৎ সককে পাঠালে কেন সেটা খবর হবে?
প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরটিতে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। চক্ষু বিভাগে রোগীরা আসেন চোখের সমস্যা নিয়ে, সেখানে চর্ম চিকি ৎ সক থাকলে নাকি অসুবিধা হয়। শুধু চর্ম চিকি ৎ সক নয়, প্যাথলজি বিশেষজ্ঞও একজন আছেন চক্ষু বিভাগে। আর চর্ম চিকি ৎ সক যাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন, অর্থা ৎ এর আগে ওই পদে যিনি ছিলেন, তিনি আবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।
খবরের বর্ণনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ঢাকায় পোস্টিংয়ের জন্য ব্যাপক তদবির, চাহিদা, চাপের মুখে এ ধরনের গোঁজামিলের নিয়োগ চলে আসছে। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেছেন, এক বিভাগের চিকি ৎ সক অন্য বিভাগে নিয়োগ পেতে পারেন না। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে দ্রুত সংশোধন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু আমাদের, আমরা যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে থাকি, তাদের কাছে কিন্তু কোনো ভুল চোখে পড়ছে না, সংশোধনেরও কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা বরং বলি, চক্ষু বিভাগে বেশি করে চর্ম চিকি ৎ সক নিয়োগ দেওয়া হোক।
কেন আমরা এটা চাইছি?
কারণ, বাংলা প্রবাদ আছে—চোখের চামড়া নেই, মানে হলো, চক্ষুলজ্জা নেই, লাজ-শরমের বালাই নেই। আর যার চোখের চামড়া আছে, তার কিছু লাজলজ্জা আছে। কিছু বলার আগে, করার আগে সে সাতপাঁচ ভাববে, এমন কিছু করবে না, যাতে তাকে লজ্জায় ডুবতে হয়।
কাজেই চোখে চামড়া থাকা খুবই জরুরি।
আর চোখে যাতে সবারই চামড়া থাকে, সে ব্যাপারে চক্ষু বিভাগ অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু চক্ষু বিভাগকে যদি ব্যবস্থা নিতে হয়, তাহলে অবশ্যই চর্ম বিশেষজ্ঞের দরকার পড়বে।
চক্ষু বিভাগে যখন কোনো রোগী আসবে, তখন প্রথমেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তার চোখে চামড়া আছে নাকি নেই। নানাভাবে এটা পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন—তিনি যদি সরকারি কর্মচারী হন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, ‘জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে খরচ তো কুলানো যায় না। কী বলেন?’
তিনি বলবেন, ‘আর বলবেন না, জিনিসপত্রের দাম খুবই বেড়ে গেছে।’
‘বেতনের টাকায় তো এক সপ্তাহ চলে না। কী বলেন?’
‘আরে, কী বলেন এক সপ্তাহ! আমার তো তিন দিনও যায় না।’
‘তাহলে আপনার মাসের বাকি ২৭ দিন কীভাবে যায়? এক্সট্রা ইনকাম-টিনকাম আছে তো?’
তখন তাঁর চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। পাতা কাঁপছে নাকি কাঁপছে না। তিনি কি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলছেন, ‘আরে, কিছু এক্সট্রা না থাকলে কি চলে?’ নাকি বুক উঁচু করে বলছেন, ‘আরে, আমার ঢাকায় তিনটা বাড়ি আছে, শুধু ভাড়া থেকেই যা আসে, তাতেই চলে যায়।’
আমাদের চোখের চামড়া বড় দরকার। আমাদের দেশে কোনো পুরস্কার কমিটির প্রধান তাঁর স্ত্রীকে কিংবা সন্তানকে, কিংবা মামাকে, কিংবা দাদাকেই এই পুরস্কারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করে থাকেন। কেউ কেউ আবার নিজেকেই ওই পুরস্কারের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটি বলে ঘোষণা করে ফেলেন। সেই যে কৌতুক আছে, একটা খাবার দুই ভাগে ভাগ করতে হবে, কারণ, খাবে দুই বন্ধু। যে ভাগ করল, সে-ই বড় টুকরাটা নিয়ে নিল। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, ‘এটা তুই কী করলি? নিজেই ভাগ করলি আবার নিজেই বড় টুকরাটা নিয়ে নিলি!’ প্রথম বন্ধু বলল, ‘তুই হলে কী করতি?’ দ্বিতীয় বন্ধু জবাব দিল, ‘আমার চোখের চামড়া আছে, আমি ছোট টুকরাটা নিতাম।’ প্রথম বন্ধু বলল, ‘আমিও তো তা-ই করলাম। তোকে তো ছোট টুকরাই দিলাম।’
চোখের চামড়া থাকা দরকার আমাদের সবার। আমরা নিজেদের পত্রিকায় নিজেদের বড় ছবি ছাপি, নিজেদের টিভির খবরে নিজেদের বারবার দেখাই, নিজেরা আইন প্রণয়ন করে নিজেদের বেতন বৃদ্ধি করি, প্লট বরাদ্দের দায়িত্ব পেয়ে নিজেদের নামে আগে প্লটটা নিয়ে নিই, দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করব বলে প্রচার করতে পারি, কিন্তু নিজের দখলে থাকা সরকারি বাড়িটা, জমিটা ছাড়তে চাই না, বরং সেটা নিজের নামে চিরস্থায়ীভাবে লিখে নিতে চাই। নিজেদের নামে সরকারি স্কুল-কলেজের নামকরণ করে সেটা আবার নিজেই উদ্বোধন করতে যাই। এবং তারপর আমরা বলে থাকি: ‘আমি আবার একটু প্রচারবিমুখ।’ বলে থাকি, ‘আমার কোনো অহংকার নেই, এই যে আমি এত বড় শিল্পী, এ নিয়ে আমি কোনো অহংকার করি না।’ একটা বড় কিছু অর্জন করার পর নিজেই বলে থাকি, ‘এটা কেবল আমার মুখ উজ্জ্বল করবে না, এটা জাতির মুখোজ্জ্বল করবে।’ জাতিকে ওই কথাটা বলার সুযোগও আমরা দিই না।
অথচ চোখের চামড়া ছিল নিউটনের, আমরা গল্প শুনি। নিউটন নাকি বলেছিলেন, তিনি জ্ঞানসমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নুড়ি কুড়াচ্ছেন মাত্র। আর সক্রেটিস? তিনি বলতেন, তিনি কিছুই জানেন না। আর আমরা? আমরা সবকিছু জানি। সর্ববিষয়ে আমরা পণ্ডিত। আমরা বিশেষজ্ঞ নই, এমন কোনো বিষয় এখনো এই ধরণীতে জন্ম নেয়নি।
কাজেই আমাদের চোখের চামড়া দরকার। যেটুকু চামড়া জন্মগতভাবে আমরা লাভ করি, আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে তা আমরা হারিয়ে ফেলি। চক্ষু বিভাগের চর্ম চিকি ৎ সক আমাদের সেই হারানো চামড়া ফিরিয়ে দিতে যদি পারেন, তাহলে না একটা কাজের কাজ হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরটিতে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। চক্ষু বিভাগে রোগীরা আসেন চোখের সমস্যা নিয়ে, সেখানে চর্ম চিকি ৎ সক থাকলে নাকি অসুবিধা হয়। শুধু চর্ম চিকি ৎ সক নয়, প্যাথলজি বিশেষজ্ঞও একজন আছেন চক্ষু বিভাগে। আর চর্ম চিকি ৎ সক যাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন, অর্থা ৎ এর আগে ওই পদে যিনি ছিলেন, তিনি আবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।
খবরের বর্ণনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ঢাকায় পোস্টিংয়ের জন্য ব্যাপক তদবির, চাহিদা, চাপের মুখে এ ধরনের গোঁজামিলের নিয়োগ চলে আসছে। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেছেন, এক বিভাগের চিকি ৎ সক অন্য বিভাগে নিয়োগ পেতে পারেন না। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে দ্রুত সংশোধন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু আমাদের, আমরা যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে থাকি, তাদের কাছে কিন্তু কোনো ভুল চোখে পড়ছে না, সংশোধনেরও কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা বরং বলি, চক্ষু বিভাগে বেশি করে চর্ম চিকি ৎ সক নিয়োগ দেওয়া হোক।
কেন আমরা এটা চাইছি?
কারণ, বাংলা প্রবাদ আছে—চোখের চামড়া নেই, মানে হলো, চক্ষুলজ্জা নেই, লাজ-শরমের বালাই নেই। আর যার চোখের চামড়া আছে, তার কিছু লাজলজ্জা আছে। কিছু বলার আগে, করার আগে সে সাতপাঁচ ভাববে, এমন কিছু করবে না, যাতে তাকে লজ্জায় ডুবতে হয়।
কাজেই চোখে চামড়া থাকা খুবই জরুরি।
আর চোখে যাতে সবারই চামড়া থাকে, সে ব্যাপারে চক্ষু বিভাগ অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু চক্ষু বিভাগকে যদি ব্যবস্থা নিতে হয়, তাহলে অবশ্যই চর্ম বিশেষজ্ঞের দরকার পড়বে।
চক্ষু বিভাগে যখন কোনো রোগী আসবে, তখন প্রথমেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তার চোখে চামড়া আছে নাকি নেই। নানাভাবে এটা পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন—তিনি যদি সরকারি কর্মচারী হন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, ‘জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে খরচ তো কুলানো যায় না। কী বলেন?’
তিনি বলবেন, ‘আর বলবেন না, জিনিসপত্রের দাম খুবই বেড়ে গেছে।’
‘বেতনের টাকায় তো এক সপ্তাহ চলে না। কী বলেন?’
‘আরে, কী বলেন এক সপ্তাহ! আমার তো তিন দিনও যায় না।’
‘তাহলে আপনার মাসের বাকি ২৭ দিন কীভাবে যায়? এক্সট্রা ইনকাম-টিনকাম আছে তো?’
তখন তাঁর চোখের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। পাতা কাঁপছে নাকি কাঁপছে না। তিনি কি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলছেন, ‘আরে, কিছু এক্সট্রা না থাকলে কি চলে?’ নাকি বুক উঁচু করে বলছেন, ‘আরে, আমার ঢাকায় তিনটা বাড়ি আছে, শুধু ভাড়া থেকেই যা আসে, তাতেই চলে যায়।’
আমাদের চোখের চামড়া বড় দরকার। আমাদের দেশে কোনো পুরস্কার কমিটির প্রধান তাঁর স্ত্রীকে কিংবা সন্তানকে, কিংবা মামাকে, কিংবা দাদাকেই এই পুরস্কারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করে থাকেন। কেউ কেউ আবার নিজেকেই ওই পুরস্কারের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটি বলে ঘোষণা করে ফেলেন। সেই যে কৌতুক আছে, একটা খাবার দুই ভাগে ভাগ করতে হবে, কারণ, খাবে দুই বন্ধু। যে ভাগ করল, সে-ই বড় টুকরাটা নিয়ে নিল। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, ‘এটা তুই কী করলি? নিজেই ভাগ করলি আবার নিজেই বড় টুকরাটা নিয়ে নিলি!’ প্রথম বন্ধু বলল, ‘তুই হলে কী করতি?’ দ্বিতীয় বন্ধু জবাব দিল, ‘আমার চোখের চামড়া আছে, আমি ছোট টুকরাটা নিতাম।’ প্রথম বন্ধু বলল, ‘আমিও তো তা-ই করলাম। তোকে তো ছোট টুকরাই দিলাম।’
চোখের চামড়া থাকা দরকার আমাদের সবার। আমরা নিজেদের পত্রিকায় নিজেদের বড় ছবি ছাপি, নিজেদের টিভির খবরে নিজেদের বারবার দেখাই, নিজেরা আইন প্রণয়ন করে নিজেদের বেতন বৃদ্ধি করি, প্লট বরাদ্দের দায়িত্ব পেয়ে নিজেদের নামে আগে প্লটটা নিয়ে নিই, দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করব বলে প্রচার করতে পারি, কিন্তু নিজের দখলে থাকা সরকারি বাড়িটা, জমিটা ছাড়তে চাই না, বরং সেটা নিজের নামে চিরস্থায়ীভাবে লিখে নিতে চাই। নিজেদের নামে সরকারি স্কুল-কলেজের নামকরণ করে সেটা আবার নিজেই উদ্বোধন করতে যাই। এবং তারপর আমরা বলে থাকি: ‘আমি আবার একটু প্রচারবিমুখ।’ বলে থাকি, ‘আমার কোনো অহংকার নেই, এই যে আমি এত বড় শিল্পী, এ নিয়ে আমি কোনো অহংকার করি না।’ একটা বড় কিছু অর্জন করার পর নিজেই বলে থাকি, ‘এটা কেবল আমার মুখ উজ্জ্বল করবে না, এটা জাতির মুখোজ্জ্বল করবে।’ জাতিকে ওই কথাটা বলার সুযোগও আমরা দিই না।
অথচ চোখের চামড়া ছিল নিউটনের, আমরা গল্প শুনি। নিউটন নাকি বলেছিলেন, তিনি জ্ঞানসমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নুড়ি কুড়াচ্ছেন মাত্র। আর সক্রেটিস? তিনি বলতেন, তিনি কিছুই জানেন না। আর আমরা? আমরা সবকিছু জানি। সর্ববিষয়ে আমরা পণ্ডিত। আমরা বিশেষজ্ঞ নই, এমন কোনো বিষয় এখনো এই ধরণীতে জন্ম নেয়নি।
কাজেই আমাদের চোখের চামড়া দরকার। যেটুকু চামড়া জন্মগতভাবে আমরা লাভ করি, আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে তা আমরা হারিয়ে ফেলি। চক্ষু বিভাগের চর্ম চিকি ৎ সক আমাদের সেই হারানো চামড়া ফিরিয়ে দিতে যদি পারেন, তাহলে না একটা কাজের কাজ হয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments