প্রতিক্রিয়া-রহস্য নয়, পরিকল্পিতই by মহিউদ্দিন আহমদ
গত ১১ জুলাই সোমবার, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড—একটি জনপ্রিয় পত্রিকার হত্যারহস্য’ শিরোনামে প্রকাশিত জনাব মশিউল আলমের লেখাটি হয়তো আগে লেখা হয়েছে বলে তার পরের কয়েক দিনের দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যাশিতভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তাই এ প্রতিক্রিয়াটি লিখতে প্রলুব্ধ হয়েছি।
‘নিউজ করপোরেশন’ নামের রুপার্ট মারডকের হোল্ডিং কোম্পানিটির একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ‘নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’ তাঁর ব্রিটিশ পত্রপত্রিকাগুলোর দেখভাল করে। এই নিউজ ইন্টারন্যাশনালের প্রধান হলেন তাঁর ছেলে জেমস মারডক। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বন্ধ করে দেওয়ার পরও এই লল্ডনেই তাঁর আরও তিনটি পত্রিকা আছে—লন্ডন টাইমস, সানডে টাইমস ও দ্য সান। লন্ডন টাইমস ছিল দুনিয়ার খানদানি পাঁচ-দশটি দৈনিক পত্রিকার একটি। ‘দ্য থানডারার’ নামেও এ পত্রিকাটির খ্যাতি ছিল। পত্রিকাটি সম্পর্কে আরও বলা হতো, হোয়েন দ্য টাইমস স্পিকস, দ্য ওয়ার্ল্ড লিসেন্স। বছর তিরিশেক আগে রুপার্ট মারডকের হাতে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই ব্রিটিশ পত্রিকাটির এখন বেহাল দশা। সানডে টাইমসও একটি প্রভাবশালী পত্রিকা, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ পত্রিকাটি আমাদের প্রবল সমর্থন দিয়েছিল। দ্য সান একটি ট্যাবলয়েড দৈনিক; ট্যাবলয়েড পত্রিকার যা চরিত্র, অপরাধ, যৌনতা, চাঞ্চল্যকর বিষয়—নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর মতো আর সবই আছে বিপুল-বিশাল সার্কুলেশনবিশিষ্ট এই পত্রিকারও।
৪৫ বছর পর আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি যখন লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের থার্ড সেক্রেটারি, এক রোববার সকাল ১০টার দিকে সেন্ট্রাল লন্ডনে আমার বাসার সামনে একটি স্টোরে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড কিনতে গিয়েছিলাম। মাঝবয়সী স্টোরমালিক আমাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনাকে যদি নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়তে হয়, তাহলে আপনাকে সকালে ১০টা পর্যন্ত ঘুম ছাড়তে হবে; আর যদি ঘুম ছাড়তে না পারেন, তাহলে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়ার আনন্দ ও উত্তেজনা ছাড়তে হবে।’
রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতেও বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রে আছে তাঁর ‘ফক্স নিউজ’ চ্যানেল, অন্য তিনটি জাতীয় চ্যানেল হচ্ছে, সিবিএস (কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম), এনবিসি (ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি) এবং এবিসি (আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি)। রুপার্ট মারডক ৮০ বছর বয়সেও একজন দক্ষ মিডিয়া ব্যবসায়ী। তাই তিনি অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় চ্যানেলের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে তাঁর ‘ফক্স নিউজ’-এরও একটি বড় দর্শকশ্রেণী সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তবে এ চ্যানেলটি কট্টর ডানপন্থী, ইসলাম, মুসলমান ও ফিলিস্তিনিবিরোধী। আমেরিকার আরেকটি খানদানি দৈনিক, নিউইয়র্ক শহর থেকে প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকাটিও তিনি কয়েক বছর আগে কিনে নিয়েছেন।
এত বড় মিডিয়া সাম্রাজ্যের মালিক রুপার্ট মারডকের অনুগ্রহ সমাজের; বিশেষ করে, রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেকেই প্রত্যাশা করেন; অনুগ্রহ দিয়ে তিনি অনেককে সিক্তও করেছেন। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাঁদের একজন। কিন্তু এই ক্যামেরনরাও এখন রুপার্ট মারডককে আর রক্ষা করতে পারছেন না। ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে দু-দুটো আলাদা কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিশন ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টিভিতে স ৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এখন কতটুকু অনুসৃত হচ্ছে, শুধু তা খতিয়ে দেখবে।
এই পটভূমিতে এই ব্রিটিশ-ঝড় বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের কিছু মানুষ পত্রিকার মালিকানার অপব্যবহার করে যে নোংরামি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে তাঁদের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত এজেন্ডা অর্জিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সাংবাদিকতার মহান পেশাটি কলুষিতও হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশে যা কিছু গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এখনো আছে, তা আছে মূলত আমাদের কিছু পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর জন্যই। জাতীয় সংসদে সাংসদদের ভূমিকা এখানে গৌণ। আমাদের সংক্ষুব্ধ নাগরিকেরা প্রতিকার চাইতে এখনো সাংবাদিককেই খোঁজেন, কোনো জাতীয় সংসদ সদস্য বা নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নয়। জনমানুষের সমস্যা নিয়ে আমাদের সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক হয় না।
অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এখন পত্রিকার মালিক হচ্ছেন। আর তাঁদের দস্যুতা, লুণ্ঠনকে জায়েজ করার জন্য তাঁদের পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ব্যবহারও করছেন। তাঁদের লুণ্ঠন ও অপকর্ম কেউ উন্মোচন করলে, তার ওপর শ্রেণীর এই পত্রিকা-ব্যবসায়ীরা সেই উন্মোচনকারীর ওপর হামলেও পড়ছেন।
নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডকে ‘হত্যা’ করে কোনো অন্যায় কাজ করেননি কেউ; বরং রুপার্ট ও জেমস্ মারডকরা এখন বাঁচতে চাইছেন পত্রিকাটি ‘হত্যা’ করে। এই কেলেঙ্কারির পেছনে এই দুই মারডকেরও কোনো হাত বা সমর্থন ছিল কি না, তা-ও এখন একটি বড় প্রশ্ন। পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা ছিল, পাঠকসংখ্যা ছিল, কিন্তু ছিল না কোনো সম্মান; যেমন আছে লন্ডনেরগার্ডিয়ান-এর। একটি মন্দ কাগজকে বন্ধ করে দিয়ে মারডকরা এখন তাঁদের অন্য সব ব্যবসা বাঁচাতে চাইছেন। এখানে কোনো রহস্য নেই, কোনো অন্যায় হয়নি।
ঘটনাপ্রবাহ যেমন দ্রুত পরিবর্তনশীল, তাতে কোথাকার পানি গড়িয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়, তা-ই বরং একটি বড় প্রশ্ন এখন। বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদপত্রের মালিক তাঁদের এই মালিকানা ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করছেন বলে তাঁরা মারডকদের কাছে অনেক কিছু শিক্ষা নিয়ে স ৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় দেরিতে হলেও এখন ফিরে আসতে পারেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কলাম লেখক।
৪৫ বছর পর আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি যখন লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের থার্ড সেক্রেটারি, এক রোববার সকাল ১০টার দিকে সেন্ট্রাল লন্ডনে আমার বাসার সামনে একটি স্টোরে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড কিনতে গিয়েছিলাম। মাঝবয়সী স্টোরমালিক আমাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনাকে যদি নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়তে হয়, তাহলে আপনাকে সকালে ১০টা পর্যন্ত ঘুম ছাড়তে হবে; আর যদি ঘুম ছাড়তে না পারেন, তাহলে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়ার আনন্দ ও উত্তেজনা ছাড়তে হবে।’
রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতেও বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রে আছে তাঁর ‘ফক্স নিউজ’ চ্যানেল, অন্য তিনটি জাতীয় চ্যানেল হচ্ছে, সিবিএস (কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম), এনবিসি (ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি) এবং এবিসি (আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি)। রুপার্ট মারডক ৮০ বছর বয়সেও একজন দক্ষ মিডিয়া ব্যবসায়ী। তাই তিনি অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় চ্যানেলের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে তাঁর ‘ফক্স নিউজ’-এরও একটি বড় দর্শকশ্রেণী সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তবে এ চ্যানেলটি কট্টর ডানপন্থী, ইসলাম, মুসলমান ও ফিলিস্তিনিবিরোধী। আমেরিকার আরেকটি খানদানি দৈনিক, নিউইয়র্ক শহর থেকে প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকাটিও তিনি কয়েক বছর আগে কিনে নিয়েছেন।
এত বড় মিডিয়া সাম্রাজ্যের মালিক রুপার্ট মারডকের অনুগ্রহ সমাজের; বিশেষ করে, রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেকেই প্রত্যাশা করেন; অনুগ্রহ দিয়ে তিনি অনেককে সিক্তও করেছেন। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাঁদের একজন। কিন্তু এই ক্যামেরনরাও এখন রুপার্ট মারডককে আর রক্ষা করতে পারছেন না। ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে দু-দুটো আলাদা কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিশন ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টিভিতে স ৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এখন কতটুকু অনুসৃত হচ্ছে, শুধু তা খতিয়ে দেখবে।
এই পটভূমিতে এই ব্রিটিশ-ঝড় বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের কিছু মানুষ পত্রিকার মালিকানার অপব্যবহার করে যে নোংরামি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে তাঁদের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত এজেন্ডা অর্জিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সাংবাদিকতার মহান পেশাটি কলুষিতও হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশে যা কিছু গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এখনো আছে, তা আছে মূলত আমাদের কিছু পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর জন্যই। জাতীয় সংসদে সাংসদদের ভূমিকা এখানে গৌণ। আমাদের সংক্ষুব্ধ নাগরিকেরা প্রতিকার চাইতে এখনো সাংবাদিককেই খোঁজেন, কোনো জাতীয় সংসদ সদস্য বা নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নয়। জনমানুষের সমস্যা নিয়ে আমাদের সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক হয় না।
অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এখন পত্রিকার মালিক হচ্ছেন। আর তাঁদের দস্যুতা, লুণ্ঠনকে জায়েজ করার জন্য তাঁদের পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ব্যবহারও করছেন। তাঁদের লুণ্ঠন ও অপকর্ম কেউ উন্মোচন করলে, তার ওপর শ্রেণীর এই পত্রিকা-ব্যবসায়ীরা সেই উন্মোচনকারীর ওপর হামলেও পড়ছেন।
নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডকে ‘হত্যা’ করে কোনো অন্যায় কাজ করেননি কেউ; বরং রুপার্ট ও জেমস্ মারডকরা এখন বাঁচতে চাইছেন পত্রিকাটি ‘হত্যা’ করে। এই কেলেঙ্কারির পেছনে এই দুই মারডকেরও কোনো হাত বা সমর্থন ছিল কি না, তা-ও এখন একটি বড় প্রশ্ন। পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা ছিল, পাঠকসংখ্যা ছিল, কিন্তু ছিল না কোনো সম্মান; যেমন আছে লন্ডনেরগার্ডিয়ান-এর। একটি মন্দ কাগজকে বন্ধ করে দিয়ে মারডকরা এখন তাঁদের অন্য সব ব্যবসা বাঁচাতে চাইছেন। এখানে কোনো রহস্য নেই, কোনো অন্যায় হয়নি।
ঘটনাপ্রবাহ যেমন দ্রুত পরিবর্তনশীল, তাতে কোথাকার পানি গড়িয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়, তা-ই বরং একটি বড় প্রশ্ন এখন। বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদপত্রের মালিক তাঁদের এই মালিকানা ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করছেন বলে তাঁরা মারডকদের কাছে অনেক কিছু শিক্ষা নিয়ে স ৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় দেরিতে হলেও এখন ফিরে আসতে পারেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কলাম লেখক।
No comments