শ্রদ্ধাঞ্জলি-চলে গেলেন ‘প্রভু’ by ইসরাত জাহান
বুকের ভেতরটা কেবলই শূন্য হয়ে যাচ্ছে। শূন্য হয়ে যাচ্ছে চারদিক। আর কত বেদনায় ডুবলে থামবে শূন্যতার এই স্রোত? চলে গেছেন খালেদ চৌধুরী। আগামী ২৩ আগস্ট তাঁর ৮০ বছর পূর্তির দিন। সেই অবকাশ না দিয়েই গত মঙ্গলবার (১২ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টায় আকস্মিক হূৎ-আক্রমণ তাঁকে চিরকালের জন্য নিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে।
বিংশ শতকের চল্লিশ, পঞ্চাশ ও মধ্য ষাটের দশকে এ দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের নেপথ্য-নায়কদের একজন ছিলেন খালেদ চৌধুরী। মাত্র দিন কয়েক আগে তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু শিল্পী আমিনুল ইসলাম চলে গেলেন। এর আগে গেছেন ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক মীজানুর রহমান, অগত্যার ফজলে লোহানী, কথাসাহিত্যিক আনিস চৌধুরী। তাঁর বেঁচেবর্তে থাকা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে রয়ে গেছেন হাতেগোনা কয়েকজন—অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর ও তাঁদের একটু পরবর্তীকালের ড. আনিসুজ্জামান। রয়ে গেছেন মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের দুই সহযোদ্ধা দ্বিজেন শর্মা ও হায়াৎ মামুদ। উল্লিখিত দশকের বুদ্ধিজীবী মহলে খালেদ চৌধুরী তাঁর মনস্বিতার জন্য পরিচিত ছিলেন ‘প্রভু’ নামে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর সেভাবে ছিল না। দুবার বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও দাঙ্গায় ব্যাহত হয় তা। পরে একবারে ভর্তি হন আর্ট কলেজে। আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের প্রথম ছাত্র তিনি। কিন্তু সেখানেও শেষ করতে পারেননি শিক্ষা। কোনো শিক্ষাগত সনদ না থাকা সত্ত্বেও ১৯৫৯ সালে তিনি সোভিয়েত কনসুলেটে প্রেস ইনফরমেশন বিভাগে দ্বিতীয় প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ পান। এখানেই তিনি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন আউট লাইন হিস্ট্রি অব কমিট্রান, জামিলা ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হুমকি দিয়ে লেখা তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোর্নির চিঠিটির অনুবাদও করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে মস্কো যান দাস ক্যাপিটাল অনুবাদের জন্য। কিন্তু দেশের টানে কাজ শেষ না করেই আবার ফিরে আসেন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত দূতাবাসে তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন।
কিন্তু আমার কাছে তাঁর পরিচয় ছিল, তিনি আমার বন্ধুর বাবা, প্রিয় কাকাবাবু। গালভরা পান নিয়ে তিনি যখন হাসতেন, সে উদ্দাম হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ছিলেন ভোজনরসিক। হাসিতে, গল্পে, আড্ডায় কখন যে কাকাবাবু এত আপন হয়েছিলেন, বুঝিনি। তাঁর দুই ছেলে সুজন চৌধুরী ও সুমন চৌধুরী। দুজনই প্রবাসী। তাই হয়তো তাঁদের অনুপস্থিতিতে সন্তানের বন্ধুর প্রতি বাৎসল্য একটু বেশিই ঝরে পড়ত।
টানা বেশ কয়েকবার কাকাবাবুর কাছে গিয়েছিলাম তাঁর ৭৯তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা তৈরির উদ্দেশ্যে। সেদিন নিজের সাধ্যে লেখায় তাঁর ছবি আঁকা সম্ভব না হওয়ায় হাত পাততে হয়েছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের মধ্যরাতের অশ্বারোহী বইয়ের কাছে। সেখানে খালেদ চৌধুরী সম্পর্কে ফয়েজ আহমেদ লিখেছেন, ‘...অর্থ, সম্পদ ও গতানুগতিক জীবনধারার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অবিশ্বাস। জীবনের প্রতি বৈরাগ্য, গ্রন্থাগারে সকাল-সন্ধ্যা, রুজিতে অরুচি—তিনি যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকর কুর্বের আধুনিক শিষ্য।’ ওই সময়কার এক আড্ডায় কাকাবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি খুব সাধারণ একজন। আমার গৌরবই হচ্ছে আমার বন্ধুরা।’
চমকে উঠি। কারণ, বন্ধুর উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত কিংবা বন্ধুর বুকে ছুরি চালাতে অভ্যস্ত সময়ের মানুষ আমি। যে মানুষ নিজে প্রচলিত হিসাবে কোনোমতেই প্রতিষ্ঠিত নন, তিনি যখন খ্যাত-বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত বন্ধুদের নিয়ে এমন গর্ব করেন, তখন অনুভব করি, তিনি নিজে কতটা অসাধারণ।
গত বুধবার সকালে এক বন্ধুর ফোনে জানলাম তাঁর মৃত্যুর খবর। আমি তাঁর রক্তের কেউ না। তার পরও রক্ত হিম হয়ে এল। ছুটে গেলাম, যদি শেষবার দেখা পাই। দেখলাম, বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। অতি ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় সেখানে। তাঁরা জানালেন, দুই ছেলে বিদেশ থেকে ফেরার অপেক্ষায় বারডেমের হিমাগারে রাখা হয়েছে তাঁর মরদেহ। কাকিমা হাসিনা চৌধুরী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁকে দেখে মনে হলো, খালেদ চৌধুরীর উপযুক্ত সহধর্মিণীই তিনি। এই নারী সম্পর্কে খালেদ চৌধুরী বলতেন, ‘ও তো আমাকে সারাটা জীবন আগলে রাখল।’ সারা জীবনের সঙ্গীকে হারিয়েও হাসিনা চৌধুরীকে সেদিন অতটা শান্ত থাকতে দেখে নিজে শক্তি পাই। তিনি যেন বুঝিয়ে দেন, ব্যথা যত তীব্রই হোক, ঋজুতার সঙ্গে তাকে ধারণ করাই জীবনের আরেক নাম।
পড়ালেখার তাগিদে ছেলে, ছেলের বউ প্রবাসী হওয়ার পর একদিন তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। দেখলাম, কাকাবাবু একাই বাসায়। সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, একা লাগে না? ছেলে আর ছেলের বউদের যেতে দিলেন কেন? গালভরা হাসি নিয়ে বললেন, ‘একা লাগবে কেন? তোমরা সবাই তো আমার ভেতরেই আছ। বাইরে থাকা না-থাকায় কী আসে-যায়?’
আজ তাঁর কথা তাঁকেই ফিরিয়ে দিচ্ছি। চলে গেছেন। তাতে কী? আপনি তো আমাদের হূদয়েই ঠাঁই করে নিয়েছেন। বাইরে থাকা না-থাকায় কী যায় আসে-যায়? সালাম কাকাবাবু।
ইসরাত জাহান
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর সেভাবে ছিল না। দুবার বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও দাঙ্গায় ব্যাহত হয় তা। পরে একবারে ভর্তি হন আর্ট কলেজে। আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের প্রথম ছাত্র তিনি। কিন্তু সেখানেও শেষ করতে পারেননি শিক্ষা। কোনো শিক্ষাগত সনদ না থাকা সত্ত্বেও ১৯৫৯ সালে তিনি সোভিয়েত কনসুলেটে প্রেস ইনফরমেশন বিভাগে দ্বিতীয় প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ পান। এখানেই তিনি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন আউট লাইন হিস্ট্রি অব কমিট্রান, জামিলা ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হুমকি দিয়ে লেখা তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোর্নির চিঠিটির অনুবাদও করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে মস্কো যান দাস ক্যাপিটাল অনুবাদের জন্য। কিন্তু দেশের টানে কাজ শেষ না করেই আবার ফিরে আসেন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত দূতাবাসে তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন।
কিন্তু আমার কাছে তাঁর পরিচয় ছিল, তিনি আমার বন্ধুর বাবা, প্রিয় কাকাবাবু। গালভরা পান নিয়ে তিনি যখন হাসতেন, সে উদ্দাম হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ছিলেন ভোজনরসিক। হাসিতে, গল্পে, আড্ডায় কখন যে কাকাবাবু এত আপন হয়েছিলেন, বুঝিনি। তাঁর দুই ছেলে সুজন চৌধুরী ও সুমন চৌধুরী। দুজনই প্রবাসী। তাই হয়তো তাঁদের অনুপস্থিতিতে সন্তানের বন্ধুর প্রতি বাৎসল্য একটু বেশিই ঝরে পড়ত।
টানা বেশ কয়েকবার কাকাবাবুর কাছে গিয়েছিলাম তাঁর ৭৯তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা তৈরির উদ্দেশ্যে। সেদিন নিজের সাধ্যে লেখায় তাঁর ছবি আঁকা সম্ভব না হওয়ায় হাত পাততে হয়েছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের মধ্যরাতের অশ্বারোহী বইয়ের কাছে। সেখানে খালেদ চৌধুরী সম্পর্কে ফয়েজ আহমেদ লিখেছেন, ‘...অর্থ, সম্পদ ও গতানুগতিক জীবনধারার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অবিশ্বাস। জীবনের প্রতি বৈরাগ্য, গ্রন্থাগারে সকাল-সন্ধ্যা, রুজিতে অরুচি—তিনি যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকর কুর্বের আধুনিক শিষ্য।’ ওই সময়কার এক আড্ডায় কাকাবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি খুব সাধারণ একজন। আমার গৌরবই হচ্ছে আমার বন্ধুরা।’
চমকে উঠি। কারণ, বন্ধুর উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত কিংবা বন্ধুর বুকে ছুরি চালাতে অভ্যস্ত সময়ের মানুষ আমি। যে মানুষ নিজে প্রচলিত হিসাবে কোনোমতেই প্রতিষ্ঠিত নন, তিনি যখন খ্যাত-বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত বন্ধুদের নিয়ে এমন গর্ব করেন, তখন অনুভব করি, তিনি নিজে কতটা অসাধারণ।
গত বুধবার সকালে এক বন্ধুর ফোনে জানলাম তাঁর মৃত্যুর খবর। আমি তাঁর রক্তের কেউ না। তার পরও রক্ত হিম হয়ে এল। ছুটে গেলাম, যদি শেষবার দেখা পাই। দেখলাম, বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। অতি ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় সেখানে। তাঁরা জানালেন, দুই ছেলে বিদেশ থেকে ফেরার অপেক্ষায় বারডেমের হিমাগারে রাখা হয়েছে তাঁর মরদেহ। কাকিমা হাসিনা চৌধুরী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁকে দেখে মনে হলো, খালেদ চৌধুরীর উপযুক্ত সহধর্মিণীই তিনি। এই নারী সম্পর্কে খালেদ চৌধুরী বলতেন, ‘ও তো আমাকে সারাটা জীবন আগলে রাখল।’ সারা জীবনের সঙ্গীকে হারিয়েও হাসিনা চৌধুরীকে সেদিন অতটা শান্ত থাকতে দেখে নিজে শক্তি পাই। তিনি যেন বুঝিয়ে দেন, ব্যথা যত তীব্রই হোক, ঋজুতার সঙ্গে তাকে ধারণ করাই জীবনের আরেক নাম।
পড়ালেখার তাগিদে ছেলে, ছেলের বউ প্রবাসী হওয়ার পর একদিন তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। দেখলাম, কাকাবাবু একাই বাসায়। সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, একা লাগে না? ছেলে আর ছেলের বউদের যেতে দিলেন কেন? গালভরা হাসি নিয়ে বললেন, ‘একা লাগবে কেন? তোমরা সবাই তো আমার ভেতরেই আছ। বাইরে থাকা না-থাকায় কী আসে-যায়?’
আজ তাঁর কথা তাঁকেই ফিরিয়ে দিচ্ছি। চলে গেছেন। তাতে কী? আপনি তো আমাদের হূদয়েই ঠাঁই করে নিয়েছেন। বাইরে থাকা না-থাকায় কী যায় আসে-যায়? সালাম কাকাবাবু।
ইসরাত জাহান
No comments