এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এই ১১ জন ছাত্রীর ভবিষ্যৎ কী? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

পরীক্ষায় খারাপ ফল করার দায়ে ১১ জন ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছে ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’ (এইউডব্লিউ) কর্তৃপক্ষ। বহিষ্কৃত ছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকদের কাছে এই উদ্যোগ অমানবিক ও নিয়মের বরখেলাপ। কর্তৃপক্ষ বলছে, সময়মতো সতর্কীকরণের পর এই বহিষ্কারাদেশ রীতিসিদ্ধ।

কয়েক দিন আগে এ নিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত এইউডব্লিউর ক্যাম্পাসে। বহিষ্কৃত ছাত্রী ও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল আরও শ খানেক ছাত্রী এবং অভিভাবক এর প্রতিবাদে মানববন্ধন ও অবস্থান ধর্মঘট করেন। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন ছুটির এ সময়ে এই ছাত্রীদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিতে পেরে কর্তৃপক্ষ আপাতদৃষ্টিতে সংকটমুক্ত। ভারত ও শ্রীলঙ্কার তিন ছাত্রী ফিরে গেছেন তাঁদের দেশে। বাকি আটজন ছাত্রী বাংলাদেশের—তাঁরা কেউ আশ্রয় নিয়েছেন সহপাঠীদের বাড়িতে, কেউ এরই মধ্যে ফিরে গেছেন বাড়িতে। সাড়ে তিন বছর আগে যে বিরাট স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলেন তাঁরা, এর হয়তো এখানেই সমাপ্তি। এশীয় মেয়েদের মধ্য থেকে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা, নানা দেশ ও ভাষার নানা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির মধ্যে বিনিময় ও সমন্বয়ের যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছিল, প্রথম ব্যাচের এই ছাত্রীদের ব্যর্থতার সঙ্গে তার ভাবমূর্তিও অনেকটাই জড়িয়ে গেল।
১১ জন ছাত্রীর বহিষ্কারাদেশের সূত্রে এই সুরক্ষিত প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে এমন অনেক তথ্য, যা আশাহত করবে শিক্ষানুরাগী ও সচেতন মহলকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ অপারেটিং কর্মকর্তা ওমর শরিফ বলেছেন, ‘এটাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বহিষ্কার নয়।’ এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রীর জন্য যে বার্তাটি তিনি দিয়ে রাখলেন, তা এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
প্রশ্ন ওঠে, গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজের (জিপিএ) ভিত্তিতে বহিষ্কারাদেশের কোনো রীতি বা পদ্ধতি আদৌ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কি না। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত যদি ছাত্রীরা কখনোই অবগত না থাকেন যে পরীক্ষায় জিপিএ-২-এর নিচে পেলে তাঁদের বহিষ্কার করা হবে, তাহলে হঠাৎ করে এক দিন তাঁদের হাতে সতর্কীকরণপত্র যেমন ধরিয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি সতর্কীকরণের শর্ত পূরণ করতে পারলেন না বলে কয়েক মাসের ব্যবধানে তাঁদের বহিষ্কার করাটাও যুক্তিসংগত কাজ হতে পারে না। ‘স্টুডেন্ট হ্যান্ডবুক’ (২০১০-২০১১) নামে যে নীতিমালা সম্প্রতি ছাত্রীরা পেয়েছেন, তাতে জিপিএ-সংক্রান্ত ধারাটিকে বলা হচ্ছে, অবেক্ষানীতি। সে নীতিটিও এখানে লঙ্ঘিত হয়েছে। যেমন, সতর্কপত্র দেওয়া ছাত্রীদের উন্নতির জন্য কর্তৃপক্ষ আদৌ ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে। অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন, কিছু ছাত্রীকে যে সতর্ক করা হয়েছে, তা তাঁরা অবগতই ছিলেন না। যেসব ছাত্রীকে সতর্ক করা হয়েছে, তাঁদের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে জানানো হয়নি। সর্বোপরি পাঠ-পরিকল্পনা তৈরির জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও একাডেমিক পরিচালকদের মধ্যে কোনো আলোচনাই হয়নি।
ছাত্রীদের অভিযোগ, তাঁদের সতর্কপত্রটি দেওয়া হয়েছে এমন এক সময়ে (মার্চ ২০১১), যখন সেমিস্টারের প্রায় অর্ধেকটা অতিক্রান্ত হয়েছে। অবশিষ্ট দুই মাস ছাত্রীদের পাঠোন্নতির জন্য যথেষ্ট সময় নয়। এ ছাড়া নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জিপিএ গণনা করা হয় অর্জিত ক্রেডিটের ভিত্তিতে। বিষয় পরিবর্তনের (রিটেকিং) ক্ষেত্রে পরিবর্তিত বিষয়টির নম্বর আগের অকৃতকার্য বিষয়টির নম্বরের স্থলে যুক্ত হয়। এখানে সেই পদ্ধতি কি অনুসৃত হয়েছে?
স্টুডেন্ট হ্যান্ডবুকের ‘অধিকার ও কর্তব্য’ শীর্ষক স্তবকে বলা হয়েছে, ‘সতর্কীকরণ, একাডেমিক প্রবেশন বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেওয়া অন্য কোনো শৃঙ্খলজনিত পদক্ষেপের ব্যাপারে আলোচনা বা এর কারণ জানতে চাওয়ার অধিকার সংশ্লিষ্ট ছাত্রীর থাকবে। কর্তৃপক্ষের কাছে নিজের যুক্তি তুলে ধরা ও অবস্থান ব্যাখ্যা করার অধিকারও তাঁর আছে’ (অনূদিত)।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বহিষ্কৃত ছাত্রীদের এ ব্যাপারে কোনো সুযোগ না দিয়েই চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাঁরা আবেদনের উদ্যোগ নিলে উপাচার্য মেরি সেনসেলোনি ছাত্রীদের জানিয়ে দিয়েছেন, আগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
প্রশ্ন ওঠে, এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটির নীতিনির্ধারণী কমিটির আদলটি আসলে কী? বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তা কতটা সংগতিপূর্ণ? বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, ফাইন্যান্স কমিটি এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি ইত্যাদি প্রশাসনিক কাঠামো থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও এ রকম কিছু প্রশাসনিক কাঠামোর বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে ইউজিসি। এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সে রকম কোনো একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর অস্তিত্ব কি আদৌ আছে?
যে ছাত্রীদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁদের পক্ষে এখন বাংলাদেশের কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত হলে আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিধান নেই। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সামর্থ্যও এই ‘সুবিধাবঞ্চিত’দের নেই। তার মানে, বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকলে এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি।
ভাবতে হবে, এইচএসসিতে কমপক্ষে এ গ্রেড পাওয়ার পর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এই ছাত্রীরা। আজ অকৃতকার্য হয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে তাঁদের বিদায় নিতে হলে ব্যর্থতার দায় কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরও পড়ে না?
এই অঞ্চলে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাস গড়ে ওঠাটা ছিল আমাদের জন্য শ্লাঘার বিষয়। অনেক প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। প্রথম ব্যাচের ১১ জন ছাত্রীর বহিষ্কারের সঙ্গে এর ভাবমূর্তি প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়ল। আমরা আশা করি, বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে। বহিষ্কৃত ১১ জন ছাত্রীকে আরেকবার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হোক, হয়তো এই ছাত্রীদের মধ্য থেকেই কেউ হয়ে উঠবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.