আদমশুমারি-জনসংখ্যার সালতামামি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ by মহিউদ্দিন আহমদ
২০১১ সালের লোকগণনার (আদমশুমারি) প্রাথমিক ফলাফল পাওয়া গেছে। মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখের কিছু বেশি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অনুমিত পূর্বাভাস থেকে এটা কম এবং তা স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এ দেশে ১০ বছর পর পর খানা জরিপের মাধ্যমে লোকগণনা করা হয়।
এ দেশে ১০ বছর পর পর খানা জরিপের মাধ্যমে লোকগণনা করা হয়।
জরিপ চলার সময় অনেকেই বাদ পড়ে যেতে পারে, কেউ কেউ হিসাবে ঢুকে পড়তে পারে একাধিকবার। এদের সংখ্যা একটি বিশেষ পদ্ধতিতে নমুনা জরিপের মাধ্যমে বের করে প্রাথমিক হিসাবের সঙ্গে সমন্বয় করে চূড়ান্ত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
১৯৬১ সালের লোকগণনার প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা যা ছিল, সমন্বয়ের পর তা ৯ শতাংশ বেড়ে যায়। পরবর্তী শুমারিতে, অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশ। ১৯৮১ সালে প্রাথমিক হিসাব থেকে পরিমার্জিত হিসাবে জনসংখ্যা বাড়ে ৩ শতাংশ, ১৯৯১ সালে বাড়ে ৫ শতাংশ এবং ২০০১ সালে বাড়ে ৫ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর পক্ষে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বের করার কাজটি করবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ধরা যাক, বাদ পড়া জনগোষ্ঠীর নিট সংখ্যা যদি হয় ৫ শতাংশ, তাহলে সমন্বয়ের পর দেশের জনসংখ্যা হবে ১৪ কোটি ৯৪ লাখ। যদি এই সংখ্যা ৭ শতাংশ বাড়ে, তবে দেশের জনসংখ্যা হবে ১৫ কোটি ২৩ লাখ। প্রাথমিক ফলাফল দেখে কেউ যদি মন্তব্য করেন যে পরিসংখ্যান ব্যুরো কারসাজি করে জনসংখ্যা কম দেখিয়েছে, কিংবা মাথাপিছু আয় বেশি দেখাতে পরিকল্পনা কমিশন প্রতারণা করেছে, তবে তা হবে অনভিপ্রেত। প্রকৃত হিসাব পেতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অক্টোবর পর্যন্ত এবং আমার ধারণা, প্রকৃত জনসংখ্যা ১৫ কোটির কাছাকাছি একটি সংখ্যা হবে। এই মুহূর্তে চাল-ডাল-তেল-চিনির আমদানি নিয়ে যেমন ঘুম নষ্ট হয়েছে, জনসংখ্যা নিয়ে তেমন অবস্থা তৈরি হয়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ১৯৭৪ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে তা হ্রাস পেয়ে ২০০১ সালে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে দাঁড়ায়। এ বছর তা ১ দশমিক ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অনুমান মোটেও অবাস্তব নয়। তবে অনুকূল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ ও প্রণোদনা থাকলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে আরও হ্রাস পেত, তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা অনেকেই ভাবি, আমাদের চারদিকে মানুষ কিলবিল করছে। নিশ্চয়ই হিসাবে গরমিল আছে। কেউ কেউ বলেন, মানুষ তো ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এটা ভাবি না, মানুষ বাড়ছে, জমি বাড়ছে না। রাস্তাঘাট বাড়ছে না। গ্রাম থেকে শহরমুখো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাই আমরা মানুষ বেশি দেখি।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশে প্রতিটি পরিবারের গড় জনসংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭। ২০০১ সালে তা নেমে আসে ৪ দশমিক ৯-এ। শহরের তুলনায় গ্রামের পরিবারগুলো ছিল সামান্যই বড়, ব্যবধান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ১। এ বছর এটা ৪ দশমিক ৩-এর মতো দাঁড়িয়েছে। আমি অনেক পরিবারকে জানি, যাদের সদস্যসংখ্যা তিন—স্বামী-স্ত্রী ও একটি সন্তান। আমার পরিচিত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের পরিবারের মধ্যে, বিশেষ করে যারা আমার প্রজন্মের, তাদের মধ্যে এমন পরিবার খুব কম আছে, যেখানে পরিবারের সদস্যসংখ্যা চারের বেশি, অর্থাৎ দুটির বেশি সন্তান। আমরা উদাহরণ হিসেবে এক্সট্রিম কেইসগুলো বেশি উল্লেখ করে বলি, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি করার একটা প্রবণতা আমাদের আছে, একটা উদাহরণ দিতে চাই।
১৯৮৫ সালের মে মাসের ২৫ তারিখে একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। উড়িরচর প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এর তিন মাস আগে আমরা সেখানে একটি খানা জরিপ করেছিলাম। সেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল হাজার পাঁচেক। অর্ধেক মানুষ মারা গিয়েছিল বলে আমার অনুমান। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলার বাণী হেডলাইন করেছিল, ৫০ হাজার লোক মৃত। বাংলাদেশ অবজার্ভার-এর মতে, নিহতের সংখ্যা ছিল এক লাখ। আমরা পারি বটে!
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শ্রীলঙ্কা বাদে দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভবত সবচেয়ে কম। বিশ্বের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন একটি ব্যতিক্রম! সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে জনসংখ্যার রাশ আরও টেনে ধরা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আরও বেগবান করা, প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পরিধি প্রসারিত করা এবং পরিবার সম্পর্কে মধ্যযুগীয় মনস্তত্ত্ব পরিহার করা।
যে বয়সে একজন ব্যক্তি তার পেশাগত ভিত তৈরি করে জীবনের উৎকর্ষের অনুসন্ধান করতে পারে, ঠিক সেই বয়সটিই একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার উত্তম সময় বলে সমাজপতিরা প্রচার করে আসছেন। আমরা যদি আমাদের সন্তানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর তোড়জোড় না করি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই কমে যাবে। ঘটা করে কন্যাশিশু দিবস পালন করলেই এটা হবে না। অনেক শিক্ষিত মা-বাবাকে দেখা যায়, একটা ‘ভালো ছেলে’ জোগাড় করতে পারলেই প্রতিশ্রুতিশীল একটি কন্যাকে তাঁরা পাত্রস্থ করেন এবং তার সম্ভাবনাকে গলা টিপে মেরে ফেলেন। যদি এমন ব্যবস্থা থাকে যে কন্যাশিশুর সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া হবে রাষ্ট্রীয় খরচে, যত দিন সে পড়াশোনা করবে, তত দিন সে বৃত্তি পাবে এবং পড়াশোনা শেষ হলে তার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কাজের সংস্থান হবে, তাহলে তথাকথিত ‘নিরাপত্তার’ জন্য সেই কন্যা বা তার অভিভাবক তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উতলা হবেন না। এ জন্য নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেলেও তা এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। কারণ, এই দেশটি ছোট, জমির পরিমাণ কম, অন্যান্য সম্পদ সীমিত, অধিকাংশ লোক দরিদ্র। সিঙ্গাপুর, হংকং কিংবা মালদ্বীপ বাদ দিলে বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। একটি উদাহরণ দিলে এর ভয়াবহ রূপ পরিষ্কার হবে। পৃথিবীর সব মানুষ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় কম হবে। সুতরাং এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে যে ব্যাপক আয়োজন দরকার, তা নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। এটা আমাদের রাষ্ট্রের অভিভাবকদের মূল এজেন্ডা হওয়া উচিত।
বর্তমানে ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। আজ থেকে ৪০ বছর পর, অর্থাৎ ২০৫১ সালের চালচিত্র কেমন হবে? শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হবে ৬৪ শতাংশ। কৃষিজমি কমছে গড়ে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে। নগরায়ণ, অবকাঠামোর চাহিদা, অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য বসতবাটি ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে। আইন করে তা ঠেকানো যাবে না। গ্রামে যাঁরা বাস করবেন, দেখা যাবে তাঁরা তাঁদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জমি চাষ করছেন। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পরিবার শতভাগ মানুষের জন্য খাবার উৎপাদন করবে। এটা কতটুকু সম্ভবপর হবে? খাদ্যের নিরাপত্তা যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রমবর্ধমান খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি আমাদের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো কোনো নীতি ও কৌশল বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের আছে বলে আমার জানা নেই।
জনসংখ্যা বিজ্ঞানের একটা বিশেষ দিক হলো, জনসংখ্যা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন একটি পরিবারে জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে একটা সমতা বা স্থিতাবস্থা বিরাজ করবে। তার পরেও মোট জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে, সন্তান জন্ম দিতে পারে এমন নারীর সংখ্যা যতক্ষণ পর্যন্ত না হ্রাস পাচ্ছে। অবশেষে একটা সময় আসবে, যখন জনসংখ্যা আর বাড়াবে না, বরং ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। একুশ শতকে আমরা এমন একটি অবস্থানে যেতে পারব বলে আশা করা যায় না।
২০০১ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো কিছু পূর্বাভাস দিয়েছিল। পরিবারে জন্ম-মৃত্যুর স্থিতাবস্থা যদি ২০১১ সালে অর্জিত হয়, তাহলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২২ কোটি ২৭ লাখ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পানি ও জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং কর্মসংস্থানের আয়োজন করার জন্য প্রয়োজন এক মহাপরিকল্পনার, বিশাল কর্মযজ্ঞের। সে কথা কি আমরা ভাবছি?
মহিউদ্দিন আহমেদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com
১৯৬১ সালের লোকগণনার প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা যা ছিল, সমন্বয়ের পর তা ৯ শতাংশ বেড়ে যায়। পরবর্তী শুমারিতে, অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশ। ১৯৮১ সালে প্রাথমিক হিসাব থেকে পরিমার্জিত হিসাবে জনসংখ্যা বাড়ে ৩ শতাংশ, ১৯৯১ সালে বাড়ে ৫ শতাংশ এবং ২০০১ সালে বাড়ে ৫ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর পক্ষে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বের করার কাজটি করবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ধরা যাক, বাদ পড়া জনগোষ্ঠীর নিট সংখ্যা যদি হয় ৫ শতাংশ, তাহলে সমন্বয়ের পর দেশের জনসংখ্যা হবে ১৪ কোটি ৯৪ লাখ। যদি এই সংখ্যা ৭ শতাংশ বাড়ে, তবে দেশের জনসংখ্যা হবে ১৫ কোটি ২৩ লাখ। প্রাথমিক ফলাফল দেখে কেউ যদি মন্তব্য করেন যে পরিসংখ্যান ব্যুরো কারসাজি করে জনসংখ্যা কম দেখিয়েছে, কিংবা মাথাপিছু আয় বেশি দেখাতে পরিকল্পনা কমিশন প্রতারণা করেছে, তবে তা হবে অনভিপ্রেত। প্রকৃত হিসাব পেতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অক্টোবর পর্যন্ত এবং আমার ধারণা, প্রকৃত জনসংখ্যা ১৫ কোটির কাছাকাছি একটি সংখ্যা হবে। এই মুহূর্তে চাল-ডাল-তেল-চিনির আমদানি নিয়ে যেমন ঘুম নষ্ট হয়েছে, জনসংখ্যা নিয়ে তেমন অবস্থা তৈরি হয়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ১৯৭৪ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে তা হ্রাস পেয়ে ২০০১ সালে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে দাঁড়ায়। এ বছর তা ১ দশমিক ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অনুমান মোটেও অবাস্তব নয়। তবে অনুকূল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ ও প্রণোদনা থাকলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে আরও হ্রাস পেত, তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা অনেকেই ভাবি, আমাদের চারদিকে মানুষ কিলবিল করছে। নিশ্চয়ই হিসাবে গরমিল আছে। কেউ কেউ বলেন, মানুষ তো ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এটা ভাবি না, মানুষ বাড়ছে, জমি বাড়ছে না। রাস্তাঘাট বাড়ছে না। গ্রাম থেকে শহরমুখো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাই আমরা মানুষ বেশি দেখি।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশে প্রতিটি পরিবারের গড় জনসংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭। ২০০১ সালে তা নেমে আসে ৪ দশমিক ৯-এ। শহরের তুলনায় গ্রামের পরিবারগুলো ছিল সামান্যই বড়, ব্যবধান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ১। এ বছর এটা ৪ দশমিক ৩-এর মতো দাঁড়িয়েছে। আমি অনেক পরিবারকে জানি, যাদের সদস্যসংখ্যা তিন—স্বামী-স্ত্রী ও একটি সন্তান। আমার পরিচিত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের পরিবারের মধ্যে, বিশেষ করে যারা আমার প্রজন্মের, তাদের মধ্যে এমন পরিবার খুব কম আছে, যেখানে পরিবারের সদস্যসংখ্যা চারের বেশি, অর্থাৎ দুটির বেশি সন্তান। আমরা উদাহরণ হিসেবে এক্সট্রিম কেইসগুলো বেশি উল্লেখ করে বলি, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি করার একটা প্রবণতা আমাদের আছে, একটা উদাহরণ দিতে চাই।
১৯৮৫ সালের মে মাসের ২৫ তারিখে একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। উড়িরচর প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এর তিন মাস আগে আমরা সেখানে একটি খানা জরিপ করেছিলাম। সেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল হাজার পাঁচেক। অর্ধেক মানুষ মারা গিয়েছিল বলে আমার অনুমান। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলার বাণী হেডলাইন করেছিল, ৫০ হাজার লোক মৃত। বাংলাদেশ অবজার্ভার-এর মতে, নিহতের সংখ্যা ছিল এক লাখ। আমরা পারি বটে!
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শ্রীলঙ্কা বাদে দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভবত সবচেয়ে কম। বিশ্বের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন একটি ব্যতিক্রম! সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে জনসংখ্যার রাশ আরও টেনে ধরা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আরও বেগবান করা, প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পরিধি প্রসারিত করা এবং পরিবার সম্পর্কে মধ্যযুগীয় মনস্তত্ত্ব পরিহার করা।
যে বয়সে একজন ব্যক্তি তার পেশাগত ভিত তৈরি করে জীবনের উৎকর্ষের অনুসন্ধান করতে পারে, ঠিক সেই বয়সটিই একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার উত্তম সময় বলে সমাজপতিরা প্রচার করে আসছেন। আমরা যদি আমাদের সন্তানকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর তোড়জোড় না করি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই কমে যাবে। ঘটা করে কন্যাশিশু দিবস পালন করলেই এটা হবে না। অনেক শিক্ষিত মা-বাবাকে দেখা যায়, একটা ‘ভালো ছেলে’ জোগাড় করতে পারলেই প্রতিশ্রুতিশীল একটি কন্যাকে তাঁরা পাত্রস্থ করেন এবং তার সম্ভাবনাকে গলা টিপে মেরে ফেলেন। যদি এমন ব্যবস্থা থাকে যে কন্যাশিশুর সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া হবে রাষ্ট্রীয় খরচে, যত দিন সে পড়াশোনা করবে, তত দিন সে বৃত্তি পাবে এবং পড়াশোনা শেষ হলে তার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কাজের সংস্থান হবে, তাহলে তথাকথিত ‘নিরাপত্তার’ জন্য সেই কন্যা বা তার অভিভাবক তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উতলা হবেন না। এ জন্য নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেলেও তা এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। কারণ, এই দেশটি ছোট, জমির পরিমাণ কম, অন্যান্য সম্পদ সীমিত, অধিকাংশ লোক দরিদ্র। সিঙ্গাপুর, হংকং কিংবা মালদ্বীপ বাদ দিলে বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। একটি উদাহরণ দিলে এর ভয়াবহ রূপ পরিষ্কার হবে। পৃথিবীর সব মানুষ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় কম হবে। সুতরাং এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে যে ব্যাপক আয়োজন দরকার, তা নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। এটা আমাদের রাষ্ট্রের অভিভাবকদের মূল এজেন্ডা হওয়া উচিত।
বর্তমানে ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। আজ থেকে ৪০ বছর পর, অর্থাৎ ২০৫১ সালের চালচিত্র কেমন হবে? শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হবে ৬৪ শতাংশ। কৃষিজমি কমছে গড়ে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে। নগরায়ণ, অবকাঠামোর চাহিদা, অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য বসতবাটি ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে। আইন করে তা ঠেকানো যাবে না। গ্রামে যাঁরা বাস করবেন, দেখা যাবে তাঁরা তাঁদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জমি চাষ করছেন। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পরিবার শতভাগ মানুষের জন্য খাবার উৎপাদন করবে। এটা কতটুকু সম্ভবপর হবে? খাদ্যের নিরাপত্তা যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রমবর্ধমান খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি আমাদের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো কোনো নীতি ও কৌশল বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের আছে বলে আমার জানা নেই।
জনসংখ্যা বিজ্ঞানের একটা বিশেষ দিক হলো, জনসংখ্যা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন একটি পরিবারে জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে একটা সমতা বা স্থিতাবস্থা বিরাজ করবে। তার পরেও মোট জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে, সন্তান জন্ম দিতে পারে এমন নারীর সংখ্যা যতক্ষণ পর্যন্ত না হ্রাস পাচ্ছে। অবশেষে একটা সময় আসবে, যখন জনসংখ্যা আর বাড়াবে না, বরং ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। একুশ শতকে আমরা এমন একটি অবস্থানে যেতে পারব বলে আশা করা যায় না।
২০০১ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো কিছু পূর্বাভাস দিয়েছিল। পরিবারে জন্ম-মৃত্যুর স্থিতাবস্থা যদি ২০১১ সালে অর্জিত হয়, তাহলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২২ কোটি ২৭ লাখ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, পানি ও জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং কর্মসংস্থানের আয়োজন করার জন্য প্রয়োজন এক মহাপরিকল্পনার, বিশাল কর্মযজ্ঞের। সে কথা কি আমরা ভাবছি?
মহিউদ্দিন আহমেদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments