যুক্তি তর্ক গল্প-ভিকারুননিসা: সমস্যার মূলে যাওয়া দরকার by আবুল মোমেন
ভিকারুননিসা নূন স্কুল (অ্যান্ড কলেজ) দেশের প্রথম সারির স্কুল তো বটেই, এ কথা বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না, এটি দেশের মেয়েদের স্কুলের মধ্যে সেরা স্কুল বলে গণ্য হয়। অভিভাবক-সমাজের মূল্যায়ন সম্ভবত এ রকমই। স্কুলপর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এ রকম বিচার অসংগত হবে না।
স্বভাবতই এই স্কুলে মেয়েদের ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকদের মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রহ থাকে। শিশুরা এতকাল বাবা-মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য ভর্তি পরীক্ষা নামের এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মোকাবিলা করে কেউ কৃতকার্য হয়েছে, কেউ ব্যর্থ। স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা বেড়েছে, এখন এ চাপ সামলানোর জন্য ঢাকা শহরে ভিকারুননিসার কয়েকটি শাখা চালু হয়েছে। এক প্রাক্তন ছাত্রী জানান, সব শাখা মিলিয়ে ছাত্রীসংখ্যা কুড়ি হাজারের বেশি হবে।
আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখেছি ছাত্রসংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে প্রশাসনিক সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক শৈথিল্য, শিক্ষক-কর্মীদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল, দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব, আর্থিক দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার ফলে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ছোট-বড় নানা রকম অপরাধের চর্চা বাড়ে। নানামুখী চাপে জর্জরিত ও ব্যতিব্যস্ত প্রশাসন সাধারণত সমস্যাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে সমস্যাবহুল প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখতে চায়। আমাদের অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠানের এই হাল। এগুলো চালু থাকে, কিন্তু দিনে দিনে এদের অবদান-অর্জনে ভাটা পড়তে থাকে।
ভিকারুননিসার পরিস্থিতি যত দূর শুনতে পাচ্ছি, এদিকেই গড়াচ্ছে। যে ঘটনাটি সম্প্রতি জনসমক্ষে বেরিয়ে এল, তা কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার সংকটেরই প্রকট লক্ষণ।
যে পরিমল জয়ধর ভিকারুননিসার মতো একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি নিশ্চয় নিজেও ভালো ছাত্র ছিলেন, তাঁর পরীক্ষার ফল নিশ্চয় উচ্চমানের, তিনি শিক্ষক হিসেবেও নিশ্চয় সফল ছিলেন (নতুবা ছাত্রীরা তাঁর কোচিংয়ে আকৃষ্ট হচ্ছে কেন?)। অতীতে আমরা চট্টগ্রামের সেরা স্কুলের সেরা ফল করা ছাত্রকে পরবর্তী জীবনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর খুনি রূপে দেখেছি। স্কুল-কলেজ থেকে কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষাগত ফলাফলের অধিকারী ভূরি ভূরি ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মূলত দূষিত ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ বখে যেতে, নষ্ট হতে দেখেছি আমরা।
পরিমলের মাধ্যমে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার অবশ্যই হতে হবে, তাতে নরপিশাচ শিক্ষকের চরম শাস্তি হোক। কিন্তু পরিমলই কি ভিকারুননিসার একমাত্র রোগ, সমস্যা? যত দূর জানা যাচ্ছে, পরিমলের পাশবিক লালসার প্রথমবারের ঘটনার পরপরই মেয়েটি তাদের বসুন্ধরা শাখার প্রধানের কাছে অভিযোগ জানায়, এমনকি পরের বার খোদ অধ্যক্ষাকে সহপাঠীরাসহ জোটবদ্ধভাবে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার চায়। কিন্তু যতক্ষণ না পত্রিকায় খবরটি ফাঁস হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী ত্বরিত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি এ রকম ঘটনার পরও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আন্তরিকতা ও আগ্রহের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহই শুধু নয়, ওয়াকিবহাল অনেকের বক্তব্য হলো, বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ঘটনার শিকার ছাত্রীটিকে শাস্তি প্রদানসহ আন্দোলনরত ছাত্রীদের শাস্তি, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে স্কুলে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল তারা। যদিও কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য, বিলম্ব এবং ঘটনার ভয়াবহতা ও গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতাই তো স্কুলের ছাত্রী ও অভিভাবকদের আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঘটনাটি এখন আর গোপন নেই, অভিযুক্ত শিক্ষক ধরা পড়েছেন ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আর এ ঘটনা বা অপরাধ তো ধামাচাপা দেওয়ার বা পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। এখন মিডিয়া ও সচেতন জনগণ ছাত্রীটির এবং তার পক্ষে আন্দোলনরত ছাত্রী ও অভিভাবকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, অপরাধীর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। এ অবস্থায় ঘটনাটি পাশ কাটানোর যেকোনো চেষ্টা থেকে জল ঘোলা হবে এবং ছাত্রী-অভিভাবক ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশীদের আন্দোলন আরও জোরদার হবে। পরিণামে ক্ষতি হবে স্কুলের।
যে খবর পাচ্ছি, তাতে বুঝতে পারছি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্কুলের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হচ্ছে দারুণভাবে। ছাত্রী ও অভিভাবকদের মনে যদি ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, এ ধরনের যেকোনো ঘটনায় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়, তাহলে তা স্কুলে অস্থিরতা তৈরি করবে বা সৃষ্ট অস্থিরতা দীর্ঘায়িত করবে। এভাবে আর কিছুদিন চললে প্রতিষ্ঠানের কলেজ ও মাধ্যমিক শাখার অধিকাংশ ছাত্রী এবং সেই সুবাদে অভিভাবকেরাও এ ঘটনায় পক্ষভুক্ত হয়ে যাবেন। তাঁরা ন্যায়বিচার এবং প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তির পক্ষে অবস্থান নেবেন। তাঁদের এই ভূমিকা পরিস্থিতি কঠিন করে তুললেও বা এমনকি ভুলও যদি প্রমাণিত হয়, তবুও তাঁদের উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব অনুধাবন করতে হবে।
ফলে এই সময়টাতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে, প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিতে হবে—কিন্তু তা নিতে হবে সংঘটিত দুর্ভাগ্যজনক অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের পক্ষে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করবে।
বলা বাহুল্য, এখানে সরকারেরও দায় আছে। শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে সরকার ন্যায়ের ও কল্যাণের পক্ষে হস্তক্ষেপ করবে—এটাই সবার কামনা। দেশের মানুষ দেশের প্রধান ও সুখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থায় সত্যিই উদ্বিগ্ন। ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ, ঘটনার শিকার ছাত্রীটির শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক পুনর্বাসন, স্কুলে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ইত্যাদি এখন স্কুল কর্তৃপক্ষের মূল বিচার্য ও করণীয় বিষয়। ঘটনার উদ্গাতা শিক্ষক পরিমল বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন, এটি পুলিশ ও আদালতের বিষয় এখন।
এই সূত্রে বলতে চাইব, কয়েকটি বিষয় যেন খুঁটিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়—
ক. কীভাবে ভিকারুননিসার মতো একটি স্কুলের শিক্ষকেরা কোচিং ব্যবসায় লিপ্ত হচ্ছেন এবং স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাই বা কেন কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়েছে? একজন অভিভাবক ফোনে জানিয়েছেন, স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রীই এক বা একাধিক কোচিংয়ে নিয়মিত পড়তে যায়। এ বাবদ কোনো কোনো অভিভাবকের মাসে কুড়ি হাজার টাকারও বেশি ব্যয় হয়।
খ. বিপুল ছাত্রী (শুনেছি সব শাখা মিলে প্রায় ২০-২৫ হাজার ছাত্রী) ও একাধিক শাখায় ছড়ানো স্কুলের প্রশাসন ও পাঠদান কি ঠিকমতো চলছে?
গ. ক্রমেই কি শিক্ষার্থীরা কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের দাপটের কাছে অসহায় ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে?
ঘ. ভালো ফল সত্ত্বেও জানা দরকার, শিক্ষার্থীরা মানবিক ও সৃজনশীল গুণাবলির বিকাশে যথার্থ সহযোগিতা পাচ্ছে কি? কেননা, প্রকৃত মানুষ হতে হলে শিক্ষার্থীর ইংরেজি, বাংলা ও সমাজে জিপিএ-৫ পেলে চলবে না, তাকে বন্ধুত্বে, সেবায়, ন্যায়বোধে, প্রীতিতে এবং এমনি সব মানসিক গুণেও তো ভালো করতে হবে।
এই প্রশ্নগুলো তোলার পাশাপাশি কয়েকটি পরামর্শ বিবেচনার জন্য দিতে চাই—
ক. স্কুলের সঙ্গে কলেজ জুড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। বরং এ সরকারের শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক ও নবম-দ্বাদশ পর্যন্ত মাধ্যমিক—এই বিভাজনই ভালো হবে। এবং এ দুটি স্বতন্ত্র দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকাই ভালো।
খ. কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক শাখা থাকা ঠিক হবে না এবং কোনো স্কুলে এক হাজারের বেশি ছাত্র থাকাও ঠিক নয়। তাতে প্রশাসনে শৈথিল্য, দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, অদক্ষতা বাড়তে পারে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্কুলপর্যায়ে প্রতিটি ছাত্রের যে ধরনের ঘনিষ্ঠ দেখভাল দরকার, তা ব্যাহত হবে। তাতে মানবিক গুণাবলি অর্জনে ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতিবিদদের পরিহার করাই ভালো। দলীয় রাজনীতির প্রভাবে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী তৈরি করে, পরিণতিতে যা তাঁদের স্বার্থপরতা ও কোন্দলের দিকে ঠেলে দেয়।
ঘ. শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতি ও অনিশ্চয়তার শঙ্কামুক্ত আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। পড়াশোনা ও পরীক্ষার বাইরে খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার ব্যাপক সুযোগ থাকা দরকার।
ঙ. প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকের সংস্পর্শ, সাহচর্য, নির্দেশনা পায়, সে দিকটি নিশ্চিত করা জরুরি।
চ. ছাত্রবৎসল মুক্তমনের উদার নেতৃত্বগুণসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক/ শিক্ষিকা হতে পারেন। প্রধান শিক্ষক/ শিক্ষিকার নেতৃত্বে শিক্ষকমণ্ডলীর নিয়মিত (সাপ্তাহিক/ পাক্ষিক) পাঠচক্র হওয়া জরুরি। তাঁদের জ্ঞানচর্চা সচল, সমকালীন না থাকলে স্কুলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘জ্ঞানের দেয়ালি উৎসব’ চলা অসম্ভব কল্পনাই রয়ে যাবে।
পরিশেষে বলব, যে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার আইনগত শাস্তি অবশ্যই অপরাধী পাবে। কিন্তু এ ছাড়া এ রকম ভয়ংকর ঘটনা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করার শামিল, আর তাই এর নৈতিক দায়দায়িত্ব স্কুলের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। উচিত ছিল অধ্যক্ষাসহ পরিচালনা পর্ষদের নিজে থেকেই পদত্যাগ করা। এখন সরকারের হস্তক্ষেপে এটা ঘটল। কিন্তু এতে স্কুলের বিবেক জাগ্রত হলো না, নৈতিকতা ফিরে এল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ রকম নৈতিক সংকটে ও বিবেকের দংশনে ফেলে দেওয়া তাদের উচিত হয়নি। অর্থাৎ, ভিকারুননিসার ঘটনার সূত্রে কোনো অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করলেই দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। এ রকম ঘটনার কারণ এবং তা নিরসনে স্কুল কর্তৃপক্ষের সময়োচিত সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণও খুঁজে বের করতে হবে। স্কুলের ভাবমূর্তি, নৈতিক অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট সবার বিবেকের জাগরণও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য বিষয়। নয়তো এ ধরনের কিংবা অন্য ধরনের সংকটে প্রতিষ্ঠানটি পথ হারাতে পারে। বিষয়টি জরুরি, তাই দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ছাত্র, অভিভাবক ও কমিটির সবাইকে ধৈর্য, দূরদর্শিতা ও বিবেচনা বোধের পরিচয় দিতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখেছি ছাত্রসংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে প্রশাসনিক সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক শৈথিল্য, শিক্ষক-কর্মীদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল, দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব, আর্থিক দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার ফলে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ছোট-বড় নানা রকম অপরাধের চর্চা বাড়ে। নানামুখী চাপে জর্জরিত ও ব্যতিব্যস্ত প্রশাসন সাধারণত সমস্যাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে সমস্যাবহুল প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখতে চায়। আমাদের অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠানের এই হাল। এগুলো চালু থাকে, কিন্তু দিনে দিনে এদের অবদান-অর্জনে ভাটা পড়তে থাকে।
ভিকারুননিসার পরিস্থিতি যত দূর শুনতে পাচ্ছি, এদিকেই গড়াচ্ছে। যে ঘটনাটি সম্প্রতি জনসমক্ষে বেরিয়ে এল, তা কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার সংকটেরই প্রকট লক্ষণ।
যে পরিমল জয়ধর ভিকারুননিসার মতো একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি নিশ্চয় নিজেও ভালো ছাত্র ছিলেন, তাঁর পরীক্ষার ফল নিশ্চয় উচ্চমানের, তিনি শিক্ষক হিসেবেও নিশ্চয় সফল ছিলেন (নতুবা ছাত্রীরা তাঁর কোচিংয়ে আকৃষ্ট হচ্ছে কেন?)। অতীতে আমরা চট্টগ্রামের সেরা স্কুলের সেরা ফল করা ছাত্রকে পরবর্তী জীবনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর খুনি রূপে দেখেছি। স্কুল-কলেজ থেকে কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষাগত ফলাফলের অধিকারী ভূরি ভূরি ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মূলত দূষিত ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে সম্পূর্ণ বখে যেতে, নষ্ট হতে দেখেছি আমরা।
পরিমলের মাধ্যমে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার অবশ্যই হতে হবে, তাতে নরপিশাচ শিক্ষকের চরম শাস্তি হোক। কিন্তু পরিমলই কি ভিকারুননিসার একমাত্র রোগ, সমস্যা? যত দূর জানা যাচ্ছে, পরিমলের পাশবিক লালসার প্রথমবারের ঘটনার পরপরই মেয়েটি তাদের বসুন্ধরা শাখার প্রধানের কাছে অভিযোগ জানায়, এমনকি পরের বার খোদ অধ্যক্ষাকে সহপাঠীরাসহ জোটবদ্ধভাবে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার চায়। কিন্তু যতক্ষণ না পত্রিকায় খবরটি ফাঁস হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী ত্বরিত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি এ রকম ঘটনার পরও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আন্তরিকতা ও আগ্রহের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহই শুধু নয়, ওয়াকিবহাল অনেকের বক্তব্য হলো, বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ঘটনার শিকার ছাত্রীটিকে শাস্তি প্রদানসহ আন্দোলনরত ছাত্রীদের শাস্তি, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে স্কুলে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল তারা। যদিও কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য, বিলম্ব এবং ঘটনার ভয়াবহতা ও গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতাই তো স্কুলের ছাত্রী ও অভিভাবকদের আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঘটনাটি এখন আর গোপন নেই, অভিযুক্ত শিক্ষক ধরা পড়েছেন ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আর এ ঘটনা বা অপরাধ তো ধামাচাপা দেওয়ার বা পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। এখন মিডিয়া ও সচেতন জনগণ ছাত্রীটির এবং তার পক্ষে আন্দোলনরত ছাত্রী ও অভিভাবকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, অপরাধীর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। এ অবস্থায় ঘটনাটি পাশ কাটানোর যেকোনো চেষ্টা থেকে জল ঘোলা হবে এবং ছাত্রী-অভিভাবক ও ন্যায়বিচার প্রত্যাশীদের আন্দোলন আরও জোরদার হবে। পরিণামে ক্ষতি হবে স্কুলের।
যে খবর পাচ্ছি, তাতে বুঝতে পারছি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্কুলের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হচ্ছে দারুণভাবে। ছাত্রী ও অভিভাবকদের মনে যদি ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, এ ধরনের যেকোনো ঘটনায় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়, তাহলে তা স্কুলে অস্থিরতা তৈরি করবে বা সৃষ্ট অস্থিরতা দীর্ঘায়িত করবে। এভাবে আর কিছুদিন চললে প্রতিষ্ঠানের কলেজ ও মাধ্যমিক শাখার অধিকাংশ ছাত্রী এবং সেই সুবাদে অভিভাবকেরাও এ ঘটনায় পক্ষভুক্ত হয়ে যাবেন। তাঁরা ন্যায়বিচার এবং প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তির পক্ষে অবস্থান নেবেন। তাঁদের এই ভূমিকা পরিস্থিতি কঠিন করে তুললেও বা এমনকি ভুলও যদি প্রমাণিত হয়, তবুও তাঁদের উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব অনুধাবন করতে হবে।
ফলে এই সময়টাতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে, প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিতে হবে—কিন্তু তা নিতে হবে সংঘটিত দুর্ভাগ্যজনক অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের পক্ষে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করবে।
বলা বাহুল্য, এখানে সরকারেরও দায় আছে। শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে সরকার ন্যায়ের ও কল্যাণের পক্ষে হস্তক্ষেপ করবে—এটাই সবার কামনা। দেশের মানুষ দেশের প্রধান ও সুখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থায় সত্যিই উদ্বিগ্ন। ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ, ঘটনার শিকার ছাত্রীটির শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক পুনর্বাসন, স্কুলে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ইত্যাদি এখন স্কুল কর্তৃপক্ষের মূল বিচার্য ও করণীয় বিষয়। ঘটনার উদ্গাতা শিক্ষক পরিমল বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন, এটি পুলিশ ও আদালতের বিষয় এখন।
এই সূত্রে বলতে চাইব, কয়েকটি বিষয় যেন খুঁটিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়—
ক. কীভাবে ভিকারুননিসার মতো একটি স্কুলের শিক্ষকেরা কোচিং ব্যবসায় লিপ্ত হচ্ছেন এবং স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাই বা কেন কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়েছে? একজন অভিভাবক ফোনে জানিয়েছেন, স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রীই এক বা একাধিক কোচিংয়ে নিয়মিত পড়তে যায়। এ বাবদ কোনো কোনো অভিভাবকের মাসে কুড়ি হাজার টাকারও বেশি ব্যয় হয়।
খ. বিপুল ছাত্রী (শুনেছি সব শাখা মিলে প্রায় ২০-২৫ হাজার ছাত্রী) ও একাধিক শাখায় ছড়ানো স্কুলের প্রশাসন ও পাঠদান কি ঠিকমতো চলছে?
গ. ক্রমেই কি শিক্ষার্থীরা কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের দাপটের কাছে অসহায় ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে?
ঘ. ভালো ফল সত্ত্বেও জানা দরকার, শিক্ষার্থীরা মানবিক ও সৃজনশীল গুণাবলির বিকাশে যথার্থ সহযোগিতা পাচ্ছে কি? কেননা, প্রকৃত মানুষ হতে হলে শিক্ষার্থীর ইংরেজি, বাংলা ও সমাজে জিপিএ-৫ পেলে চলবে না, তাকে বন্ধুত্বে, সেবায়, ন্যায়বোধে, প্রীতিতে এবং এমনি সব মানসিক গুণেও তো ভালো করতে হবে।
এই প্রশ্নগুলো তোলার পাশাপাশি কয়েকটি পরামর্শ বিবেচনার জন্য দিতে চাই—
ক. স্কুলের সঙ্গে কলেজ জুড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। বরং এ সরকারের শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক ও নবম-দ্বাদশ পর্যন্ত মাধ্যমিক—এই বিভাজনই ভালো হবে। এবং এ দুটি স্বতন্ত্র দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকাই ভালো।
খ. কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক শাখা থাকা ঠিক হবে না এবং কোনো স্কুলে এক হাজারের বেশি ছাত্র থাকাও ঠিক নয়। তাতে প্রশাসনে শৈথিল্য, দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, অদক্ষতা বাড়তে পারে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্কুলপর্যায়ে প্রতিটি ছাত্রের যে ধরনের ঘনিষ্ঠ দেখভাল দরকার, তা ব্যাহত হবে। তাতে মানবিক গুণাবলি অর্জনে ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতিবিদদের পরিহার করাই ভালো। দলীয় রাজনীতির প্রভাবে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী তৈরি করে, পরিণতিতে যা তাঁদের স্বার্থপরতা ও কোন্দলের দিকে ঠেলে দেয়।
ঘ. শিক্ষার্থীদের জন্য ভীতি ও অনিশ্চয়তার শঙ্কামুক্ত আনন্দময় পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। পড়াশোনা ও পরীক্ষার বাইরে খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার ব্যাপক সুযোগ থাকা দরকার।
ঙ. প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকের সংস্পর্শ, সাহচর্য, নির্দেশনা পায়, সে দিকটি নিশ্চিত করা জরুরি।
চ. ছাত্রবৎসল মুক্তমনের উদার নেতৃত্বগুণসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক/ শিক্ষিকা হতে পারেন। প্রধান শিক্ষক/ শিক্ষিকার নেতৃত্বে শিক্ষকমণ্ডলীর নিয়মিত (সাপ্তাহিক/ পাক্ষিক) পাঠচক্র হওয়া জরুরি। তাঁদের জ্ঞানচর্চা সচল, সমকালীন না থাকলে স্কুলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘জ্ঞানের দেয়ালি উৎসব’ চলা অসম্ভব কল্পনাই রয়ে যাবে।
পরিশেষে বলব, যে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার আইনগত শাস্তি অবশ্যই অপরাধী পাবে। কিন্তু এ ছাড়া এ রকম ভয়ংকর ঘটনা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করার শামিল, আর তাই এর নৈতিক দায়দায়িত্ব স্কুলের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। উচিত ছিল অধ্যক্ষাসহ পরিচালনা পর্ষদের নিজে থেকেই পদত্যাগ করা। এখন সরকারের হস্তক্ষেপে এটা ঘটল। কিন্তু এতে স্কুলের বিবেক জাগ্রত হলো না, নৈতিকতা ফিরে এল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ রকম নৈতিক সংকটে ও বিবেকের দংশনে ফেলে দেওয়া তাদের উচিত হয়নি। অর্থাৎ, ভিকারুননিসার ঘটনার সূত্রে কোনো অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করলেই দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। এ রকম ঘটনার কারণ এবং তা নিরসনে স্কুল কর্তৃপক্ষের সময়োচিত সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণও খুঁজে বের করতে হবে। স্কুলের ভাবমূর্তি, নৈতিক অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট সবার বিবেকের জাগরণও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য বিষয়। নয়তো এ ধরনের কিংবা অন্য ধরনের সংকটে প্রতিষ্ঠানটি পথ হারাতে পারে। বিষয়টি জরুরি, তাই দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ছাত্র, অভিভাবক ও কমিটির সবাইকে ধৈর্য, দূরদর্শিতা ও বিবেচনা বোধের পরিচয় দিতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments