রাজনীতি-শেষ পর্যন্ত জনগণই ভরসা by আবদুল মান্নান
হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ির একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কোনো একটা সময় ছিল, যখন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা জনগণকে কিছু দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতেন। এখন বলেন, এটা চাই, ওটা চাই। সরকারি দল সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়েছে।
কারণ, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এবং তাদের মিত্র জামায়াত হরতালের উৎসব বসিয়েছে। কারণ, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন চায়। বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, বর্তমান সরকারের তৈরি সমস্যার সমাধান একমাত্র বিএনপির হাতে। সবচেয়ে মজার চাহিদাপত্রটি এসেছে সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের কাছ থেকে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। আর এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম শুধু এক দিন-দুই দিন নয়, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে টানা এক মাস হরতাল চান। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু আপাতত ৪৮ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা হরতাল চান, যাতে ভবিষ্যতে দেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারে। আর ইসলাম-পছন্দ নেতারা সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা সত্ত্বেও সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ লাইনটি বহাল চান। তা না হলে তাঁরা দিনের পর দিন হরতাল দিয়ে মসনদে বসতে চান। তবে কেউ জানতে চান না জনগণ কী চান।
প্রথমে সরকারি দলের কথা বলি। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর গড়া দল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে তিনি নিহত হলে দলটি ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। পরবর্তী সময়ে মাঝেমধ্যে দলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তেমন একটা সুবিধা হয়নি যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। নেতৃত্বের প্রশ্নে দলে বিভক্তিও এসেছে। লাভ হয়নি কিছু। শেষমেশ ১৯৮১ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধুকন্যা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে দলের হাল ধরলে আওয়ামী লীগ প্রাণ ফিরে পায়। ক্ষত-বিক্ষত এবং ছত্রভঙ্গ দলটিকে তিনি শুধু দাঁড়ই করাননি, ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী করেছেন। যদিও ধারণা করা হয়েছিল, ১৯৯১ সালে এরশাদ পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পার্টি আর জাসদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কারণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধানে খালেদা জিয়ার পূর্ববর্তী সরকার অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের কারণে।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের বিজয় ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কিছুটা দলীয়, কিছু সাংসদ এবং তাঁদের পুত্রদের অপরিণামদর্শী কীর্তির কারণে, আর কিছুটা তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের ফলে। সঙ্গে যোগ হয়েছিল কিছু আন্তর্জাতিক উপসর্গ। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকাল। দেশ যে তখন কে শাসন করছিল, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনি। হাওয়া ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নাকি সচিবালয়? তবে এটা বুঝতে পেরেছিল জোট, পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে নানাবিধ কর্মকৌশল প্রস্তুত করেছে। মানবে কেন আওয়ামী লীগ? আবার আন্দোলন, আবার রাজপথ। তারপর এল এক-এগারো। ইয়াজউদ্দিনের হাত ঘুরে ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হলেন ফখরুদ্দীন এবং তাঁর সঙ্গী-সাথিরা। পেছনে অবশ্য সেনাপ্রধান মইনউদ্দিন। থাকার কথা ৯০ দিন, থাকলেন দুই বছর। জেলে পুরলেন শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতাকে। দেওয়া হলো নানা ধরনের অদ্ভুত সব মামলা। বসল ক্যাঙ্গারু কোর্ট। সেই আদালতে যাঁকেই নেওয়া হয়, তিনিই দোষী সাব্যস্ত হন। সেটি ছিল এক আজব সময়। যে উদ্দেশ্যে এত আন্দোলন-রক্তপাতের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক অনন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, তাকে গলা টিপে হত্যা করল ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গং। সুযোগটা করে দিয়েছিল চারদলীয় জোট সরকার।
এমন একটা পরিস্থিতিতে যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা এই ব্যবস্থার অবসান চাইবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? আদালতের একটি মামলার রায় তাঁদের কাজটাকে আরও সহজ করে দিল। আদালত বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেআইনি। তবে এই বেআইনি কাজটা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে দুই মেয়াদ চালু রাখা যেতে পারে। আদালত এ-ও বললেন, তবে সেই দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো বিচারপতিকে না জড়ানো ভালো। তাহলে কেমন করে সেই সরকার চলবে, তা ঠিক করবে সংসদ। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেল। পুরো বিষয়টি আরও গোলমেলে করে দিলেন খালেদা জিয়া। বললেন, আদালতের বিচার মানি না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। তবে বিচারপতি খায়রুল হক, যিনি কিনা সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারবেন না। সরকারি দল বলল, কী হবে তা সংসদে এসে বলেন। বিএনপি ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, আর যা-ই হোক, সংসদে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে সংসদে মীমাংসার অনেক বিষয় বিরোধী দল রাজপথে ফয়সালা করতে চায়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয় কীভাবে? সরকারি দল অযথা সময়ক্ষেপণ অনুচিত মনে করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিলুপ্ত ঘোষণা করে বলে, আপাতত দেশ পরিচালিত হবে এই সংশোধিত সংবিধানে। যদিও সংশোধিত সংবিধানে অজস্র গোঁজামিল। তবে আশার কথা, সরকারি দল দরজা একেবারে বন্ধ করে না দিয়ে বিরোধী দলের উদ্দেশে বলে, আসুন, এ ব্যাপারে সংসদে এসে কথা বলুন, প্রয়োজনে আবার সংশোধন করা হবে। বিরোধী দলের এক কথা, যা হওয়ার তা রাজপথেই হবে, সংসদ আবার কী?
এদিকে এরশাদের তাঁবেদারেরা তাঁকে বুঝিয়েছেন, দুই বড় দলের ঝগড়া-ফ্যাসাদে লাভ তো আপনার। তিনি তো বহুদিন ধরে আশায় বুক বেঁধে আছেন, বর্তমান সরকার তাঁকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে কিছু একটা দেবেন। প্রথমে খায়েশ ছিল রাষ্ট্রপতি হবেন। সেটা যখন হলো না তখন বললেন, তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত বানানো হোক। সেটাও হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বলা হলো, খালেদা জিয়া দলবল নিয়ে সংসদ থেকে যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তিনি হবেন পূর্ণ মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিরোধীদলীয় নেতা। তবে সেটা তো নির্ভর করে খালেদা জিয়া কী করেন তার ওপর। তবে এ মুহূর্তে তেমন কিছু হওয়ার লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। বাকি রইল প্রধানমন্ত্রীর পদ। তা হতে হলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন লাগবে। তা হওয়ারও তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে একটা রাস্তা খোলা আছে। সংশোধিত সংবিধানের অধীনে আগামী নির্বাচন যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হয় এবং উভয় নেত্রী যদি রাজি হন, তাহলে এরশাদ সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলে হতেও পারেন। তবে অনেকগুলো ‘যদি’র কী হবে, তা-ও ভেবে দেখতে হবে।
এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করি। জিয়ার হাত ধরে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ‘বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ ভারতবিদ্বেষী’ তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে নিজের তত্ত্ব হাজির করে বলেন, আসলে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ভারতবিদ্বেষী। অতীতে তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমাম ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে নিন্দিত হয়েছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলের শেষ দিকে বিএনপি ছেড়ে এসে এলডিপি গঠন করেন। বর্তমানে ওয়ান ম্যান পার্টির নেতা। তিনি এখন পুরো এক মাস হরতাল চান। বলেন, নয়তো বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। বিলেত থেকে পিএইচডি করেছেন। অলি সাহেব নিশ্চয় বোঝেন, এমনটি হলে বাংলাদেশ আর সোমালিয়ার মধ্যে কোনো তফাত থাকবে না। অবশ্য গাদ্দাফির ছেলেও অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করেছেন।
ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু একসময় আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে বেশ ভালো ব্যবসা করেছেন। শেষের দিকে এসে বনিবনা হয়নি বলে খালেদা জিয়ার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। বলেন, বর্তমান দুই দিন-তিন দিন হরতাল দিলে মানুষের কষ্ট হয় বটে, তবে সেই কষ্ট আগামী দিনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার জন্য একটু মেনে নিতে হবে। খালেদা জিয়া তিন দফা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেষেরবারের দুঃশাসনের কথা কি মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে? তবে অন্যদের ব্যবসাপাতি বন্ধ রাখতে বলে নিজের সব ব্যবসা খোলা রাখেন। এটা ভালো লক্ষণ। তিনি নিশ্চয় জানেন, তাঁর মতো বুদ্ধিমান বাংলাদেশে আরও আছে।
তারপর বাকি রইল ইসলাম-পছন্দ দলগুলো। সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’ লাইনটি কেন বাদ দেওয়া হলো, তার জন্য তারা হরতাল ডেকে রাস্তায় নেমেছে। যেখানে বিসমিল্লাহ দিয়ে সংবিধান শুরু আর রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে অন্য কিছুর কেন প্রয়োজন, তা বোঝার ক্ষমতা হয় তাদের নেই, অথবা তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা যতই তাদের খুশি করতে চান, তিনি সফল হবেন না।
সবশেষে জনগণ। তাদের হয়েছে যত মুশকিল। তাদের কথা বলার প্ল্যাটফর্ম নেই। তবে আছে নির্বাচনের সময় দলীয় মার্কায় একটি সিল মারা। সেটি তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, গোপনে ব্যবহার করে এবং অন্য সবাইকে ঘায়েল করে দিতে পারে। দেখা যাক সামনের বার তারা তাদের সেই অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করে। তত দিন পর্যন্ত তাদের বিরোধী দল এবং তাদের মিত্রদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে হবে। তবে ভরসা এই, সবশেষে তাদেরই জয় হবে।
আবদুলমান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথমে সরকারি দলের কথা বলি। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর গড়া দল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে তিনি নিহত হলে দলটি ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। পরবর্তী সময়ে মাঝেমধ্যে দলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তেমন একটা সুবিধা হয়নি যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। নেতৃত্বের প্রশ্নে দলে বিভক্তিও এসেছে। লাভ হয়নি কিছু। শেষমেশ ১৯৮১ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধুকন্যা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে দলের হাল ধরলে আওয়ামী লীগ প্রাণ ফিরে পায়। ক্ষত-বিক্ষত এবং ছত্রভঙ্গ দলটিকে তিনি শুধু দাঁড়ই করাননি, ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী করেছেন। যদিও ধারণা করা হয়েছিল, ১৯৯১ সালে এরশাদ পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পার্টি আর জাসদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কারণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধানে খালেদা জিয়ার পূর্ববর্তী সরকার অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের কারণে।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের বিজয় ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কিছুটা দলীয়, কিছু সাংসদ এবং তাঁদের পুত্রদের অপরিণামদর্শী কীর্তির কারণে, আর কিছুটা তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের ফলে। সঙ্গে যোগ হয়েছিল কিছু আন্তর্জাতিক উপসর্গ। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকাল। দেশ যে তখন কে শাসন করছিল, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনি। হাওয়া ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নাকি সচিবালয়? তবে এটা বুঝতে পেরেছিল জোট, পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে নানাবিধ কর্মকৌশল প্রস্তুত করেছে। মানবে কেন আওয়ামী লীগ? আবার আন্দোলন, আবার রাজপথ। তারপর এল এক-এগারো। ইয়াজউদ্দিনের হাত ঘুরে ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হলেন ফখরুদ্দীন এবং তাঁর সঙ্গী-সাথিরা। পেছনে অবশ্য সেনাপ্রধান মইনউদ্দিন। থাকার কথা ৯০ দিন, থাকলেন দুই বছর। জেলে পুরলেন শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতাকে। দেওয়া হলো নানা ধরনের অদ্ভুত সব মামলা। বসল ক্যাঙ্গারু কোর্ট। সেই আদালতে যাঁকেই নেওয়া হয়, তিনিই দোষী সাব্যস্ত হন। সেটি ছিল এক আজব সময়। যে উদ্দেশ্যে এত আন্দোলন-রক্তপাতের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক অনন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, তাকে গলা টিপে হত্যা করল ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গং। সুযোগটা করে দিয়েছিল চারদলীয় জোট সরকার।
এমন একটা পরিস্থিতিতে যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা এই ব্যবস্থার অবসান চাইবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? আদালতের একটি মামলার রায় তাঁদের কাজটাকে আরও সহজ করে দিল। আদালত বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেআইনি। তবে এই বেআইনি কাজটা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে দুই মেয়াদ চালু রাখা যেতে পারে। আদালত এ-ও বললেন, তবে সেই দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো বিচারপতিকে না জড়ানো ভালো। তাহলে কেমন করে সেই সরকার চলবে, তা ঠিক করবে সংসদ। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেল। পুরো বিষয়টি আরও গোলমেলে করে দিলেন খালেদা জিয়া। বললেন, আদালতের বিচার মানি না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। তবে বিচারপতি খায়রুল হক, যিনি কিনা সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারবেন না। সরকারি দল বলল, কী হবে তা সংসদে এসে বলেন। বিএনপি ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, আর যা-ই হোক, সংসদে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে সংসদে মীমাংসার অনেক বিষয় বিরোধী দল রাজপথে ফয়সালা করতে চায়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয় কীভাবে? সরকারি দল অযথা সময়ক্ষেপণ অনুচিত মনে করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিলুপ্ত ঘোষণা করে বলে, আপাতত দেশ পরিচালিত হবে এই সংশোধিত সংবিধানে। যদিও সংশোধিত সংবিধানে অজস্র গোঁজামিল। তবে আশার কথা, সরকারি দল দরজা একেবারে বন্ধ করে না দিয়ে বিরোধী দলের উদ্দেশে বলে, আসুন, এ ব্যাপারে সংসদে এসে কথা বলুন, প্রয়োজনে আবার সংশোধন করা হবে। বিরোধী দলের এক কথা, যা হওয়ার তা রাজপথেই হবে, সংসদ আবার কী?
এদিকে এরশাদের তাঁবেদারেরা তাঁকে বুঝিয়েছেন, দুই বড় দলের ঝগড়া-ফ্যাসাদে লাভ তো আপনার। তিনি তো বহুদিন ধরে আশায় বুক বেঁধে আছেন, বর্তমান সরকার তাঁকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে কিছু একটা দেবেন। প্রথমে খায়েশ ছিল রাষ্ট্রপতি হবেন। সেটা যখন হলো না তখন বললেন, তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত বানানো হোক। সেটাও হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বলা হলো, খালেদা জিয়া দলবল নিয়ে সংসদ থেকে যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তিনি হবেন পূর্ণ মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিরোধীদলীয় নেতা। তবে সেটা তো নির্ভর করে খালেদা জিয়া কী করেন তার ওপর। তবে এ মুহূর্তে তেমন কিছু হওয়ার লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। বাকি রইল প্রধানমন্ত্রীর পদ। তা হতে হলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন লাগবে। তা হওয়ারও তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে একটা রাস্তা খোলা আছে। সংশোধিত সংবিধানের অধীনে আগামী নির্বাচন যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হয় এবং উভয় নেত্রী যদি রাজি হন, তাহলে এরশাদ সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলে হতেও পারেন। তবে অনেকগুলো ‘যদি’র কী হবে, তা-ও ভেবে দেখতে হবে।
এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করি। জিয়ার হাত ধরে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ‘বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ ভারতবিদ্বেষী’ তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে নিজের তত্ত্ব হাজির করে বলেন, আসলে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ভারতবিদ্বেষী। অতীতে তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমাম ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য দিয়ে নিন্দিত হয়েছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলের শেষ দিকে বিএনপি ছেড়ে এসে এলডিপি গঠন করেন। বর্তমানে ওয়ান ম্যান পার্টির নেতা। তিনি এখন পুরো এক মাস হরতাল চান। বলেন, নয়তো বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। বিলেত থেকে পিএইচডি করেছেন। অলি সাহেব নিশ্চয় বোঝেন, এমনটি হলে বাংলাদেশ আর সোমালিয়ার মধ্যে কোনো তফাত থাকবে না। অবশ্য গাদ্দাফির ছেলেও অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করেছেন।
ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু একসময় আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে বেশ ভালো ব্যবসা করেছেন। শেষের দিকে এসে বনিবনা হয়নি বলে খালেদা জিয়ার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। বলেন, বর্তমান দুই দিন-তিন দিন হরতাল দিলে মানুষের কষ্ট হয় বটে, তবে সেই কষ্ট আগামী দিনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার জন্য একটু মেনে নিতে হবে। খালেদা জিয়া তিন দফা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেষেরবারের দুঃশাসনের কথা কি মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে? তবে অন্যদের ব্যবসাপাতি বন্ধ রাখতে বলে নিজের সব ব্যবসা খোলা রাখেন। এটা ভালো লক্ষণ। তিনি নিশ্চয় জানেন, তাঁর মতো বুদ্ধিমান বাংলাদেশে আরও আছে।
তারপর বাকি রইল ইসলাম-পছন্দ দলগুলো। সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’ লাইনটি কেন বাদ দেওয়া হলো, তার জন্য তারা হরতাল ডেকে রাস্তায় নেমেছে। যেখানে বিসমিল্লাহ দিয়ে সংবিধান শুরু আর রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে অন্য কিছুর কেন প্রয়োজন, তা বোঝার ক্ষমতা হয় তাদের নেই, অথবা তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা যতই তাদের খুশি করতে চান, তিনি সফল হবেন না।
সবশেষে জনগণ। তাদের হয়েছে যত মুশকিল। তাদের কথা বলার প্ল্যাটফর্ম নেই। তবে আছে নির্বাচনের সময় দলীয় মার্কায় একটি সিল মারা। সেটি তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র, গোপনে ব্যবহার করে এবং অন্য সবাইকে ঘায়েল করে দিতে পারে। দেখা যাক সামনের বার তারা তাদের সেই অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করে। তত দিন পর্যন্ত তাদের বিরোধী দল এবং তাদের মিত্রদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে হবে। তবে ভরসা এই, সবশেষে তাদেরই জয় হবে।
আবদুলমান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments