লাল-সবুজের পাশে-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে গাছ! by আনিসুল হক

এই দেশটা কি পুরোটাই অরণ্যে ঢাকা? আইভরি কোস্টের আবিদজান শহর থেকে আমরা চলেছি বুয়াকে শহরে। প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার পথের দুই ধারে চোখে পড়ল শুধু বন আর জঙ্গল। মানুষের বসতবাড়ি নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে দু-একটা ছোটখাটো বাজার। আর পথের ধারে মেয়েরা কলা, আনারস, সবজি ইত্যাদি সাজিয়ে রেখেছে। অনেকটা আমাদের দেশে পার্বত্য এলাকার পথের ধারে যেমনটা দেখা যায়, তেমন। তবে সড়ক খুবই উন্নত।


২৫ জানুয়ারি ২০১২। সকাল সকাল রওনা হয়েছি আমরা। পথের দুই ধারে আমগাছে আম আর মুকুল একই সঙ্গে ধরে আছে। সারা বছর একই রকম আবহাওয়ার কারণে এখানে নাকি সব সময় গাছে আম ফলে। শিমুলগাছও দেখা গেল কোথাও কোথাও। কাজুবাদামের জন্য এই দেশ বিখ্যাত।
পথের ধারে একটা জায়গায় খানিকটা বিরতি। দুজন কিশোর একটা ছোট্ট হরিণ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। খরগোশের চেয়ে বড় ইঁদুরও দেখা গেল মেরে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছে লোকজন, আগুতি নামের এই বিশালাকায় ইঁদুর এখানকার অধিবাসীদের প্রিয় খাদ্য।
আমাদের গাড়ি থামতে দেখে ছোট ছোট বালকের দল ছুটে এল। একটা ছেলের গায়ে বার্সালোনার জার্সি, তাতে লেখা মেসি। ফুটবল হলো পৃথিবীময় এক সর্বজনীন বিষয়। ওদের সঙ্গে ছবি তোলা হলো।
দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম বুয়াকে। এখানে বাংলাদেশ পুলিশের একটা দলের শিবির। ভেতরে দেখা গেল কাঁঠালগাছ। এই কাঁঠালগাছের বিচি দেশ থেকে বছর পাঁচেক আগে প্রথম ব্যাচের সদস্যরা এনেছিলেন। এখন সেই গাছে ফল ধরেছে। দুপুরের খাবারের সঙ্গে আমরা তাই এই জানুয়ারি মাসে খেতে পেলাম বাংলাদেশের কাঁঠাল। এই কাঁঠাল নাকি বিভিন্ন দেশের ও এখানকার মানুষের কাছে প্রিয় হয়েও উঠেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের বুয়াকে ক্যাম্পে আছেন ১২০ জন সদস্য। কনটিনজেন্ট কমান্ডার সিনিয়র এসপি দিদার আহম্মদ স্বাগত জানালেন আমাদের। প্রতিনিধিদলের নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সেলিম এবং সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মাহবুবুল হককে গার্ড অব অনার জানালেন পুলিশ সদস্যরা।
বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা তাঁদের কার্যক্রমের বর্ণনা উপস্থাপন করলেন পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে।
এখানেই দেখা হলো ডা. মোহাম্মদ মহিবুল হাসানের সঙ্গে। পুলিশের দলে আছেন তিনি। গত বছর তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন আবিদজান শহরের গলফ হোটেলে। এখানে প্রেসিডেন্ট ওয়াতারা থাকেন। পুলিশ দলকে ডাকা হয়েছিল যদি নিরস্ত্র জনতা গলফ হোটেলে চড়াও হয়, তবে সেটা মোকাবিলা করতে। ওখানে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মর্টার প্লাটুনও নিয়োজিত ছিল। ক্ষমতাচ্যুত বাগবোর অনুগত ইয়াং প্যাট্রিয়ট দল সেখানে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসমেত হামলা করে বসে। ৯ এপ্রিল ২০১১ পুলিশ কনটিনজেন্টের ডাক্তার মোহাম্মদ মহিবুল হাসানের উরুতে গুলি লাগে। তিনি নিজ খরচে দেশে ফিরে যান এবং চিকিৎসা শেষে আবার ফিরে এসেছেন। তাঁকে বলি, কেমন লেগেছিল যখন গুলি লাগল। তিনি বললেন, গুলি লাগার পর আর ভয় লাগেনি। দেশে ফোন করে স্ত্রীকে বলেছি, ভালো আছি। ও বলল, তোমাকে স্কাইপিতে দেখি? আমি বললাম, না, মাথাব্যথা। পরে ও টিভিতে দেখল, আমি গুলিবিদ্ধ, তখন ফোন করে বলল, মাথাব্যথার খবর কী?
এই তরুণ চিকিৎসকের মনোবল এখানে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। কারণ যুদ্ধের বিভীষিকা ভুলে তিনি আবার ফিরে এসেছেন সেই রণক্ষেত্রেই।
বাগবো বাহিনী ওই সময় গলফ হোটেলের সঙ্গে বাইরের সরবরাহের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ভেতরে বিভিন্ন দেশের সৈন্যদল, বাংলাদেশের মর্টার প্লাটুন এবং পুলিশ প্রায় না খেয়ে ছিলেন। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতো। আধাপেটা খাওয়া, যুদ্ধ, বিরামহীন টহলের কারণে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে ২৮ আগস্ট সিনিয়র এএসপি সাইদুর রহমান গত ২৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন।
এসব কিছু জানা গেল পুলিশের উপস্থাপনা থেকে।
বুয়াকে শহরে আরও আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিগন্যাল প্লাটুন। আছেন ১২ জন স্টাফ অফিসার, বহুজাতিক সেক্টর সদর দপ্তরে নিয়োজিত। পাঁচটি দেশের সেনাকর্তারা এই সদর দপ্তরে থাকেন বলে তাঁদের খাবারে পাঁচ দেশেরই স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেটা কেমন হয়, খেয়ে অবশ্য দেখা হয়নি।
আমরা বুয়াকে শহরে ঘুরছি। দেখতে পেলাম পরিত্যক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর সেখানে কোনো ছাত্র আসে না, ক্লাস হয় না। শ্রেণীকক্ষে গাছ গজিয়ে ছাদ ফুঁড়ে তা আকাশ স্পর্শ করতে চাইছে।
২০০২ সাল থেকে এই ওয়াতারা সমর্থক আর বাগাবো সমর্থকদের মধ্যে এই দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে।
এই দেশে সোনার খনি আছে। সেখানে এখনো সোনা উত্তোলন করা হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু মানুষের চোখে-মুখে দারিদ্র্যের চিহ্ন।
এখন যদি দেশটায় সত্যি সত্যি শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে, তাহলে হয়তো দেশটার উন্নতি হবে। আবার ছাত্রছাত্রীতে মুখর হয়ে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
পরিত্যক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে।

No comments

Powered by Blogger.