কণ্ঠস্বর-প্রত্যাশার সবটুকু পূরণ হয়নি by রাহাত খান
আমার ধারণা, মমতা ব্যানার্জির ব্যাপারে সঠিক হোমটাস্ক করতে ব্যর্থ হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দিলি্ল-ঢাকার সামগ্রিক আলোচনায় মূল চাবিকাঠি যাদের হাতে ছিল, সেই দু'জন উপদেষ্টা। মমতাকে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে রাজি করানোর মূল দায়িত্ব অবশ্যই ছিল দিলি্লর।
দিলি্ল সেই চেষ্টা করেছিল, নাকি কেন্দ্রের এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল_ তা জানা নেই। শুনেছি, দিলি্লর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে 'বেঙ্গলি হেটারে'র সংখ্যা নাকি একেবারে কম নয়
৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল ১১টা ৫৫ মিনিট, ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করতে দেখা গেল সাদা ও সোনালি রেখায় অঙ্কিত একটি বিশেষ বিমানকে।
বাইরে রোদের হাসি। ওড়াউড়ি করছিল জলজ প্রাণে ভরা বর্ষার বাতাস। নিচে ছিল লালগালিচা অভ্যর্থনার আয়োজন। ল্যান্ড করা বিশেষ বিমানের যিনি প্রথম প্রধান যাত্রী তিনি দরজায় সিঁড়ি লাগানোর পরপরই নেমে এলেন। ভারতের মান্যবর প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। বাংলাদেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবল্পুব্দকন্যা, হাস্যমুখী শেখ হাসিনা। কুশল বিনিময় এবং অন্যান্য ফর্মালিটিজ যথাবিহিত প্রতিপালিত হলো। ইতিহাস এবং রোদের ধলপ্রহর যেন এই অনন্য মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল।
দু'দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। যাকে গণ্য করা হয় ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক শক্তির রূপকার। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরামের চার মুখ্যমন্ত্রী। আরও আছেন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক_ সব মিলিয়ে ১৩৭ সদস্যের একটি দল। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন এবং ট্রানজিট ছাড়া নির্ধারিত প্রায় সব চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন হয়নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলে নিই, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দু'দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে আজই (৭.৯.১১) সফরসঙ্গীসহ সন্ধ্যার দিকটায় চলে যাচ্ছেন নিজের দেশে। বাংলাদেশে এটাই ছিল অত্যন্ত সৎ ও সজ্জন হিসেবে পরিচিত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।
বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত গিয়েছিলেন। দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী ও সহযোগিতার একটি নতুন সূত্র তিনিই প্রথম নানা আলোচনায় প্রকাশ করেন। সূত্রটি আন্তরিকতার সঙ্গে লুফে নিতে একটুও দেরি করেনি ভারত। বাংলাদেশে ট্রানজিট নিয়ে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে একটা ট্যাবু ছিল। বিশাল, বিপুল, শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে উন্নয়নে অনেকটা পিছিয়ে থাকা এবং ক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট বাংলাদেশের আদৌ কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে কি-না সেই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে ছিল। ভয় ছিল, বোয়াল মাছ বাগে পেলে পুঁটি মাছটি উদরস্থ করে ফেলে কি-না!
শেখ হাসিনা চিরদিনই সাহসী ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। সার্বভৌমত্ব ও সমস্বার্থের ভিত্তিতে যদি রচিত হয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, তাহলে ভয় বা আশঙ্কার কী কারণ থাকতে পারে! ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোকের যে ট্যাবু, তাও ভেঙে দিতে চাইলেন হাসিনা। তিনি সঙ্গতভাবে উপলব্ধি করেছেন বর্তমান সময়ে দেশে দেশে কানেকটিভিটি হচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সেরা উপায়। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
ঠিক হয়, বাংলাদেশের আমন্ত্রণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে আসবেন এবং দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান কিছু অমীমাংসিত বিষয়ের নিষ্পত্তি ছাড়াও তারা ট্রানজিট রূপরেখাকে চূড়ান্ত চুক্তিতে পরিণত করবেন। বিশ্ব ও উপমহাদেশীয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে একযোগে কাজ করার সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করবেন। ভারত থেকে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে কমপক্ষে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি সম্পন্ন করবেন, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশকে ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার চুক্তি করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
বলতেই হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের এমন একটি সূত্র ভারতকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে প্রবলভাবে উপকৃত হতে পারত দুই দেশই। তবে প্রত্যাশা সবসময়ই সাফল্যের দেখা পায় না। কিংবা বলা যায়, মনমোহনের ঢাকা সফরে যত দ্রুত যাবতীয় কর্মসূচি চুক্তি আকারে আসার এবং বাস্তবায়নের ধারায় যাওয়ার আশা করা হয়েছিল, তা হয়নি।
অথচ মনমোহনের সফরকে সফল করে তোলার কতই না চেষ্টা চলেছে গত দেড় বছরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে কূটনৈতিক কথা চালাচালি এবং চুক্তি স্বাক্ষরের কাগজপত্র তৈরির সর্বাধিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা এবং অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টাকে। দু'জনই বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তারা চেষ্টা করতে কম করেছেন_ এমনটা বলা যায় না। তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা যে সফল হয়েছে_ বলা যায় না এমন কথাও। বরং প্রশ্ন ওঠে_ দেড় বছর ধরে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব ও উপদেষ্টাদের সম্ভাব্য ব্যর্থতার মুখে দুশ্চিন্তার কোনো রেখা তো দেখা যায়নি। বিদেশে কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলা চলে। দেশের মানুষের সঙ্গেও কি একই ভাষায় কথা বলবেন তারা? এ রকম কূটনীতিক তো দুনিয়ার কোথাও নেই। বলতেই হয়, আমাদের আলোচ্য দু'জন উপদেষ্টা কূটনীতির জগতে একেবারে বিরল প্রজাতির।
প্রশ্ন ওঠে অবশ্যই। বিভিন্ন ইস্যুতে কোথায় কোথায় বাধা-বিপত্তি, কোথায় কোথায় সমস্যা তা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তত আলোচিত হতে পারত। সাংবাদিকদের সব খোলাসা করে না বলে অন্তত এইটুকু বলা যেত_ সমস্যা আছে, তবে উত্তরণের চেষ্টা হচ্ছে। এইটুকু বলার মধ্যে অন্তত দেশবাসীকে অতি প্রত্যাশিত না হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া যেত। তাতে সরকারই লাভবান হতে পারত।
দুঃখের বিষয়, গত দেড় বছরের নানামুখী আলোচনা ও কূটনৈতিক তৎপরতায় এমন একটা উল্লসিত ভাব দেখানো হয়েছে, যেন সব বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা হয়েই গেছে। এখন শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসার অপেক্ষা। এই রকম ভাব দেখিয়ে তারা যে নৈপুণ্যের বদলে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আসলে মমতা ব্যানার্জিকে পাঠ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। মমতা তার রাজ্যের স্বার্থ এতটুকু জলাঞ্জলি দেওয়ার পাত্রী নন। দিলি্লর যেমন উচিত ছিল মমতার সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন, ছিটমহল ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলে তাকে রাজি করানো। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের তেমনি উচিত ছিল সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ নিয়ে হলেও তিস্তার পানি বণ্টন, সীমানা সমস্যা, ছিটমহল ইত্যাকার ইস্যু নিষ্পত্তি করতে মমতার সহযোগিতা চাওয়া। বাংলাদেশের প্রতি মমতার একটা আলাদা টান আছে, যেমন ছিল বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর। আমার ধারণা, মমতা ব্যানার্জির ব্যাপারে সঠিক হোমটাস্ক করতে ব্যর্থ হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দিলি্ল-ঢাকার সামগ্রিক আলোচনায় মূল চাবিকাঠি যাদের হাতে ছিল, সেই দু'জন উপদেষ্টা।
মমতাকে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে রাজি করানোর মূল দায়িত্ব অবশ্যই ছিল দিলি্লর। দিলি্ল সেই চেষ্টা করেছিল, নাকি কেন্দ্রের এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল_ তা জানা নেই। শুনেছি, দিলি্লর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে 'বেঙ্গলি হেটারে'র সংখ্যা নাকি একেবারে কম নয়। দিলি্ল-ঢাকা আলোচনা প্রত্যাশিত সাফল্য যেন না পায়_ ভারতের রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং আমলাদের মধ্যে এমন লোকও তো আছে বলে শুনি।
হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য যে একেবারেই অর্জিত হয়নি, তা ঠিক নয়। ঢাকা বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পাবে ভারতের স্থলভূমির ওপর দিয়ে নেপাল-ভুটানের ট্রানজিট সুবিধা। যার দরুন উজ্জীবিত হবে মংলা বন্দর এবং বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। ঢাকা বৈঠকে চুক্তি হয়েছে_ ভারতের ভেতর থাকা বাংলাদেশের তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। সীমান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি হয়েছে_ বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্য বিনা শুল্কে রফতানি হতে পারবে ভারতে। ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও ভারতের সহায়তা দানের একটি মূল্যবান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
আমার মতে, ঢাকা-দিলি্ল বৈঠকের সাফল্য ততটা ফুটে উঠছে না দুটি কারণে। এক. একদিকে ভারতের তরফে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে অসম্মতি। অন্যদিকে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশের তরফে ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে বহুকাঙ্ক্ষিত ট্রানজিট সুবিধা না দেওয়া। দুই. বিশ্বের এবং উপমহাদেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে উভয় দেশই পারস্পরিক সমঝোতার আওতায় কাজ করছে। তবে এই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের আওতায় বিধিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
ক্ষতি দুই পক্ষেরই। তবে ট্রানজিট এবং জঙ্গিবাদ বেশি জরুরি দিলি্লর কাছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য মাত্র ১৭ মাইল করিডোর দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে হলে হাজার মাইল ঘুরে যেতে হয়। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে রাজ্যগুলোর কোনো কোনোটি খুবই সমৃদ্ধ। অথচ উন্নয়নের বিচারে ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে রাজ্যগুলো অনেকটা পিছিয়ে পড়া। দিলি্ল সরকার রাজ্যগুলোর যথাযথ উন্নয়নে যথেষ্ট আগ্রহী। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার জানে ও বোঝে, উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার দরুন সেখানে ক্ষোভ ও ক্রোধ দানা বাঁধছে দিন দিন। নাগা বিদ্রোহ, বোড়ো ও উলফাদের বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম এই ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকেই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের দূরত্ব কমতে পারে শুধু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল, জলপথ ও সড়কপথের ট্রানজিট সুবিধা পাওয়া গেলে।
ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে খুবই। তার দরুন ভারতের বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিধি তো কয়েকগুণ বাড়তেই পারে। তদুপরি চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ঘটতে পারে সহজেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপ্লবের সম্ভাবনা নিহিত ছিল ট্রানজিটে।
ঢাকা বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে_ তা ভাবার কারণ নেই। দু'দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সহযোগিতামূলক মনোভাব তো অক্ষুণ্নই আছে। ঘটনা যা ঘটেছে তা হচ্ছে দু'পক্ষের দরকষাকষি। আজ না হয় সম্পূর্ণটা পেলাম না। দু'পক্ষের স্বার্থ ও আগ্রহ থাকলে আগামীকাল সেটা তো পেতে পারি অবশ্যই। আমার ধারণা, মনমোহনের ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে একটা শুভ সূচনার সূত্রপাত করেছে। বৃত্ত একবার শুরু হলে সেটা শেষও হয়। আমি আশাবাদী।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল ১১টা ৫৫ মিনিট, ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করতে দেখা গেল সাদা ও সোনালি রেখায় অঙ্কিত একটি বিশেষ বিমানকে।
বাইরে রোদের হাসি। ওড়াউড়ি করছিল জলজ প্রাণে ভরা বর্ষার বাতাস। নিচে ছিল লালগালিচা অভ্যর্থনার আয়োজন। ল্যান্ড করা বিশেষ বিমানের যিনি প্রথম প্রধান যাত্রী তিনি দরজায় সিঁড়ি লাগানোর পরপরই নেমে এলেন। ভারতের মান্যবর প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। বাংলাদেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবল্পুব্দকন্যা, হাস্যমুখী শেখ হাসিনা। কুশল বিনিময় এবং অন্যান্য ফর্মালিটিজ যথাবিহিত প্রতিপালিত হলো। ইতিহাস এবং রোদের ধলপ্রহর যেন এই অনন্য মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল।
দু'দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। যাকে গণ্য করা হয় ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক শক্তির রূপকার। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরামের চার মুখ্যমন্ত্রী। আরও আছেন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক_ সব মিলিয়ে ১৩৭ সদস্যের একটি দল। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন এবং ট্রানজিট ছাড়া নির্ধারিত প্রায় সব চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন হয়নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলে নিই, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দু'দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে আজই (৭.৯.১১) সফরসঙ্গীসহ সন্ধ্যার দিকটায় চলে যাচ্ছেন নিজের দেশে। বাংলাদেশে এটাই ছিল অত্যন্ত সৎ ও সজ্জন হিসেবে পরিচিত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।
বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত গিয়েছিলেন। দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী ও সহযোগিতার একটি নতুন সূত্র তিনিই প্রথম নানা আলোচনায় প্রকাশ করেন। সূত্রটি আন্তরিকতার সঙ্গে লুফে নিতে একটুও দেরি করেনি ভারত। বাংলাদেশে ট্রানজিট নিয়ে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে একটা ট্যাবু ছিল। বিশাল, বিপুল, শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে উন্নয়নে অনেকটা পিছিয়ে থাকা এবং ক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট বাংলাদেশের আদৌ কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে কি-না সেই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে ছিল। ভয় ছিল, বোয়াল মাছ বাগে পেলে পুঁটি মাছটি উদরস্থ করে ফেলে কি-না!
শেখ হাসিনা চিরদিনই সাহসী ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। সার্বভৌমত্ব ও সমস্বার্থের ভিত্তিতে যদি রচিত হয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, তাহলে ভয় বা আশঙ্কার কী কারণ থাকতে পারে! ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোকের যে ট্যাবু, তাও ভেঙে দিতে চাইলেন হাসিনা। তিনি সঙ্গতভাবে উপলব্ধি করেছেন বর্তমান সময়ে দেশে দেশে কানেকটিভিটি হচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সেরা উপায়। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
ঠিক হয়, বাংলাদেশের আমন্ত্রণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে আসবেন এবং দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান কিছু অমীমাংসিত বিষয়ের নিষ্পত্তি ছাড়াও তারা ট্রানজিট রূপরেখাকে চূড়ান্ত চুক্তিতে পরিণত করবেন। বিশ্ব ও উপমহাদেশীয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে একযোগে কাজ করার সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করবেন। ভারত থেকে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে কমপক্ষে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি সম্পন্ন করবেন, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশকে ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার চুক্তি করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
বলতেই হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের এমন একটি সূত্র ভারতকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে প্রবলভাবে উপকৃত হতে পারত দুই দেশই। তবে প্রত্যাশা সবসময়ই সাফল্যের দেখা পায় না। কিংবা বলা যায়, মনমোহনের ঢাকা সফরে যত দ্রুত যাবতীয় কর্মসূচি চুক্তি আকারে আসার এবং বাস্তবায়নের ধারায় যাওয়ার আশা করা হয়েছিল, তা হয়নি।
অথচ মনমোহনের সফরকে সফল করে তোলার কতই না চেষ্টা চলেছে গত দেড় বছরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে কূটনৈতিক কথা চালাচালি এবং চুক্তি স্বাক্ষরের কাগজপত্র তৈরির সর্বাধিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা এবং অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টাকে। দু'জনই বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তারা চেষ্টা করতে কম করেছেন_ এমনটা বলা যায় না। তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা যে সফল হয়েছে_ বলা যায় না এমন কথাও। বরং প্রশ্ন ওঠে_ দেড় বছর ধরে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব ও উপদেষ্টাদের সম্ভাব্য ব্যর্থতার মুখে দুশ্চিন্তার কোনো রেখা তো দেখা যায়নি। বিদেশে কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলা চলে। দেশের মানুষের সঙ্গেও কি একই ভাষায় কথা বলবেন তারা? এ রকম কূটনীতিক তো দুনিয়ার কোথাও নেই। বলতেই হয়, আমাদের আলোচ্য দু'জন উপদেষ্টা কূটনীতির জগতে একেবারে বিরল প্রজাতির।
প্রশ্ন ওঠে অবশ্যই। বিভিন্ন ইস্যুতে কোথায় কোথায় বাধা-বিপত্তি, কোথায় কোথায় সমস্যা তা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তত আলোচিত হতে পারত। সাংবাদিকদের সব খোলাসা করে না বলে অন্তত এইটুকু বলা যেত_ সমস্যা আছে, তবে উত্তরণের চেষ্টা হচ্ছে। এইটুকু বলার মধ্যে অন্তত দেশবাসীকে অতি প্রত্যাশিত না হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া যেত। তাতে সরকারই লাভবান হতে পারত।
দুঃখের বিষয়, গত দেড় বছরের নানামুখী আলোচনা ও কূটনৈতিক তৎপরতায় এমন একটা উল্লসিত ভাব দেখানো হয়েছে, যেন সব বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা হয়েই গেছে। এখন শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসার অপেক্ষা। এই রকম ভাব দেখিয়ে তারা যে নৈপুণ্যের বদলে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আসলে মমতা ব্যানার্জিকে পাঠ করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। মমতা তার রাজ্যের স্বার্থ এতটুকু জলাঞ্জলি দেওয়ার পাত্রী নন। দিলি্লর যেমন উচিত ছিল মমতার সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন, ছিটমহল ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলে তাকে রাজি করানো। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের তেমনি উচিত ছিল সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ নিয়ে হলেও তিস্তার পানি বণ্টন, সীমানা সমস্যা, ছিটমহল ইত্যাকার ইস্যু নিষ্পত্তি করতে মমতার সহযোগিতা চাওয়া। বাংলাদেশের প্রতি মমতার একটা আলাদা টান আছে, যেমন ছিল বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর। আমার ধারণা, মমতা ব্যানার্জির ব্যাপারে সঠিক হোমটাস্ক করতে ব্যর্থ হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দিলি্ল-ঢাকার সামগ্রিক আলোচনায় মূল চাবিকাঠি যাদের হাতে ছিল, সেই দু'জন উপদেষ্টা।
মমতাকে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে রাজি করানোর মূল দায়িত্ব অবশ্যই ছিল দিলি্লর। দিলি্ল সেই চেষ্টা করেছিল, নাকি কেন্দ্রের এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল_ তা জানা নেই। শুনেছি, দিলি্লর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে 'বেঙ্গলি হেটারে'র সংখ্যা নাকি একেবারে কম নয়। দিলি্ল-ঢাকা আলোচনা প্রত্যাশিত সাফল্য যেন না পায়_ ভারতের রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং আমলাদের মধ্যে এমন লোকও তো আছে বলে শুনি।
হাসিনা-মনমোহন শীর্ষ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য যে একেবারেই অর্জিত হয়নি, তা ঠিক নয়। ঢাকা বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পাবে ভারতের স্থলভূমির ওপর দিয়ে নেপাল-ভুটানের ট্রানজিট সুবিধা। যার দরুন উজ্জীবিত হবে মংলা বন্দর এবং বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। ঢাকা বৈঠকে চুক্তি হয়েছে_ ভারতের ভেতর থাকা বাংলাদেশের তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। সীমান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি হয়েছে_ বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্য বিনা শুল্কে রফতানি হতে পারবে ভারতে। ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও ভারতের সহায়তা দানের একটি মূল্যবান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
আমার মতে, ঢাকা-দিলি্ল বৈঠকের সাফল্য ততটা ফুটে উঠছে না দুটি কারণে। এক. একদিকে ভারতের তরফে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে অসম্মতি। অন্যদিকে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশের তরফে ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে বহুকাঙ্ক্ষিত ট্রানজিট সুবিধা না দেওয়া। দুই. বিশ্বের এবং উপমহাদেশের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে উভয় দেশই পারস্পরিক সমঝোতার আওতায় কাজ করছে। তবে এই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের আওতায় বিধিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
ক্ষতি দুই পক্ষেরই। তবে ট্রানজিট এবং জঙ্গিবাদ বেশি জরুরি দিলি্লর কাছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য মাত্র ১৭ মাইল করিডোর দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে হলে হাজার মাইল ঘুরে যেতে হয়। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে রাজ্যগুলোর কোনো কোনোটি খুবই সমৃদ্ধ। অথচ উন্নয়নের বিচারে ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে রাজ্যগুলো অনেকটা পিছিয়ে পড়া। দিলি্ল সরকার রাজ্যগুলোর যথাযথ উন্নয়নে যথেষ্ট আগ্রহী। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার জানে ও বোঝে, উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার দরুন সেখানে ক্ষোভ ও ক্রোধ দানা বাঁধছে দিন দিন। নাগা বিদ্রোহ, বোড়ো ও উলফাদের বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম এই ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকেই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের দূরত্ব কমতে পারে শুধু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল, জলপথ ও সড়কপথের ট্রানজিট সুবিধা পাওয়া গেলে।
ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে খুবই। তার দরুন ভারতের বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিধি তো কয়েকগুণ বাড়তেই পারে। তদুপরি চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ঘটতে পারে সহজেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপ্লবের সম্ভাবনা নিহিত ছিল ট্রানজিটে।
ঢাকা বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে_ তা ভাবার কারণ নেই। দু'দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সহযোগিতামূলক মনোভাব তো অক্ষুণ্নই আছে। ঘটনা যা ঘটেছে তা হচ্ছে দু'পক্ষের দরকষাকষি। আজ না হয় সম্পূর্ণটা পেলাম না। দু'পক্ষের স্বার্থ ও আগ্রহ থাকলে আগামীকাল সেটা তো পেতে পারি অবশ্যই। আমার ধারণা, মনমোহনের ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে একটা শুভ সূচনার সূত্রপাত করেছে। বৃত্ত একবার শুরু হলে সেটা শেষও হয়। আমি আশাবাদী।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments