চারুশিল্প-স্বপ্ন রোপণের গল্প by জাফরিন গুলশান

সভ্যতার শুরুতে মানুষ ছবি এঁকেছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে—ইতিহাস এমন তত্ত্বের পক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছে। তারপর মানুষের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পচর্চার গতিপ্রকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে উত্তরের প্রচেষ্টাও অব্যাহত। শিল্পী, শিল্পকর্ম, শিল্পকর্মের প্রদর্শনী, দর্শক কিংবা সমালোচক বা শিল্পের ক্রেতা—এই শর্তগুলো এখন শিল্পের দুনিয়ার প্রাসঙ্গিকতা। এই চলমান প্রক্রিয়ায় বিকাশমানতার মধ্য দিয়ে ছবি এঁকে চলেছেন শিল্পীরা।


শিল্পীর সৃজনী চিন্তার ধারণা বা বিষয় এখন গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার নিজ সৃজন অনুভূতির সমান্তরালে। শিল্পী নিজে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আদিবাসী ‘চাকমা’ গোত্রে বেড়ে ওঠা মানুষ। সেই সঙ্গে অনেক আদিবাসীর জীবন ও সংস্কৃতি একদম কাছ থেকে দেখেছেন। ছোট থেকে বেড়ে ওঠা সময়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আঙ্গিকে শিল্পীর মানস গড়ে উঠেছে এবং শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নিয়ে ছবি আঁকছেন। গ্যালারি চিত্রকে ‘স্বপ্ন রোপণ’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে ‘ম্রো’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র তুলে এনেছেন। দীর্ঘদিন ম্রো জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাদের খুব কাছে থেকে দেখেছেন। বান্দরবানে বসবাসরত ম্রোরা খুব স্বতন্ত্র। শিকারি জাতি হিসেবে খ্যাত ছিল একসময়। ম্রোদের তৈরি পোশাক অন্যান্য আদিবাসীর তৈরি পোশাকের চেয়ে উন্নতমানের। ম্রো নারীরা একসময় শুধু নিচের অংশে ‘ওয়ানচা’ (একধরনের পরিধেয় বস্ত্র) পরত। ঊর্ধ্বাংশে থাকত রুপার ভারী অলংকার। পাহাড়ের সরল, সংগ্রামী বর্ণময় জীবন তাদের। কিন্তু বর্তমানে ম্রোদের জীবনের সংস্কৃতির সংকট দেখে শিল্পী ব্যথিত হয়েছেন। সুতার দাম বেশি বলে বাজারের ছাপা কাপড় পরে আজকাল। জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে বলে ম্রোরা এখন শিকার করতে পারছে না। মলিন জীবনে আগের মতো উৎসবমুখরতা নেই। অ্যাক্রিলিক, কোলাজ, মিশ্র মাধ্যম, চারকোল মাধ্যমে প্রায় ৫৫টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে থাকছে। প্রদর্শনী সম্পর্কে শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা বলেন, ‘এত দিন শো করেছি ৪১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আদিবাসীকে একত্র করে। এখন এক এক করে গোষ্ঠীগুলো ছবিতে ধরব। প্রায় ২৫ হাজার ম্রো রয়েছে। আমি ১৯৯৫ সাল থেকে তাদের কাছে গিয়েছি, থেকেছি, তাদের জীবন দেখেছি। খুব ভালো লেগেছে। পার্বত্য এলাকায় যেভাবে আদিবাসীদের জীবন হুমকির সম্মুখীন, আমার ভয় হয়, একসময় না শুধু “গল্প” হয়ে যায় তারা! আমি তাই একরকম ডকুমেন্টেশন করছি ভয় ও ভালোবাসা থেকেই, নতুন প্রজন্ম যেন জানতে পারে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সম্পর্কে।’
প্রদর্শনীর ক্যানভাসগুলো ধারণ করেছে আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষ ও তাদের জীবন। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, বলিষ্ঠ ড্রয়িংয়ের দক্ষতা যথেষ্ট সততার সঙ্গে উপস্থিত। ক্যানভাসের চিত্রতলে টেক্সচার বা বুনটের উপস্থিতি অনুভূতির বিকাশ ঘটায়, যেন পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তার আবহ জীবন। অধিকাংশ ছবিতে একটি ‘কেন্দ্রীয় চরিত্র’ বিদ্যমান। একে কেন্দ্র করে স্থান বিভাজন, রং বিভাজন, রেখার বিস্তৃতি ও বিভিন্ন কর্মের আগমন। শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রদর্শনী করার ক্ষেত্রে তিনি সময় নেন। কারণ তাঁকে যথেষ্ট বাড়ির কাজ (হোমওয়ার্ক) করতে হয়। এটি প্রায় ছয় বছর পর করা প্রদর্শনী। গ্যালারির একটি কক্ষের ক্যানভাসে স্বপ্ন রোপণের গল্প বর্ণনা করেছেন শিল্পী। ‘রোপণ’ সিরিজের ছবিগুলোতে দেখা যায়, বিভিন্ন ভঙ্গিতে, বিভিন্ন কম্পোজিশনে ম্রোরা গাছের চারা রোপণ করছে কিংবা এর আবহের অভ্যন্তরে আছে। চোখেমুখে স্বপ্ন আনার উজ্জ্বলতার দীপ্তি। শিল্পীর ভাষায়, ‘আমি আশাবাদী মানুষ। তাই আশাবাদী ছবি আঁকি। একই সঙ্গে বাঙালি ও পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের দেশ বাংলাদেশ। ওখানে বাঙালিদের সঙ্গে যে সমস্যাগুলো হয় আদিবাসীদের, সেটা পুরোটাই রাজনৈতিক। সরকারের দায়িত্ব এ সমস্যার মীমাংসা করা। আদিবাসীরা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে তাদের সংকট আরও তীব্র। আমার আশা, সরকার পার্বত্য সমস্যা সমাধান করবে।’ শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা এবারের প্রদর্শনীতে একটি স্থাপনাশিল্প করেছেন, যার শিরোনাম ‘শেষ পদচিহ্ন’। এটি ম্রোদের ধর্মগ্রন্থহীন অবস্থার কারণ নিয়ে করা, যা দীর্ঘদিন ধরে ‘গুরুবলি’ দেওয়ার মাধ্যমে পালন করা উৎসব। কনক চাঁপা চাকমা একজন গুণী শিল্পী। শক্তিশালী উপায়ে অভিব্যক্তিব্যাদী। বাস্তববাদী ঢং ও বিমূর্ত আঙ্গিকের মিশ্রণে সৃষ্ট তাঁর ছবিগুলো বাংলাদেশের একাডেমিক নিরীক্ষণস্বরূপ শিল্পচর্চা, অথচ বহুমাত্রায় উন্নীত, স্বভাবসুলভ সরল ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় নির্বাচিত বিষয়ের বলিষ্ঠতায়।
প্রদর্শনীটি ২৮ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে।

No comments

Powered by Blogger.