ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা, দেহের অঙ্গ বিক্রেতা ও আইনি ব্যবস্থা by ডা. এম এ করীম
মিডিয়ার সুবাদে আমরা অনেক অজানা খবর জানতে পারছি, এমনকি প্রান্তিক জনগণের খবরও (তবে সেটা হরহামেশা নয়)। আমার জেলার ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে দালালদের খপ্পরে পড়ে নিজেদের কিডনি বিক্রি করে দিচ্ছে; অথচ এ খবর আমি রাখিনি।
জেলার বললে ভুল হবে, আমার গ্রাম থেকে কালাই বেশি দূরের পথ নয়, মাত্র পাঁচ-সাত মাইল হবে। তারা কেন শরীরের অঙ্গ দিতে গেল এবং সে ব্যবসায় দালাল থেকে শুরু করে দেশের সংসদ সদস্য পর্যন্ত অনেকেই নাকি জড়িত! ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষের দোষ কী? কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ল, 'এ জীবনে পেয়েছি যে আঘাত হাজার/থাকবে না গতি তবু জীবনে চলার/রাতের শেষে দেখি এখনো আঁধার/আলোর নিশানা আমি খুঁজি বার বার/মানবো না হার আমি এই মোর পণ/তাতে যদি যায় যাক না জীবন/জীবনে বাঁচার জ্বালা হাজার হাজার/তবু কেন এত রঙ্গ আলোর বাহার/রাতের শেষে দেখি এখনো আঁধার/আলোর নিশানা আমি খুঁজি বার বার।' কালাইয়ের দরিদ্র ঋণগ্রস্ত মানুষ আলোর নিশানা খুঁজেছে বারবার। তাতে যদি জীবনও যায়, যাক। রাতের শেষে তাদের সকালের আলো দেখার কথা। তা না দেখে রাতের শেষে তারা এখনো আঁধার দেখছে। মানবজীবনে অভাব-অনটন, উত্থান-পতন, হাসি-কান্না, আঘাত-বঞ্চনা থাকবেই। এসব নিয়েই চলতে হয় পথ। এগুলো হচ্ছে চলার পথে সাথি। জীবন হচ্ছে বিমূর্ত বাস্তবতা। একে নিয়েই মানুষকে পথ চলতে হয়।জীবনকে বুঝতে হলে নিজেদের শিক্ষিত ও স্বনির্ভর করে তুলতে হবে। তা না হলে তারা জীবনকে বুঝতে পারবে না। তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে জীবনের নিগূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন। যারা নিরক্ষর, অসচেতন, অজ্ঞ ও দরিদ্র, তাদের পক্ষে জীবনের সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য কালাইয়ের মানুষ শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ (কিডনি) বিক্রি করে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। জানা গেছে, প্রায় পাঁচ বছর ধরে এ কাজ হচ্ছে। এটা তারা কেন করেছে? এনজিওর ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি, অভাবের তাড়না, অজ্ঞতা ও দালালচক্রের মিষ্টিমধুর কথাবার্তায় দেহের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ বিক্রি করতে তারা দ্বিধা বোধ করেনি। এর জন্য কি রাষ্ট্রের কোনো কিছু করণীয় নেই? দোষ কি শুধু তাদের? রাষ্ট্র এই ভাগ্যহত ঋণগ্রস্তদের জন্য কী করছে? এনজিওগুলোর তৎপরতায় নজরদারি থাকার কথা। চিকিৎসাসেবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পেঁৗছানোর কথা। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে তা পূরণ হতে দেখা যায় না। তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কাজির গরুর মতো, যা কাগজ-কলমে থাকে! গোয়ালে সে গরু পাওয়া ভার। আমাদের অনেক রাজনীতিক স্ববিরোধী। পাশাপাশি এই রাষ্ট্রটি কোথাও প্রবলভাবে উপস্থিত, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে অনুপস্থিত। বুর্জোয়া ও শ্রেণীস্বার্থে রাষ্ট্রকে অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক চেহারায় দেখা যায় না। তার চেয়ে অস্বাভাবিক চেহারায় তার উপস্থিতি জনমনে জন্ম দেয় হতাশার। সে কারণে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় সুদূরপ্রসারী চেতনার অভাবে। নৈতিক অবক্ষয় আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় চিকিৎসা কখনোই সেবা হিসেবে গণ্য হয় না। যতখানি সেবা হিসেবে, তার চেয়ে বেশি গণ্য হয় ব্যবসা হিসেবে। তাই দেখা যায়, নৈতিক অবক্ষয়ের সর্বগ্রাসী প্রভাব চিকিৎসার ওপরও পড়ছে। এর প্রকৃষ্ট নজির জয়পুরহাটের ১৮টি গ্রামের বিভিন্ন মানুষের কিডনি নিয়ে প্রতারণা ও ব্যবসা।
সাধারণত অস্ত্রোপচারের দুই সপ্তাহের মধ্যে কিডনিদাতাকে প্রথমবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হয়, তিন মাসের মাথায় দ্বিতীয়বার এবং ছয় মাস পর তৃতীয়বার। পরবর্তী সময়ে তিন বছর পর পর নিয়মিত কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিডনিদাতার প্রস্রাব, রক্ত ও পরমাণু চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অন্য কিডনির কার্যকারিতা ও অবস্থা নির্ণয় করেন এবং ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের নিয়মিত চেকআপ করার কথা বলা হলেও সেসব দালালের এখন আর কোনো খবর নেই। তাদের নিয়মিত চেকআপ করানো হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এসব রোগীর দিকে নজর রাখা একান্ত প্রয়োজন। তাঁদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। নজর না দিলে সমস্যা আরো প্রকট হবে। দাদন ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন এনজিওর ঋণ নিয়ে ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারায় কিডনি বিক্রেতাদের ঋণের বোঝা পাহাড়সম। কিন্তু কিডনি বিক্রি করার পরও দাদন ব্যবসায়ী ও এনজিওর জাল থেকে বের হতে পারছে না তারা। এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে চড়া সুদের বোঝা, যা চক্রাকারে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার প্রশ্ন, দেশে হচ্ছেটা কী? হাসপাতালে যদি কোনো কিছু ঘটে তাহলেই সব দোষ নন্দ ঘোষের ওপর পড়ে। কিন্তু দেশে যে দাদন ব্যবসায়ী ও কিছু এনজিওর কারণে প্রান্তিক মানুষ দেহের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ বিক্রি করছে, তার মূলে কেউ যেতে চায় না। হয়তো বলবেন, কোনো কোনো চিকিৎসকও এর সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি পেশায় ভালোমন্দ পেশাজীবী আছেন। আমি অস্বীকার করছি না যে চিকিৎসকরা সবাই ভালো। দু-একজন চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীর কারণে গোটা চিকিৎসকসমাজ তথা পেশার সুনাম ও মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক অনেক আছেন। অনেক চিকিৎসকের মহত্ত্ব ও চিকিৎসাসেবার কাহিনী আমাদের জানা আছে। নিজের খাওয়াদাওয়ার কথা চিন্তা না করে আজও অনেক চিকিৎসক মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। সোফেস্ট দার্শনিক সফোক্লিস যেমনটা বলেছেন, 'মানুষ হলো জগতের সবচেয়ে বড় অলৌকিকতা।' কাজেই স্বার্থান্বেষী মানুষ সর্বত্র বিরাজমান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত, যাতে সাধারণ মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তার নিশ্চয়তা দেওয়া। শুধু চিকিৎসক নয়, সমাজের এ অবক্ষয়ের জন্য রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সবাই দায়ী। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন বলবৎ আছে। কিন্তু এই অপরাধে কারো শাস্তি হয়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। আগেই বলেছি, আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। আইন থেকেও যদি তার প্রয়োগ না হয়, তাহলে সে আইন থেকে জনগণের কী লাভ? মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯-এর ৯ ধারায় বলা আছে, 'অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুস্থ-স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি অন্যের দেহে সংযোজনযোগ্য কিডনি, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, চর্ম ও টিস্যু ক্রয়-বিক্রয়-বিনিময়ে কোনো সুবিধা লাভ, সেই উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন প্রদান ও প্রচার চালাতে পারবে না।' একই আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী, এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় প্রকার দণ্ডই হবে। আইনে আরো বলা হয়েছে, কেউ যদি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কিডনি বিক্রি করে তাহলে দাতা ছাড়াও ক্রেতা, সহায়তাকারী, দালাল ও কিডনি সংযোজনের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। এখানে প্রশ্ন, জয়পুরহাটের যেসব কিডনিদাতা কিডনি দিয়েছেন, তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা ও নৈতিকতাবোধ ততটা প্রকট নয়। তা ছাড়া ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা থেকেই তাঁরা এ কাজটি করেছেন।
১৯৯৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট কিডনি সংযোজিত হয়েছে ৯৬০ জনের। দেশে হয়েছে ৬০০ জনের, বিদেশে হয়েছে ৩৬০ জনের (তথ্য : নেফ্রোলজি সোসাইটি) এবং তা করা হয়েছে ১৯৯৯ সালের আইনের আওতায়। তবু চিকিৎসকরা এ দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। চিকিৎসকসমাজের বৃহৎ সংগঠন এ ব্যাপারে সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছে। সারবত্তা হলো, যারা প্রকৃত অপরাধী, তাদের বিচার হোক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ সতর্কতাও অবলম্বন করা প্রয়োজন, দেশে লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপনের ফলে এ দেশে উচ্চতর চিকিৎসার পথ প্রশস্ত হচ্ছে, মানুষকে আর বিদেশে যেতে হচ্ছে না, বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় থেকে দেশ রেহাই পাচ্ছে। সেই যাত্রা কেউ যেন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। তাই আমি মনে করি, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকের জন্য চিকিৎসকসমাজকে দায়ী না করে সেই অসাধু ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকদের শাস্তি হোক। গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষ যে প্রেক্ষাপটে নিজের দেহের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিল, তা খতিয়ে দেখা হোক। দরিদ্র মানুষ স্বনির্ভরতার জন্য বা খুব জরুরি প্রয়োজনে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে; কিন্তু সে ঋণ তাদের অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে জীবনকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, এর কারণ খুঁজে বের করা। তাই সরকারের উচিত হবে, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা। এটা আমি অস্বীকার করছি না যে সরকারের পাশাপাশি এনজিও দেশ ও জনগণের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এনজিওগুলো যেমন দেশ ও সমাজের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছে, তেমনি অনেক সময় তাদের কার্যক্রমের ধরন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এনজিওগুলো তাদের ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে দেয় অর্থের ওপর ২৪ থেকে ৩৬ শতাংশ হারে সুদ আদায় করে। ফলে ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে যেকোনো পথ অবলম্বন করছে। দেশে এখনো ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার কোনো যুগোপযোগী ও শক্তিশালী নীতিমালা প্রণীত হয়নি। তাই এনজিওগুলোর কাজের তদারকি এবং এ জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, জীবন চলার পথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এ দেশের মানুষকে। রাষ্ট্র কতটুকু দায়িত্ব নিচ্ছে? আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে মানুষ অনৈতিক কাজ করতে আরো উৎসাহী হচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মানুষের কশাঘাতে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারসহ দেশের সধীসমাজ, পুলিশ ও চিকিৎসকসমাজকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও কলাম লেখক
No comments