মনমোহন সিংয়ের সফর-মেঘ কেটে যাক, ফুটুক আলো by গোলাম সারওয়ার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরম বন্ধু ১৯৭১ সালের ভারত ও আজ ২০১১ সাল ৪০ বছরের পরের ভারত এক নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতিতে তখন ভারতের ভূমিকা ছিল অনেকটা গৌণ। বিশ্বসভায় একদা মৃদুকণ্ঠ ভারত আজ আপনশক্তিতে উচ্চকণ্ঠ। বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রাহ্য নয়, অনেকটা সমীহ করতে এখন ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলো অভ্যস্ত।
ভারতের এই অবস্থানগত বিস্ময়কর উত্থানের প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশীদের প্রতি তার অতীতের মনোভঙ্গি পরিবর্তনের দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে
আজ ২২ ভাদ্র। আশা করছি আজও হালকা মেজাজের সাদা মেঘ খেয়ালি মনে শুভ্র শরতের আকাশজুড়ে ঘুরে বেড়াবে। ফসলি মাঠের হৃদয়ের ভেতরে প্রবহমান ছোট নদীর দুই তীরের কাশবন 'ফুলে ফুলে সাদা' হয়ে সি্নগ্ধ আলো ছড়াবে। ষড়ঋতুর এই বাংলায় প্রিয় শরতের আনন্দায়িতায় আমরা আজ স্বাগত জানাব মৃদুভাষী, নিরহঙ্কার বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু মনমোহন সিংকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। দেড় বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ মনমোহন সিংয়ের সফরের প্রতীক্ষায়। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে 'উপযুক্ত সময়ে' ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের কথা ঘোষণা করা হয়। এতদিন পর সেই 'উপযুক্ত সময়' এলো। মনমোহন সিং তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে 'ঐতিহাসিক' বলে মন্তব্য করেছিলেন। মনমোহনের এই সফরের তাৎপর্য সামগ্রিকতার আলোকেই আমরা দেখতে চাই।
সংক্ষিপ্ত সফর সন্দেহ নেই। দিনের হিসেবে দু'দিন। ঘণ্টার হিসেবে মাত্র ৩০ ঘণ্টা। সকলের প্রত্যাশা, এ সময়েই দু'দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা সংযোজনের লক্ষ্য নিয়ে সমস্যার সমাধান হবে। জটিল কিছু সমস্যা সমাধানের পথরেখা তৈরি হবে।
এই রচনাটি যখন শেষ তখন জানলাম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। এটি নিঃসন্দেহে একটি বেদনাদায়ক সংবাদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরম বন্ধু ১৯৭১ সালের ভারত ও আজ ২০১১ সাল ৪০ বছরের পরের ভারত এক নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতিতে তখন ভারতের ভূমিকা ছিল অনেকটা গৌণ। বিশ্বসভায় একদা মৃদুকণ্ঠ ভারত আজ আপনশক্তিতে উচ্চকণ্ঠ। বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রাহ্য নয়, অনেকটা সমীহ করতে এখন ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলো অভ্যস্ত। ভারতের এই অবস্থানগত বিস্ময়কর উত্থানের প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশীদের প্রতি তার অতীতের মনোভঙ্গি পরিবর্তনের দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। প্রতিবেশীদের পশ্চাতে রেখে সম্মুখপানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলার মানসিকতা যে ভারতের নেই_ সেই কথা ভারতের বিজ্ঞ রাজনীতিকরা অধুনা বলতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেননও ঢাকায় সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে ভারতের এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির কথাই জানালেন। তিনি বললেন, দাদাগিরি নয়, ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী দিল তা বিবেচ্য নয়_ ভারত যা কিছু সম্ভব তাই দিতে প্রস্তুত থাকবে। অন্য অনেকের মতোই আমার বিশ্বাস, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সংক্ষিপ্ত সফরেই ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে দৃশ্যমান হবে।
জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছাড়া নিছক দ্বিপক্ষীয় সফর বিনিময়ে মনমোহন সিংয়ের দারুণ অনাসক্তি। 'রিটার্ন ভিজিট' বা ফিরতি সফরে তার অনাগ্রহ বিদেশের সঙ্গে সাধারণ কূটনৈতিক সৌজন্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার নীতিনির্ধারকদের কিছুই করার নেই। তবে তার বাংলাদেশ সফর নিছক 'সৌজন্য সফর' নয়, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই বাংলাদেশের। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যার তালিকা সকলের জানা। পক্ষকাল ধরে গণমাধ্যমে সংক্ষেপে, সবিস্তারে, বিশেষ আয়োজনে সমস্যার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে। ভারত বিশেষজ্ঞরা সফরের তাৎপর্য নিয়ে বিশদ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এসব বক্তব্যে আশার আলো ফুটে উঠেছে। কেউ কেউ হতাশা, নিরাশা ও সন্দেহের কথাও বলেছেন।
বিএনপির নীতি অবস্থান
নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর যে মারণাস্ত্রটি বিএনপির খুব প্রিয় তা হলো তীব্র ভারত বিরোধিতা। নানা অপপ্রচারে তারা একদা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে যে অনেকটা ভারতবিদ্বেষী করে তুলতে পেরেছিলেন, তা ঐতিহাসিক সত্য। একাধিক নির্বাচনে এই ব্রহ্মাস্ত্রটি তাদের ক্ষমতার মসনদে বসাতে সাহায্য করেছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনে সেই ব্রহ্মাস্ত্রটি অকার্যকর হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগ, সুশীল সমাজের নিরন্তর প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের মন থেকে 'ভারত জুজু' অনেকটা অপসৃত হওয়ায় বিএনপির এই ট্রাম্পকার্ডটি কাজে লাগেনি। ততদিনে ভারতই বিশ্বের নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ইউপিএ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরাজমান বিভ্রান্তি দূর করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী স্লোগানে এখন আর সাধারণ মানুষ খুব একটা সাড়া দেয় না। মুখে ভারত বিরোধিতার ঈষৎ উত্তাপ থাকলেও বিএনপিও এখন দিলি্লর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে খুব একটা অনাগ্রহী নয় বলেই অনেকের বিশ্বাস। সম্প্রতি ভারত সম্পর্কে বেফাঁস কথা বলে দলের প্রভাবশালী নেতা গয়েশ্বর রায় খালেদা জিয়ার কড়া ধমকও খেয়েছিলেন। কাল বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মনমোহনের সাক্ষাৎ একেবারে মামুলি নাও হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়তো এ কথা খালেদা জিয়াকে জানাবেন যে, ভারত বিশেষ কোনো সরকারের সঙ্গেই নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কে আগ্রহী। বিএনপি বৃহৎ জনসমর্থিত একটি দল। তারা নিশ্চয়ই সময়ের কণ্ঠস্বর নির্ভুলভাবেই শুনতে পাচ্ছেন।
খোলামেলা আলোচনা
অনেকে মনে করেন, ট্রানজিট, পানি বণ্টন, সীমান্তসীমা নির্ধারণ, ছিটমহলের ন্যায় ইস্যুগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা শ্রেয় ছিল। সম্প্রতি সমাপ্ত সংসদ অধিবেশন কিছুটা প্রলম্বিত করে সেখানেও মনমোহনের সফর নিয়ে জোরালো আলোচনা হতে পারত। তবে সঙ্গত প্রশ্ন থেকেই যায়, বিরোধী দল ছাড়া সংসদে একতরফা আলোচনায় কী লাভ হতো? সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সংসদ বর্জন করছে বিএনপি। দলের বৃহদাংশের মতামতও হাইকমান্ড গ্রাহ্য করছেন না। জাতীয় স্বার্থের কথা না ভেবে শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে সংবাদপত্রে বড় শিরোনামের সংবাদই সৃষ্টি করা যায়। এর বেশি কিছু নয়। অপরদিকে মনমোহন সিং যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী সেই ভারতের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আগাগোড়াই দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছে। সম্প্রতি লোকপাল বিল নিয়ে আন্না হাজারের অনশনে বিজেপি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। আন্না যখন সংসদীয় রীতিনীতির বাইরে তার ইচ্ছামতো একটি বিল পাস করানোর জন্য আমরণ অনশনে গিয়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলেন, তখন বিজেপি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে সরকারের নীতি অবস্থান সমর্থন করল। তাদের যুক্তি : ভারতের সুদীর্ঘ দিনের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ভাঙার আন্দোলনে তারা সায় দিতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কী হতো? এ প্রশ্নের জবাব আমাদের সকলেরই জানা।
ট্রানজিট
বিএনপি ও সুশীল সমাজের একাংশের দারুণ সন্দেহ ট্রানজিট নিয়ে। তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে জোর গলায় এই মুহূর্তে তেমন কিছু বলার নেই তাদের। তবে শুষ্ক মৌসুমে 'গ্যারান্টি ক্লজ' রাখার দাবিটি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রানজিটের ব্যাপারে সৃষ্ট সংশয় দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে নিজেদের স্বার্থেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে মানুষ ও পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচল অনিবার্য প্রয়োজন। আপন স্বার্থরক্ষা করেই এই প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ভারত যে বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে 'সেভেন সিস্টার্সে' তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করবে না তা বারবার উচ্চারণ করেছে। ট্রানজিট রুট সামরিক কাজে ব্যবহার না করার আশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে। 'সেভেন সিস্টার্সে' বাংলাদেশের ঈষৎ বাণিজ্যিক স্বার্থহানি হলেও ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশ গোটা ভারতের পণ্য পরিবহন সুবাদে যে শতগুণ আর্থিক স্বার্থ অর্জন করবে তা বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। এরপরও ট্রানজিট নিয়ে সংশয় হয়তো শতভাগ দূর হবে না। ট্রানজিট প্রসঙ্গে সংসদে, সংসদের বাইরে, রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করতে পারত সরকার। শুধু ট্রানজিট নয়, ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক, সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হবে তা প্রকাশ করে খোলামেলা আলোচনা ছিল বাঞ্ছনীয়। অকারণ সংশয় জিইয়ে রাখলে অসত্যই ডালপালা বিস্তার করে।
বর্তমান বিশ্বে বল্পুব্দত্বের সম্পর্ক শুধু সরকারে-সরকারেই হয় না। মৈত্রী ও সুসম্পর্কের জাগরণ সৃষ্ট হয় নানা স্তরে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে শুধু মন্ত্রীদের সফর এবং কদাচিৎ প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সফর বিনিময়েই দেশে দেশে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় হয় না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ের মধ্য দিয়ে, পরস্পরকে জানার মধ্য দিয়েই সম্পর্ক নিবিড় হয়। এ সত্য উভয় দেশের সরকারকে বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভিসা পেতে যে জটিলতা ও দুর্ভোগ রয়েছে তাও যথাসময়ে দূর করার বিষয় ভারতকে ভাবতে হবে। নানা পর্যায়ে দু'দেশের প্রতিনিধিদের নিয়মিত সফর বিনিময়ও জরুরি।
একটি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ
প্রসঙ্গটি সম্ভবত গুরুতর নয়। তবে স্পর্শকাতর। ভারতের অসংখ্য টিভি চ্যানেলের বিনোদনের শোভন-অশোভন নানা উপচারে বাংলাদেশের কোটি কোটি গৃহকোণ আমোদিত। অনেকে রাগ করে বলেন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। বিশ্বের উন্মুক্ত আকাশকে ধমক দিয়ে লাভ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারতীয় টিভি চ্যানেলের হিন্দি ও বাংলা ধারাবাহিকে মনপ্রাণ সঁপে দেওয়া গৃহবধূদেরও ধমক দিয়ে লাভ নেই। এই নির্মম বাস্তবতা মনে রেখেই আমাদের বিকাশমান ('অতি' বিশেষণটি কি যোগ করব?) টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নিজেদের আরও দর্শকপ্রিয় করে তুলতে হবে। কোটি কোটি বাংলাদেশি ভারতীয় চ্যানেল দেখছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে দেখানো হচ্ছে না। গত কয়েক বছর একাধিকবার ভারত সফরকালে বাংলাদেশের সম্পাদকরা ভারতের উচ্চ পর্যায়ে প্রসঙ্গটি তুলেছেন। ভারতীয় নেতৃত্ব ও শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একান্তই বেসরকারি কেবল অপারেটরদের ব্যাপার। তাদের কিছু করণীয় নেই। বক্তব্যে হয়তো যুক্তি আছে। তবে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে কেবল অপারেটরদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার সময় এ প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করা যেতে পারে। অবিশ্বাস্য হলেও নিদারুণ সত্য যে, আপনি ইচ্ছা করলেই ভারত থেকে কোনো বই, পত্রপত্রিকা আনতে পারবেন না। নিষিদ্ধ। সম্ভবত ষাটের দশকে এই দুষ্কর্মটি করে গেছেন আইয়ুব খান। ভারতও বদলা নিয়েছে। আমরা নানা স্তরে প্রসঙ্গটি তুলেছি, সুরাহা হয়নি। এবার কি সুরাহা হবে। ভারতের প্রচণ্ড শক্তিশালী মিডিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের দারুণ ক্ষোভ রয়েছে। পরম বল্পুব্দ নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় গণমাধ্যমের দারুণ আগ্রহের কথা আমরা সেখানকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের কাছ থেকে শুনতে পাই। বাস্তবচিত্র কিন্তু একেবারেই বিপরীত। ভারতের পত্রপত্রিকায় সারা বছর প্রতিবেশী বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ জন্য আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ভারতের পত্রপত্রিকা এতটা আত্মনিমগ্ন যে তারা প্রতিবেশীদের দিকে চোখ মেলে তাকাবারই ফুরসত পায় না। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রায় শত সদস্যের মিডিয়া প্রতিনিধি আসছেন। আশা করছি, দিন কয়েকের উন্মাদনার পর তারা যথারীতি বাংলাদেশকে ভুলে যাবেন।
বাণিজ্য ঘাটতি
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ উল্লেখ না করাই শ্রেয়। এ যেন এক দারুণ লজ্জা। ভারতীয় পণ্যে বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে গেছে বলে যারা অহর্নিশ মাথা চাপড়ান তারাও ভালো করে জানেন, ভারত থেকে জরুরি পণ্য না এলে বাংলাদেশে বাজার বিপর্যয় ঘটে। কাঁচামাল না হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমাদের রফতানি পণ্য এতই সীমিত যে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেললেও পরিস্থিতির বড় একটা উন্নতি ঘটবে না। এর ওপর রয়েছে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে শুল্ক ও অশুল্ক নানা বাধা। এ বাধা দূর হলে এই বাণিজ্য ঘাটতির কিছুটা উপশম হবে। এই মুহূর্তে আমাদের বড় ভরসা, আমাদের বিশ্বজয়ী পোশাক খাত। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হলে বাণিজ্য ঘাটতির ক্ষেত্রে একটি স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মনমোহনের সফরে এ ক্ষেত্রে আমরা একটি বড় অর্জন প্রত্যাশা করি।
নিরামিষ নয়, আমিষ উপচার
আমার ধারণা ছিল, মনমোহন সিংয়ের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ভোজসভার আয়োজন করেছেন তার খাদ্য তালিকায় নিরামিষের নানা উপচার থাকবে। সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সজল জাহিদের এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি আমার ধারণাটিই ভুল প্রতিপন্ন করেছে। তার জন্য খাবারের যে তালিকাটি দিলি্ল সযত্নে প্রস্তুত করেছে, তাতে পাঁচতারা হোটেলের প্রথাসিদ্ধ আমিষ খাবারের ছড়াছড়ি। আমি খুশি হতাম মেন্যুতে 'ইলিশ মাছের পাটিসাপটা' জাতীয় কিছু রাখা হলে। ইলিশ মাছের পাটিসাপটা, সে আবার কী! সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্নটি পাঠকের মনে জাগ্রত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আমার একটি অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। গত বছর ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদকের সঙ্গে আমার ভারত সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল। কলকাতা সন্দর্শন ছাড়া বাঙালির ভারত ভ্রমণ যে ষোলআনাই মিছে তা পাদটীকাসহ বোঝাবার প্রয়োজন নেই। তখন ইলিশের ভরা মৌসুম। বাংলাদেশের ইলিশের ম-ম গন্ধে কলকাতার অভিজাত থেকে শুরু করে সর্বস্তরের হোটেলে যেন মোহময় পরিবেশ। ইলিশের নানা পদের তালিকায় দেখলাম 'ইলিশের পাটিসাপটা'। রীতিমতো চমকে উঠলাম। বাংলাদেশে ইলিশের কত বাহারি পদ। সে তালিকায় 'ইলিশের পাটিসাপটা' বলে কিছু নেই। মনমোহনের আমিষে অরুচি না থাকলেও মাদাম মনমোহন কিন্তু ষোলআনাই নিরামিষভোজী।
এ কী করলেন 'দিদি'!
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি শেষ পর্যন্ত তার স্বভাবসুলভ নাটকটি করলেন। তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের দাবি অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। মমতার ভেটোর কারণে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের ওপর কালো ছায়া পড়েছে। মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের সংবাদপত্র যেভাবে উন্মাতাল হয়েছিল তাতে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি অন্যায্য ছিল না যে, মমতা বাংলাদেশেরই কোনো রাজনীতিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একান্ত প্রিয় মমতাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ৪২ বছরের বাম শাসনের দুর্গ তছনছ করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করায় মমতা ব্যানার্জি প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছিলেন পাক্ষিক 'দেশ'-এর বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুমন সেনগুপ্ত। তাকে উদৃব্দত করি :'এক নারী, যিনি চটুলা নয়না নন অথচ তার চোখের দৃষ্টিতে টুকরো টুকরো স্বপ্ন গাঁথা আছে। শহরের প্রান্তসীমার এক চিলতে ঘরের এই বাসিন্দার স্বপ্নদৃষ্টি কী প্রখর! খরতাপবাহী রৌদ্রের মতো তেজি দুটি চোখে অফুরান শক্তির সম্ভাবনা।' তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে বাদ সেধে তিনি কি সেই 'অফুরান শক্তি'ই প্রদর্শন করলেন?
গোলাম সারওয়ার :সম্পাদক, সমকাল
আজ ২২ ভাদ্র। আশা করছি আজও হালকা মেজাজের সাদা মেঘ খেয়ালি মনে শুভ্র শরতের আকাশজুড়ে ঘুরে বেড়াবে। ফসলি মাঠের হৃদয়ের ভেতরে প্রবহমান ছোট নদীর দুই তীরের কাশবন 'ফুলে ফুলে সাদা' হয়ে সি্নগ্ধ আলো ছড়াবে। ষড়ঋতুর এই বাংলায় প্রিয় শরতের আনন্দায়িতায় আমরা আজ স্বাগত জানাব মৃদুভাষী, নিরহঙ্কার বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু মনমোহন সিংকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। দেড় বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ মনমোহন সিংয়ের সফরের প্রতীক্ষায়। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে 'উপযুক্ত সময়ে' ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের কথা ঘোষণা করা হয়। এতদিন পর সেই 'উপযুক্ত সময়' এলো। মনমোহন সিং তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে 'ঐতিহাসিক' বলে মন্তব্য করেছিলেন। মনমোহনের এই সফরের তাৎপর্য সামগ্রিকতার আলোকেই আমরা দেখতে চাই।
সংক্ষিপ্ত সফর সন্দেহ নেই। দিনের হিসেবে দু'দিন। ঘণ্টার হিসেবে মাত্র ৩০ ঘণ্টা। সকলের প্রত্যাশা, এ সময়েই দু'দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা সংযোজনের লক্ষ্য নিয়ে সমস্যার সমাধান হবে। জটিল কিছু সমস্যা সমাধানের পথরেখা তৈরি হবে।
এই রচনাটি যখন শেষ তখন জানলাম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। এটি নিঃসন্দেহে একটি বেদনাদায়ক সংবাদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরম বন্ধু ১৯৭১ সালের ভারত ও আজ ২০১১ সাল ৪০ বছরের পরের ভারত এক নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতিতে তখন ভারতের ভূমিকা ছিল অনেকটা গৌণ। বিশ্বসভায় একদা মৃদুকণ্ঠ ভারত আজ আপনশক্তিতে উচ্চকণ্ঠ। বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রাহ্য নয়, অনেকটা সমীহ করতে এখন ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলো অভ্যস্ত। ভারতের এই অবস্থানগত বিস্ময়কর উত্থানের প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশীদের প্রতি তার অতীতের মনোভঙ্গি পরিবর্তনের দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। প্রতিবেশীদের পশ্চাতে রেখে সম্মুখপানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলার মানসিকতা যে ভারতের নেই_ সেই কথা ভারতের বিজ্ঞ রাজনীতিকরা অধুনা বলতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেননও ঢাকায় সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে ভারতের এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির কথাই জানালেন। তিনি বললেন, দাদাগিরি নয়, ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী দিল তা বিবেচ্য নয়_ ভারত যা কিছু সম্ভব তাই দিতে প্রস্তুত থাকবে। অন্য অনেকের মতোই আমার বিশ্বাস, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সংক্ষিপ্ত সফরেই ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে দৃশ্যমান হবে।
জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছাড়া নিছক দ্বিপক্ষীয় সফর বিনিময়ে মনমোহন সিংয়ের দারুণ অনাসক্তি। 'রিটার্ন ভিজিট' বা ফিরতি সফরে তার অনাগ্রহ বিদেশের সঙ্গে সাধারণ কূটনৈতিক সৌজন্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার নীতিনির্ধারকদের কিছুই করার নেই। তবে তার বাংলাদেশ সফর নিছক 'সৌজন্য সফর' নয়, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই বাংলাদেশের। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যার তালিকা সকলের জানা। পক্ষকাল ধরে গণমাধ্যমে সংক্ষেপে, সবিস্তারে, বিশেষ আয়োজনে সমস্যার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে। ভারত বিশেষজ্ঞরা সফরের তাৎপর্য নিয়ে বিশদ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এসব বক্তব্যে আশার আলো ফুটে উঠেছে। কেউ কেউ হতাশা, নিরাশা ও সন্দেহের কথাও বলেছেন।
বিএনপির নীতি অবস্থান
নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর যে মারণাস্ত্রটি বিএনপির খুব প্রিয় তা হলো তীব্র ভারত বিরোধিতা। নানা অপপ্রচারে তারা একদা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে যে অনেকটা ভারতবিদ্বেষী করে তুলতে পেরেছিলেন, তা ঐতিহাসিক সত্য। একাধিক নির্বাচনে এই ব্রহ্মাস্ত্রটি তাদের ক্ষমতার মসনদে বসাতে সাহায্য করেছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনে সেই ব্রহ্মাস্ত্রটি অকার্যকর হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগ, সুশীল সমাজের নিরন্তর প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের মন থেকে 'ভারত জুজু' অনেকটা অপসৃত হওয়ায় বিএনপির এই ট্রাম্পকার্ডটি কাজে লাগেনি। ততদিনে ভারতই বিশ্বের নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ইউপিএ সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরাজমান বিভ্রান্তি দূর করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী স্লোগানে এখন আর সাধারণ মানুষ খুব একটা সাড়া দেয় না। মুখে ভারত বিরোধিতার ঈষৎ উত্তাপ থাকলেও বিএনপিও এখন দিলি্লর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে খুব একটা অনাগ্রহী নয় বলেই অনেকের বিশ্বাস। সম্প্রতি ভারত সম্পর্কে বেফাঁস কথা বলে দলের প্রভাবশালী নেতা গয়েশ্বর রায় খালেদা জিয়ার কড়া ধমকও খেয়েছিলেন। কাল বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মনমোহনের সাক্ষাৎ একেবারে মামুলি নাও হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়তো এ কথা খালেদা জিয়াকে জানাবেন যে, ভারত বিশেষ কোনো সরকারের সঙ্গেই নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কে আগ্রহী। বিএনপি বৃহৎ জনসমর্থিত একটি দল। তারা নিশ্চয়ই সময়ের কণ্ঠস্বর নির্ভুলভাবেই শুনতে পাচ্ছেন।
খোলামেলা আলোচনা
অনেকে মনে করেন, ট্রানজিট, পানি বণ্টন, সীমান্তসীমা নির্ধারণ, ছিটমহলের ন্যায় ইস্যুগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা শ্রেয় ছিল। সম্প্রতি সমাপ্ত সংসদ অধিবেশন কিছুটা প্রলম্বিত করে সেখানেও মনমোহনের সফর নিয়ে জোরালো আলোচনা হতে পারত। তবে সঙ্গত প্রশ্ন থেকেই যায়, বিরোধী দল ছাড়া সংসদে একতরফা আলোচনায় কী লাভ হতো? সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সংসদ বর্জন করছে বিএনপি। দলের বৃহদাংশের মতামতও হাইকমান্ড গ্রাহ্য করছেন না। জাতীয় স্বার্থের কথা না ভেবে শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে সংবাদপত্রে বড় শিরোনামের সংবাদই সৃষ্টি করা যায়। এর বেশি কিছু নয়। অপরদিকে মনমোহন সিং যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী সেই ভারতের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আগাগোড়াই দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছে। সম্প্রতি লোকপাল বিল নিয়ে আন্না হাজারের অনশনে বিজেপি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। আন্না যখন সংসদীয় রীতিনীতির বাইরে তার ইচ্ছামতো একটি বিল পাস করানোর জন্য আমরণ অনশনে গিয়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলেন, তখন বিজেপি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে সরকারের নীতি অবস্থান সমর্থন করল। তাদের যুক্তি : ভারতের সুদীর্ঘ দিনের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ভাঙার আন্দোলনে তারা সায় দিতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কী হতো? এ প্রশ্নের জবাব আমাদের সকলেরই জানা।
ট্রানজিট
বিএনপি ও সুশীল সমাজের একাংশের দারুণ সন্দেহ ট্রানজিট নিয়ে। তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে জোর গলায় এই মুহূর্তে তেমন কিছু বলার নেই তাদের। তবে শুষ্ক মৌসুমে 'গ্যারান্টি ক্লজ' রাখার দাবিটি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রানজিটের ব্যাপারে সৃষ্ট সংশয় দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে নিজেদের স্বার্থেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে মানুষ ও পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচল অনিবার্য প্রয়োজন। আপন স্বার্থরক্ষা করেই এই প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ভারত যে বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে 'সেভেন সিস্টার্সে' তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করবে না তা বারবার উচ্চারণ করেছে। ট্রানজিট রুট সামরিক কাজে ব্যবহার না করার আশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে। 'সেভেন সিস্টার্সে' বাংলাদেশের ঈষৎ বাণিজ্যিক স্বার্থহানি হলেও ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশ গোটা ভারতের পণ্য পরিবহন সুবাদে যে শতগুণ আর্থিক স্বার্থ অর্জন করবে তা বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। এরপরও ট্রানজিট নিয়ে সংশয় হয়তো শতভাগ দূর হবে না। ট্রানজিট প্রসঙ্গে সংসদে, সংসদের বাইরে, রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করতে পারত সরকার। শুধু ট্রানজিট নয়, ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক, সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হবে তা প্রকাশ করে খোলামেলা আলোচনা ছিল বাঞ্ছনীয়। অকারণ সংশয় জিইয়ে রাখলে অসত্যই ডালপালা বিস্তার করে।
বর্তমান বিশ্বে বল্পুব্দত্বের সম্পর্ক শুধু সরকারে-সরকারেই হয় না। মৈত্রী ও সুসম্পর্কের জাগরণ সৃষ্ট হয় নানা স্তরে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে শুধু মন্ত্রীদের সফর এবং কদাচিৎ প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সফর বিনিময়েই দেশে দেশে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় হয় না। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ের মধ্য দিয়ে, পরস্পরকে জানার মধ্য দিয়েই সম্পর্ক নিবিড় হয়। এ সত্য উভয় দেশের সরকারকে বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভিসা পেতে যে জটিলতা ও দুর্ভোগ রয়েছে তাও যথাসময়ে দূর করার বিষয় ভারতকে ভাবতে হবে। নানা পর্যায়ে দু'দেশের প্রতিনিধিদের নিয়মিত সফর বিনিময়ও জরুরি।
একটি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ
প্রসঙ্গটি সম্ভবত গুরুতর নয়। তবে স্পর্শকাতর। ভারতের অসংখ্য টিভি চ্যানেলের বিনোদনের শোভন-অশোভন নানা উপচারে বাংলাদেশের কোটি কোটি গৃহকোণ আমোদিত। অনেকে রাগ করে বলেন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। বিশ্বের উন্মুক্ত আকাশকে ধমক দিয়ে লাভ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারতীয় টিভি চ্যানেলের হিন্দি ও বাংলা ধারাবাহিকে মনপ্রাণ সঁপে দেওয়া গৃহবধূদেরও ধমক দিয়ে লাভ নেই। এই নির্মম বাস্তবতা মনে রেখেই আমাদের বিকাশমান ('অতি' বিশেষণটি কি যোগ করব?) টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নিজেদের আরও দর্শকপ্রিয় করে তুলতে হবে। কোটি কোটি বাংলাদেশি ভারতীয় চ্যানেল দেখছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে দেখানো হচ্ছে না। গত কয়েক বছর একাধিকবার ভারত সফরকালে বাংলাদেশের সম্পাদকরা ভারতের উচ্চ পর্যায়ে প্রসঙ্গটি তুলেছেন। ভারতীয় নেতৃত্ব ও শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একান্তই বেসরকারি কেবল অপারেটরদের ব্যাপার। তাদের কিছু করণীয় নেই। বক্তব্যে হয়তো যুক্তি আছে। তবে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে কেবল অপারেটরদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার সময় এ প্রসঙ্গ গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করা যেতে পারে। অবিশ্বাস্য হলেও নিদারুণ সত্য যে, আপনি ইচ্ছা করলেই ভারত থেকে কোনো বই, পত্রপত্রিকা আনতে পারবেন না। নিষিদ্ধ। সম্ভবত ষাটের দশকে এই দুষ্কর্মটি করে গেছেন আইয়ুব খান। ভারতও বদলা নিয়েছে। আমরা নানা স্তরে প্রসঙ্গটি তুলেছি, সুরাহা হয়নি। এবার কি সুরাহা হবে। ভারতের প্রচণ্ড শক্তিশালী মিডিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের দারুণ ক্ষোভ রয়েছে। পরম বল্পুব্দ নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় গণমাধ্যমের দারুণ আগ্রহের কথা আমরা সেখানকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের কাছ থেকে শুনতে পাই। বাস্তবচিত্র কিন্তু একেবারেই বিপরীত। ভারতের পত্রপত্রিকায় সারা বছর প্রতিবেশী বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ জন্য আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ভারতের পত্রপত্রিকা এতটা আত্মনিমগ্ন যে তারা প্রতিবেশীদের দিকে চোখ মেলে তাকাবারই ফুরসত পায় না। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রায় শত সদস্যের মিডিয়া প্রতিনিধি আসছেন। আশা করছি, দিন কয়েকের উন্মাদনার পর তারা যথারীতি বাংলাদেশকে ভুলে যাবেন।
বাণিজ্য ঘাটতি
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ উল্লেখ না করাই শ্রেয়। এ যেন এক দারুণ লজ্জা। ভারতীয় পণ্যে বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে গেছে বলে যারা অহর্নিশ মাথা চাপড়ান তারাও ভালো করে জানেন, ভারত থেকে জরুরি পণ্য না এলে বাংলাদেশে বাজার বিপর্যয় ঘটে। কাঁচামাল না হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমাদের রফতানি পণ্য এতই সীমিত যে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেললেও পরিস্থিতির বড় একটা উন্নতি ঘটবে না। এর ওপর রয়েছে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে শুল্ক ও অশুল্ক নানা বাধা। এ বাধা দূর হলে এই বাণিজ্য ঘাটতির কিছুটা উপশম হবে। এই মুহূর্তে আমাদের বড় ভরসা, আমাদের বিশ্বজয়ী পোশাক খাত। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হলে বাণিজ্য ঘাটতির ক্ষেত্রে একটি স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মনমোহনের সফরে এ ক্ষেত্রে আমরা একটি বড় অর্জন প্রত্যাশা করি।
নিরামিষ নয়, আমিষ উপচার
আমার ধারণা ছিল, মনমোহন সিংয়ের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ভোজসভার আয়োজন করেছেন তার খাদ্য তালিকায় নিরামিষের নানা উপচার থাকবে। সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সজল জাহিদের এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি আমার ধারণাটিই ভুল প্রতিপন্ন করেছে। তার জন্য খাবারের যে তালিকাটি দিলি্ল সযত্নে প্রস্তুত করেছে, তাতে পাঁচতারা হোটেলের প্রথাসিদ্ধ আমিষ খাবারের ছড়াছড়ি। আমি খুশি হতাম মেন্যুতে 'ইলিশ মাছের পাটিসাপটা' জাতীয় কিছু রাখা হলে। ইলিশ মাছের পাটিসাপটা, সে আবার কী! সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্নটি পাঠকের মনে জাগ্রত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আমার একটি অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। গত বছর ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদকের সঙ্গে আমার ভারত সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল। কলকাতা সন্দর্শন ছাড়া বাঙালির ভারত ভ্রমণ যে ষোলআনাই মিছে তা পাদটীকাসহ বোঝাবার প্রয়োজন নেই। তখন ইলিশের ভরা মৌসুম। বাংলাদেশের ইলিশের ম-ম গন্ধে কলকাতার অভিজাত থেকে শুরু করে সর্বস্তরের হোটেলে যেন মোহময় পরিবেশ। ইলিশের নানা পদের তালিকায় দেখলাম 'ইলিশের পাটিসাপটা'। রীতিমতো চমকে উঠলাম। বাংলাদেশে ইলিশের কত বাহারি পদ। সে তালিকায় 'ইলিশের পাটিসাপটা' বলে কিছু নেই। মনমোহনের আমিষে অরুচি না থাকলেও মাদাম মনমোহন কিন্তু ষোলআনাই নিরামিষভোজী।
এ কী করলেন 'দিদি'!
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি শেষ পর্যন্ত তার স্বভাবসুলভ নাটকটি করলেন। তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের দাবি অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। মমতার ভেটোর কারণে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের ওপর কালো ছায়া পড়েছে। মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের সংবাদপত্র যেভাবে উন্মাতাল হয়েছিল তাতে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি অন্যায্য ছিল না যে, মমতা বাংলাদেশেরই কোনো রাজনীতিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একান্ত প্রিয় মমতাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ৪২ বছরের বাম শাসনের দুর্গ তছনছ করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করায় মমতা ব্যানার্জি প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেছিলেন পাক্ষিক 'দেশ'-এর বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুমন সেনগুপ্ত। তাকে উদৃব্দত করি :'এক নারী, যিনি চটুলা নয়না নন অথচ তার চোখের দৃষ্টিতে টুকরো টুকরো স্বপ্ন গাঁথা আছে। শহরের প্রান্তসীমার এক চিলতে ঘরের এই বাসিন্দার স্বপ্নদৃষ্টি কী প্রখর! খরতাপবাহী রৌদ্রের মতো তেজি দুটি চোখে অফুরান শক্তির সম্ভাবনা।' তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে বাদ সেধে তিনি কি সেই 'অফুরান শক্তি'ই প্রদর্শন করলেন?
গোলাম সারওয়ার :সম্পাদক, সমকাল
No comments