রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে নিজের মতো এগোতে হবে-সনৎকুমার সাহার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজল রশীদ

কবিতা-অকিবতা রবীন্দ্রনাথ সনৎকুমার সাহা প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১১ প্রকাশক: শুদ্ধস্বর দাম: ২৭৫ টাকা কাজল রশীদ: কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ আপনার রবীন্দ্রবিষয়ক দ্বিতীয় বই। এর আগে লিখেছেন আকাশ পৃথিবী রবীন্দ্রনাথ। আপনার রবীন্দ্র অনুরাগ সম্পর্কে বলুন?


সনৎকুমার সাহা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আমার যতটা অনুরাগ, তারচেয়ে অনেক বেশি জিজ্ঞাসা আছে। নানা প্রশ্ন কাজ করে। যেগুলোকে মাথায় রেখে আমি রবীন্দ্রনাথের কাছে থেকে সমাধান খুঁজি। সব সময় সমাধান পাই, এমন নয়। তবে সূত্রমুখ খুঁজে পাই। অর্থাৎ রবীন্দ্র-ভাবনার সঙ্গে নিজের ভাবনার প্রত্যাশা সমন্বয় করে আমি নিজের বোধ, রুচি, সৌন্দর্যকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাই।
কাজল: রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাঙালির আগ্রহ কতটা যৌক্তিক বলে আপনি মনে করেন?
সনৎকুমার: শতভাগ যৌক্তিক। কেননা তাঁর কাছে থেকে বাঙালি মুক্তির পথ খুঁজে পাই। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যেখানে থেমে গেছেন, তার পরের নির্দেশনার যে বোধ বা চেতনা, তাও রবীন্দ্রনাথ তৈরি করে দেন। বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের কারণেই আমাদের সাহিত্য পরিপুষ্ট হয়েছে, কল্পনার জগৎ বিস্তৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আগ্রহ শুধু যৌক্তিক নয়, আমাদের জন্য কল্যাণকরও বটে। রবীন্দ্রনাথ বারবার আকর্ষণ করে। ফিরেও যাই। তবে নিবিষ্ট হতে চাই না। কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত আবিষ্কারের চেষ্টা করি। আত্মস্থ করে নিজের মতো ভাবি, চলি। আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের চাওয়াটাও এ রকম ছিল। রবীন্দ্রনাথ কখনো বলেননি তাঁর মতো হতে হবে। তাঁর পথেই চলতে হবে।
কাজল: রবীন্দ্রনাথ আপনার জীবনকে কতটা আলোড়িত করেছে?
সনৎকুমার: অনেকখানি। গোটাজীবন আমি রবীন্দ্র-আবহের মধ্যে কাটিয়েছি। তাঁর জন্ম-মৃত্যু-জীবন ভাবনা, আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। রবীন্দ্রসংগীত আমার মনে সুন্দরের ছাপ তৈরি করেছে। আমরা বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি রবীন্দ্র জন্মশততমবর্ষে। তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যা সচেতন মানুষমাত্রই প্রতিহত করেছে। রবীন্দ্রনাথকে রুখে দেওয়ার বিপরীতে ঘনিষ্ঠভাবে ঝুঁকে পড়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তখন, শুধু অবসরে নয়, তিনি আমাদের অস্তিত্ব ও স্বপ্নের সঙ্গে মিশে গেছেন। এই আগ্রহ তৈরি হওয়া এখনো অটুট রয়েছে।
আজকের বাস্তবতা আর ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিজেদের বিকশিত করার প্রক্রিয়া, দুটোকে আমি এক করে দেখি না। আজ তাঁর ভাবনা, সুন্দরের প্রতি পক্ষপাত, কল্যাণ চেষ্টা—এসবের যে চেতনা তা আমরা হুবহু অনুসরণ করতে চাই। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেলে না, কেননা অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবুও চূড়ান্তভাবে আটকায় না। শুভবোধকেই জাগ্রত করে।
কাজল: আপনি রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে লিখেছেন, এখনো রবীন্দ্রনাথের শিল্পরুচির দিকেও ফিরে তাকাতে হচ্ছে। তাঁর শিল্পরুচি নিয়ে আপনার অভিমত কী?
সনৎকুমার: তাঁর শিল্পরুচি, নন্দন ভাবনায় অনন্য। কখনো কখনো তিনিও প্রচলিত বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়েছেন। তবে চূড়ান্তভাবে নয়। মানুষের অশুভ বৃত্তি তাঁর লেখায় প্রকাশ পেলেও, তাঁকে তিনি কখনোই উৎসাহ বা প্রশ্রয় দেননি। তাঁর চিত্রকলা, কবিতা, কথাসাহিত্য, গানে এসবের উপস্থিতি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ এই যে চেতনা-বোধ, তা আয়ত্ত করলে, চর্চা করলে মানুষ কল্যাণের দিকে যাবে, শুভ বোধ জাগ্রত হবে। এসব ভাবনার ভেতর দিয়ে আমরা অনন্য এক শিল্পরুচির রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পায়।
কাজল: আপনার বইয়ে বলেছেন, গীতাঞ্জলি ইউরোপ, আমেরিকায় অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। ইয়েটস, রদেনস্টাইন, এজরা পাউন্ড, টি এস ইলিয়টসহ অনেকেই মুগ্ধ হন। কিন্তু বাঙালি বিদ্ব্যৎসমাজ ততটা নয়, যতটা পাশ্চাত্যে হয়েছে। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সনৎকুমার: পাশ্চাত্যে উৎসাহ ছিল দুটো কারণে। প্রথমত, তাঁদের কবিতা ভাবনা তখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।গীতাঞ্জলি সেক্ষেত্রে রীতিমতো মাইলফলকের ভূমিকা পালন করেছে। কেননা, এটি ছিল ইংরেজিতে লেখা গদ্য কবিতা। যা ইতিপূর্বে শুধু ফরাসি কবি বোদলেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, গীতাঞ্জলির ভেতর দিয়ে পাশ্চাত্য একটা প্রত্যাখ্যানের জায়গা খুঁজে পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর-ভাবনা, কবিতার ফর্ম, উপমা, প্রতীক তাদের উৎসাহিত করেছে। কিন্তু প্রাচ্যে, বিশেষ করে আমাদের এখানে ততটা হয়নি। কেননা পাশ্চাত্যের কাছে যা নতুন মনে হয়েছে, আমাদের এখানে তা মনে হয়নি। কেননা এঁদের কাছে গীতাঞ্জলির ঈশ্বর-ভাবনা, ফর্ম পরিচিত। একারণে প্রত্যাখ্যান যেমন হয়নি, তেমনি প্রশংসাও হয়নি।
কাজল: কবি নন, তিনি মনীষী—মহামানবে রূপান্তরিত হয়েছেন। যতটা ভারতবর্ষে, তারচেয়ে কম নয়, সমকালীন ইউরোপ ও আমেরিকায়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশততমবর্ষে মহামানব রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ আবিষ্কারের প্রয়াস আপনার কাছে কেমন বলে মনে হচ্ছে?
সনৎকুমার: একসময় রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কাব্য-ভাবনায় যেখানে পৌঁছে ছিলেন, সেখান থেকে সরে গেছেন। কিন্তু তাঁর বোধ ও চেতনার জায়গা বিকশিত হয়েছে, যা আজও আলো ছড়াচ্ছে। তাঁকে মহামানবের মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছে। লেখক বা কবি রবীন্দ্রনাথের আঙ্গিক, প্রতীক, উপমা, ধরন সব জায়গা থেকে সাহিত্য অন্যত্র চলে গেছে। কিন্তু তাঁর লেখকসত্তার বাইরের কাজ, চিন্তা-চেতনা যত দিন যাচ্ছে, তত বেশি উচ্চকিত হচ্ছে। একারণেই তাঁর মহামানব সত্তার স্বরূপ সার্ধশততমবর্ষেও গুরুত্ববহ হয়ে দেখা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।
কাজল: রবীন্দনাথের জন্মের সার্ধশততমবর্ষে তাঁর সোনার বাংলার বাস্তবতা কেমন বলে মনে করছেন?
সনৎকুমার: তাঁর সোনার বাংলার সঙ্গে আজকের বাংলার কোনো মিল নেই। তখনকার বাস্তবতা ছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ অবস্থান, যা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে ক্ষতিকর হবে। বরং ভেবে দেখতে হবে বর্তমানের বাস্তবতায় কীভাবে খেয়ে-পরে বাঁচা যায়, সমৃদ্ধির দিকে এগোনো যায়। প্রযুক্তিতে, শিল্পে অগ্রসর হয়ে স্বাবলম্বী হওয়া যায়।
কাজল: কবিতা-অকবিতার বিভাজনের বিপক্ষে আপনি। পাশাপাশি কবিতা-অকবিতা ও রবীন্দ্রনাথ ত্রয়ী সম্পর্কের বিভাজনও কি আপনার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়?
সনৎকুমার: আমি মনে করি, ছন্দহীন রচনাকে কবিতার মধ্যে নেওয়া ঠিক নয়। যদিও তখনকার বাস্তবতা ছিল সমিল ছন্দ থেকে অমিলে আসা। উপস্থাপনাটা, ভাবনাটা দৈনন্দিনের কাছাকাছি, আটপৌরে হয়ে ওঠার চেষ্টা চলছিল। এটাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। অনুসরণও গ্রহণীয়। এসবই রবীন্দ্র কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধরণ হয়তো ক্রমশ পাল্টে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে।
অকবিতা হলো তাঁর নান্দনিক কর্মকাণ্ড। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলো। বর্তমানে তাঁর অকবিতার দিকে আমাদের নজর দেওয়া জরুরি। কেননা, কবিতা বদলে গেছে। কিন্তু অকবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক রয়েছে। যা এখনও সার্বিক উন্নয়ন-ভাবনায় উৎসাহিত করে। অবশ্য পদাঙ্ক অনুসরণ করে নয়। তাঁর ভাবনাকে আয়ত্ত করে নিজেদের মতো করে করা। সেটা সাহসের সঙ্গে এমনকি দুঃসাহসের সঙ্গেও হতে পারে। আর কবিতা-অকবিতা এবং রবীন্দ্রনাথ মূল্যায়নে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথই আমাদের দৃষ্টিতে প্রধান ব্যক্তি, যিনি প্রথাগত চিন্তা থেকে সর্বপ্রথম বেরিয়ে এসেছেন। মনে রাখতে হবে, তারপরও তিনিই শেষ কথা নন। তাঁকে পূর্ণ শ্রদ্ধা করে। জেনে, বুঝে, আত্মস্থ করে তাঁর কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেদের জগৎ নির্মাণ করতে হবে। তবেই আমাদের মুক্তি ও কল্যাণ হবে। আমরা এগিয়ে যাব সামনের দিকে।
কাজল: আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর তিন কন্যাকে পণ দিয়ে পাত্রস্থ করেছিলেন। তাঁর নারীমুক্তি, নারী-ভাবনা আপনার দৃষ্টিতে কেমন?
সনৎকুমার: বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না, সামগ্রিকতার মধ্য দিয়ে তাঁর নারীমুক্তির প্রয়াস-প্রচেষ্টা, ভাবনা খুঁজে নিতে হবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায়। মনে রাখতে হবে, তিনি পুত্রকে বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। লক্ষণীয় তাঁর রচনায় সময় পরিক্রম। দেখা যায়, নায়িকাদের বয়স কিন্তু বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। মঞ্জুলিকায় উৎসাহের সঙ্গে বিধবা বিবাহ দিয়েছেন। ল্যাবরেটরিতে নারীমুক্তি নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলা সাত্যে এখন পর্যন্ত কেউ সেভাবে কোনো প্রশ্ন তোলেননি।
কাজল: সময় দেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
সনৎকুমার: আপনাকে এবং প্রথম আলোর পাঠকদেরকেও ধন্যবাদ। শেষ কথা হলো, রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে। নিজের ভাবনা, প্রশ্নের সঙ্গে রবীন্দ্র-ভাবনাকে সমন্বিত করতে হবে। তারপর নিজের মতো করে এগোতে হবে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যেখানে থেমে গেছেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই রবীন্দ্রনাথকে যথার্থ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হবে এবং আমাদেরও মুক্তি ঘটবে।

No comments

Powered by Blogger.