শেয়ারবাজার : সংকটের পেছনের কারণ by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

মনে হচ্ছে, শেয়ারবাজার স্কয়ার ওয়ানে ফিরে এসেছে। সরকারের তদন্ত, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস এবং সরকার কর্তৃক কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ আশার আলো জ্বালিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনের অবস্থায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, আবার তিমিরাচ্ছন্ন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বাস্তব অবস্থাটা কী তা বুঝতে হবে।


বিনিয়োগকারীরা দুই ধরনের হয়ে থাকে। একদল রয়েছে, যারা সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখে, বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে অথবা কিছু শেয়ার ক্রয় করে, যা থেকে বছরে একটা লভ্যাংশ আসে। আরেক দল রয়েছে, যারা বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা করে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে দ্বিতীয় শ্রেণী এখন প্রভাবশালী; কেননা তাদের সংখ্যাধিক্য লক্ষণীয়। আজ যে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, সেটা এ কারণে। তা না হলে পুঁজিবাজারশাস্ত্রের মূলকথা শেয়ার কিনতে হলে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত থাকতে হবে। তাহলে তো এ প্রশ্ন ওঠে না। সাধারণ নিয়মে শেয়ার ক্রয়ে একটা ঋণ পাওয়ার কথা, তা হলো মার্চেন্ট ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত মার্জিন লোন। সেখানে বিনিয়োগকারীর সঙ্গে মার্চেন্ট ব্যাংকও ঝুঁকি নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নানা কৌশলে, নানা প্রলোভনে এবং কিছু অতিরঞ্জিত কথাবার্তায় বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে টাকা ধার করেছেন, এমনকি ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। যার ফলে মরিয়া হয়ে আন্দোলন করা ছাড়া তাঁরা বোধ হয় আর বিকল্প কিছু দেখছেন না।
এর জন্য দায়ী কারা? প্রথমে বলতে হয়, স্টক এঙ্চেঞ্জের কিছু নেতৃস্থানীয় সদস্য। তাঁরা পুঁজিবাজারে স্টক এঙ্চেঞ্জ যে ভূমিকা পালন করতে পারে, তার চেয়ে বেশি রঞ্জিত করে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। কেননা তাঁদের প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত। যত মধু তত মিষ্টি। শেয়ার লেনদেন বাড়বে, কমিশন আয়ও বাড়বে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের অনেক কথা শুনলাম। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শিল্পায়ন, অবকাঠামোর উন্নয়ন_এসব কাজের জন্য স্টক এঙ্চেঞ্জ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠবে। পদ্মা সেতুর জন্য প্রয়োজন মাত্র ২১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে সরকারকে দাতাদের কী রকম ভ্রুকুটি সইতে হচ্ছে, তা তো দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্য আরেকটি বড় দুর্ভাগ্য যে এর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) উল্টো ভূমিকা, এসইসি ডিএসইকে নিয়ন্ত্রণ করেনি, বরং ডিএসই এসইসিকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এ ব্যাপারে অত্যন্ত গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিয়েছেন সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার সাবেক ডেপুটি গভর্নর অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদ। সে জন্য তিনি সুপারিশ করেছেন এসইসিকে ঢেলে সাজানোর। আর সে কারণে এসইসির উচ্চ পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরো যাঁরা বিতর্কিত ছিলেন, তাঁদেরও অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু যা চরম দুর্ভাগ্যজনক, তা হলো এসইসির নতুন কর্মকর্তারা পুুরনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। একটা কথা আছে এবং আসলে সেটি যথার্থ, তা হলো লোহা গরম থাকতে আঘাত করতে হয়। শেয়ারবাজারে ধস নামার আগেই বিভিন্ন মহল থেকে কী করণীয় তা বলা হয়েছে। ইব্রাহীম খালেদের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে কী করতে হবে। এসইসি এর ধারেকাছেও আসেনি। এসইসির নতুন কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, কোনো দিকে না তাকিয়ে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এখন আর তা পারবে না। এসইসি তার ধার হারিয়ে ফেলেছে। এখন জোড়াতালি দিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকাই এসইসির জন্য বাঞ্ছনীয় হবে। মার্চেন্ট ব্যাংককে শুধু ইতিমধ্যে দেওয়া ঋণের সমন্বয়ের সময় বাড়ানোর সুযোগ দিলে চলবে না, বাড়তি ঋণের ব্যবস্থাও করতে হবে। আগেই উল্লেখ করছি, শেয়ারবাজারে এখন প্রায় সবাই ব্যবসায়ী। অতএব, সরকারকে চিন্তাভাবনা করতে হবে কতটা ঋণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। পুঁজিবাজার সম্পর্কে যে প্রচলিত বক্তব্য রয়েছে, এখান থেকে উন্নয়ন কর্মসূচি বা শিল্পায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে না। আর পুঁজিবাজারের এই বিপরীত স্রোত সৃষ্টির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষ করে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। দেশের শিল্পায়নে বা ব্যবসা-বাণিজ্যে বা কৃষি খাতে এরা কতটা ভূমিকা রেখেছে জানি না। তবে এক যুগ ধরে তাদের প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা গেছে শেয়ার ব্যবসায়। তাদের অনেকে ডিএসইর সদস্য হয়েছে। এসব ব্যাংকের কারণে ডিএসইর সদস্যপদের অতিমূল্যায়ন হয়েছে। তারা নিয়মনীতি ভেঙে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। সেসব অনিয়ম দূর করার চেষ্টা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। শেয়ারবাজারে প্রতিনিয়ত তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে।
শেয়ারবাজারের বিদ্যমান সংকট লাঘব করার একটা পথ হলো, আইপিএর মাধ্যমে নতুন শেয়ার বিক্রির ব্যবস্থা করা। অর্থমন্ত্রী বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন শেয়ার বাজারে আসছে না। শিল্প মন্ত্রণালয়ের শেয়ার বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে তাদের বোধ হয় কিছু বোঝাপড়ার ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করা হয়েছে, সেসব কম্পানির শেয়ারও বাজারে আসছে না কেন? সম্ভবত এখানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের লোভ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে, তখন শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী, সে সময় রাষ্ট্রায়ত্ত এক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলাম, জানতে চাইলাম, তাঁরা বাজারে আসছেন কবে এবং কী রকম মূল্য প্রত্যাশা করছেন? তিনি বললেন, তাঁরা প্রিমিয়াম ছাড়বেন এবং প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের শেয়ার ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার দাবি রাখেন। তাঁদের দাবির অন্যতম মূল্য ভিত্তি ঙঢ়বৎধঃরহম চৎড়ভরঃ. কিন্তু অতীতে কত হাজার কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার বদলে যে খুইয়েছে, তার খবর নেই। দাতাদের পরামর্শে এসব ব্যাংকের মুখ্য নির্বাহীরা এত বেশি বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, তা কল্পনাও করা যায় না। আর তাঁদের মানুষ হয়েও বিবেকে এতটুকু বাধেনি বৈধ উপায়ে জনগণের সম্পদ লুট করতে। বিনিময়ে কী সেবা দিয়েছেন, আর ব্যাংকের চেহারার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে, তা তো দেখতে পেয়েছি। মজার ব্যাপার হলো, খোদ পশ্চিমা বিশ্বে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুখ্য নির্বাহীদের অতিমাত্রায় বেতন-ভাতা নেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ব্যাংক অব আমেরিকার মুখ্য নির্বাহী যে তাঁর চেম্বারের জন্য ২৪০ মার্কিন ডলার দিয়ে একটি ময়লার ঝুড়ি কিনেছেন, সে সমালোচনা তো আমরা তাঁদের দেশের পত্রিকায় পড়েছি। এখানে প্রাসঙ্গিক আরো কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিহত গতি ছিল। এতে তো সবাই মনে করেছিলেন বা মনে করাতে চাওয়া হয়েছিল যে প্রাচুর্র্যের নহর বয়ে যাবে। কিন্তু সে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বের এক প্রান্তে না হলে অন্য প্রান্তে অর্থনৈতিক সংকট, মন্দাভাব লেগে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ২০০৭-০৮ সালব্যাপী গোটা বিশ্ব কঠিন অর্থনৈতক মন্দায় নিপতিত হয়েছিল। তার অর্থ মুক্তবাজার অর্থনীতির সবটুকু ত্রুটিমুক্ত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগঠনের প্রয়োজন। হয়তো সময় ও প্রয়োজন এসব পরিবর্তন এনে দেবে। পুঁজিবাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা দেখাতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। যেমন_মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন বা বাজার মূলধন। একসময় ডিএসসির বাজার মূলধন তো লাখ-কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা কি ছোঁয়া সম্ভব হয়েছিল? তাহলে তো ওখান থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর জন্য নেওয়া যেত। আসলে এর কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য নেই। অতএব শেয়ারবাজারের গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে সব কিছু পরিবর্তিত দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এ কথা ঠিক যে বর্তমান অভ্যন্তরীণ শেয়ারবাজারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং এসইসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে অর্থের জোগান দিতে। এ ব্যবসায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি কোনো কাজে আসে না, তবে শেয়ারবাজারকে সচল রাখার জন্য এর প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য।
পরিশেষে আবারও বলব, শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের পর, বিশেষ করে ইব্রাহীম খালেদের প্রতিবেদনের আলোকে এসইসি যেভাবে জ্বলে উঠবে বলে আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, তেমনটি হয়নি। তবু সবাই আশা করছে, সামনে আবার আলো দেখা যাবে।

লেখক : সাবেক ইপিএস ও কলামিস্ট


No comments

Powered by Blogger.