স্মরণ-কণ্ঠ থেমে গেল, থাকবে রেশ by কামাল লোহানী
ঢাকায় ষাটের দশকজুড়ে যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছিল সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, অজিত রায় হয়ে উঠেছিলেন তারই নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক-যোদ্ধা। নির্ভীক চিত্তের এ মানুষটিই একজন শিল্পী-সংগ্রামী হয়েও দেশমাতৃকার অবমাননার বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসী লড়াকু ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন।
তাই রংপুর ছেড়ে ঢাকায় এসেও অজিতদা জীবনজয়ের যুদ্ধে চিহ্নিত শত্রুকেই তাক করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী হয়েছিলেন যদি এমন বলি তবে তার নিবেদনের সীমানা যেন সেখানেই সীমাবদ্ধ না হয়ে যায়, অজিতদা ছিলেন মহাপ্রাণ এক শিল্পী
অজাতশত্রু, অমিততেজ, অসম সাহসী অজিত রায় আর নেই। নিরহঙ্কারী, বিনয়ী অজিতদা কেবল দেশপ্রেমিকই নন, তিনি ছিলেন মানুষের বল্পুব্দ এবং উদারমনা মানুষ। পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের নিরন্তর অভিযাত্রায় অজিতদা ছিলেন অক্লান্ত শিল্পী-সংগ্রামী। তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন সংগঠক, সুরকার, শিল্পী এবং শিক্ষক। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষটি ছিলেন অকপটচিত্তের এক সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বলিষ্ঠপ্রাণ লড়াকু সৈনিক। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে অজিত রায় ছিলেন আদর্শিক এক গণগায়ক। পৃথিবীর তাবৎ মুক্তিসংগ্রামী জনগণের ছিলেন এক অকৃত্রিম বল্পুব্দ। দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি গাইতেন, একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে দক্ষতার ছাপ রেখে গেলেন অজিত রায়।
আজীবন লড়াকু সৈনিক অজিত রায় ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৭৩ বছর বয়স হয়েছিল তার। কিন্তু দীর্ঘকাল থেকেই মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এর আগে দু'বার তার সফল অস্ত্রোপচার হয়েছিল; কিন্তু অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত রায় ক্যান্সারের তৃতীয় দফা আক্রমণকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হলেন, তাকে চলে যেতেই হলো। অজিতদা অসাধারণ মেধা, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আর আকর্ষণীয় গায়কীর এক নন্দিত শিল্পী-সংগঠক ছিলেন বলেই ক্যান্সার তাকে কাবু করে ফেলতে পারেনি বটে, কিন্তু লড়াকু এই গণশিল্পী অজিত রায়ের এবারে যেন দীর্ঘ সময়ের অসুস্থতায় ভেঙে পড়া দেহটিকে আক্রমণ করে বসল, আর ছাড়ল না। দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নির্ভীক বলিষ্ঠ রাজনীতিসচেতন শিল্পীসত্তা অজিত রায়কে অমূল্য, আকর্ষণীয়, জনপ্রিয় জীবনকে বিসর্জন দিতে হলো।
অজিতদা জন্মগ্রহণ করেছিলেন রংপুরে। নিরাভরণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কৃতী সন্তান অজিত রায় আমার এক অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনেও। অজিতদা বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট ছিলেন; কিন্তু তার সানি্নধ্য আমাদের এমনই বিমুগ্ধ করেছিল যে, বয়সের দিকে নজর না দিয়ে আদর্শের বাস্তব বিচারে তিনি ছিলেন আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয়। তাই তাকে দাদা হিসেবেই সম্বোধন করতাম। আমরা তো একই রণাঙ্গনের দক্ষ সৈনিক, যারা স্বপ্ন দেখতাম সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ার। পণ করেছিলাম, 'নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই' এই মন্ত্রে। তাই তো আমরা হয়ে গিয়েছিলাম আত্মার পরমাত্মীয়।
অজিত রায় ষাটের দশকে ঢাকা এসেছিলেন। মায়ের কাছ থেকেই দীক্ষা পেয়েছিলেন সঙ্গীত এবং দেশপ্রেমে। মা আর দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে তাই তো অজিতদা এ কঠিন ব্যাধিকে উপেক্ষা করে মানুষের বিজয় অভিযাত্রাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছে দেওয়ার অপরিহার্য প্রয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে সমর্পণ করেছিলেন মায়ের চরণে। তাই তো জীবনের মহান প্রাপ্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতার সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষা করতে প্রাণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একজন মুক্তিসেনা হিসেবে। হাতিয়ার ছিল গণসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা সংস্কৃতির মতো ক্ষুরধার তরবার। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
ঢাকায় ষাটের দশকজুড়ে যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছিল সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, অজিত রায় হয়ে উঠেছিলেন তারই নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক-যোদ্ধা। নির্ভীক চিত্তের এ মানুষটিই একজন শিল্পী-সংগ্রামী হয়েও দেশমাতৃকার অবমাননার বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসী লড়াকু ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন। তাই রংপুর ছেড়ে ঢাকায় এসেও অজিতদা জীবনজয়ের যুদ্ধে চিহ্নিত শত্রুকেই তাক করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী হয়েছিলেন যদি এমন বলি তবে তার নিবেদনের সীমানা যেন সেখানেই সীমাবদ্ধ না হয়ে যায়, অজিতদা ছিলেন মহাপ্রাণ এক শিল্পী, যিনি দেশটিকে জগৎজোড়া মুক্তিসংগ্রামের এক ফসলে পরিণত করতে চাইতেন। যুদ্ধজয়ের অভিযাত্রী অজিত রায় তাই নতুন বল্পুব্দ হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে। সে বল্পুব্দত্ব আমাদের করে তুলেছিল আত্মীয়তার মৈত্রীতে বাঁধা যাত্রাপথের এক মহৎপ্রাণ যোদ্ধা। সে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই অজিতদা চলে গেলেন। আমি রয়ে গেলাম।
'সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে...'
মাইকেল মধুসূদন দত্তের এ রচনা মাটির স্পর্শে মানুষকে আবেগপ্রবণ করে তুলত বলেই কপোতাক্ষ নদের প্রতি কবির আগ্রহকে অজিতদা সুরের মাঝে অসীম শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন। প্রবল আবেগের বিপুল গর্জন শুনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ দেখিতে পাই না আর'কে সুরের মোহনীয় জালে বেঁধে বাংলার মানুষের মনেরই বিপুল তরঙ্গ উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছিলেন। সুরস্রষ্টা নন কেবল, গায়কই ছিলেন তিনি। তাই জনপ্রিয়তার শীর্ষ শিখরে উপনীত হয়েছিলেন তিনি এ গানে। কোন গানে না তিনি আপন বলিষ্ঠ সত্তার বিপুল প্রয়াস ঘোষণা করেছেন? মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতারে অজিত রায় গেয়েছেন গান, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অমর সৃষ্টি যত আন্দোলনের গান। জীবন আর যুদ্ধজয়ের গান।
আজও কানে বাজে 'স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে জাগছে বাঙালিরা আজ রুখবে তাদের কারা'র সুর। বাংলার অমিততেজ মানুষের জাগরণ-উত্থানের সমবেত কণ্ঠস্বর যেন ধ্বনিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক শহীদুল ইসলামের লেখায়; কিন্তু অজিত রায়ের অপরাজেয় সুরে। কেবল সুর সৃষ্টি হয়, গায়কীর বলিষ্ঠতায় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রবল প্রতিরোধ আর পরাজয় যেন ফুঁসে উঠেছে। অজিতদা কমরেড সত্যেন সেনের 'আজি সপ্ত সাগর উঠে উচ্ছলিয়া', মুক্তিযুদ্ধ বেতারে 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার' কিংবা 'চাঁদ তুমি ফিরে যাও'_ এসব গানের সুরস্রষ্টা। সময়ের তাগিদে রচিত ও সুর সৃষ্টি হলেও সেদিন যেমন মানুষকে আন্দোলিত করেছিল, আজও তেমনি। অজিতদাকে আমরা পেয়েছি সব সংকটে। তাই তো অপরাজেয় শিল্পী-সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তার পরিচয় ছিল গণশিল্পী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি গণসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নাম দিয়েছিলেন 'অভ্যুদয়'। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অজিতদা শিক্ষা দিতেন দেশপ্রেম আর মানুষকে ভালোবাসার।
এমন মহৎপ্রাণ শিল্পী-সংগ্রামী বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২৭ আগস্ট রাতে, সম্ভবত চিকিৎসকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে কোনো একজন অনকোলজিস্টকে দেখাতে চেষ্টা করেও বারডেম ও পরিবার ব্যর্থ হয়েছিল ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অবশেষে দিন-রাত চেষ্টা করার পর একজনকে রাজি করানো সম্ভব হয়েছিল অজিতদাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। অনকোলজিস্টের সিদ্ধান্তই আইসিইউতে চিকিৎসারত অজিত রায়ের প্রয়োজন ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। ক্যান্সার হাসপাতালের চিফ অনকোলজিস্ট পারভিন শাহিদা আখতার নিজ হাসপাতালের রোগী সেবার ব্যস্ততা সত্ত্বেও দুপুরে নিজেই চলে আসেন বারডেমে এবং তার মত জানিয়ে দেন।
অজিতদা যে পর্যায়ে পেঁৗছে গিয়েছিলেন সেখান থেকে হয়তো কেন, ফেরানোই যেত না। তা সত্ত্বেও সবাই চান রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকু হোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কী যন্ত্রণাদায়ক, ৩১ আগস্ট ঈদ হয়ে যাওয়ার পরও চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাউকেই যথাসময়ে পাওয়া গেল না; কারণ তারা হয় ছুটিতে, না হয় টেলিফোন বন্ধ, আবার কাউকে পেয়েও আসতে রাজি করানো গেল না। বহু পীড়াপীড়ি করেও তাদের হাজির করা যায়নি।
অজিতদার মতো একজন বরেণ্য গায়ক-মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কেন এমন যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় প্রাণ দিতে হলো? যে আচরণ দেখলাম, শুনলাম, এ কি চিকিৎসকের ধর্ম, শপথ?
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
অজাতশত্রু, অমিততেজ, অসম সাহসী অজিত রায় আর নেই। নিরহঙ্কারী, বিনয়ী অজিতদা কেবল দেশপ্রেমিকই নন, তিনি ছিলেন মানুষের বল্পুব্দ এবং উদারমনা মানুষ। পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের নিরন্তর অভিযাত্রায় অজিতদা ছিলেন অক্লান্ত শিল্পী-সংগ্রামী। তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন সংগঠক, সুরকার, শিল্পী এবং শিক্ষক। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষটি ছিলেন অকপটচিত্তের এক সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বলিষ্ঠপ্রাণ লড়াকু সৈনিক। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে অজিত রায় ছিলেন আদর্শিক এক গণগায়ক। পৃথিবীর তাবৎ মুক্তিসংগ্রামী জনগণের ছিলেন এক অকৃত্রিম বল্পুব্দ। দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি গাইতেন, একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে দক্ষতার ছাপ রেখে গেলেন অজিত রায়।
আজীবন লড়াকু সৈনিক অজিত রায় ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৭৩ বছর বয়স হয়েছিল তার। কিন্তু দীর্ঘকাল থেকেই মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এর আগে দু'বার তার সফল অস্ত্রোপচার হয়েছিল; কিন্তু অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত রায় ক্যান্সারের তৃতীয় দফা আক্রমণকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হলেন, তাকে চলে যেতেই হলো। অজিতদা অসাধারণ মেধা, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আর আকর্ষণীয় গায়কীর এক নন্দিত শিল্পী-সংগঠক ছিলেন বলেই ক্যান্সার তাকে কাবু করে ফেলতে পারেনি বটে, কিন্তু লড়াকু এই গণশিল্পী অজিত রায়ের এবারে যেন দীর্ঘ সময়ের অসুস্থতায় ভেঙে পড়া দেহটিকে আক্রমণ করে বসল, আর ছাড়ল না। দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নির্ভীক বলিষ্ঠ রাজনীতিসচেতন শিল্পীসত্তা অজিত রায়কে অমূল্য, আকর্ষণীয়, জনপ্রিয় জীবনকে বিসর্জন দিতে হলো।
অজিতদা জন্মগ্রহণ করেছিলেন রংপুরে। নিরাভরণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কৃতী সন্তান অজিত রায় আমার এক অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনেও। অজিতদা বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট ছিলেন; কিন্তু তার সানি্নধ্য আমাদের এমনই বিমুগ্ধ করেছিল যে, বয়সের দিকে নজর না দিয়ে আদর্শের বাস্তব বিচারে তিনি ছিলেন আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয়। তাই তাকে দাদা হিসেবেই সম্বোধন করতাম। আমরা তো একই রণাঙ্গনের দক্ষ সৈনিক, যারা স্বপ্ন দেখতাম সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ার। পণ করেছিলাম, 'নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই' এই মন্ত্রে। তাই তো আমরা হয়ে গিয়েছিলাম আত্মার পরমাত্মীয়।
অজিত রায় ষাটের দশকে ঢাকা এসেছিলেন। মায়ের কাছ থেকেই দীক্ষা পেয়েছিলেন সঙ্গীত এবং দেশপ্রেমে। মা আর দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে তাই তো অজিতদা এ কঠিন ব্যাধিকে উপেক্ষা করে মানুষের বিজয় অভিযাত্রাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছে দেওয়ার অপরিহার্য প্রয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে সমর্পণ করেছিলেন মায়ের চরণে। তাই তো জীবনের মহান প্রাপ্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতার সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষা করতে প্রাণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একজন মুক্তিসেনা হিসেবে। হাতিয়ার ছিল গণসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা সংস্কৃতির মতো ক্ষুরধার তরবার। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
ঢাকায় ষাটের দশকজুড়ে যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছিল সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, অজিত রায় হয়ে উঠেছিলেন তারই নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক-যোদ্ধা। নির্ভীক চিত্তের এ মানুষটিই একজন শিল্পী-সংগ্রামী হয়েও দেশমাতৃকার অবমাননার বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসী লড়াকু ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন। তাই রংপুর ছেড়ে ঢাকায় এসেও অজিতদা জীবনজয়ের যুদ্ধে চিহ্নিত শত্রুকেই তাক করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী হয়েছিলেন যদি এমন বলি তবে তার নিবেদনের সীমানা যেন সেখানেই সীমাবদ্ধ না হয়ে যায়, অজিতদা ছিলেন মহাপ্রাণ এক শিল্পী, যিনি দেশটিকে জগৎজোড়া মুক্তিসংগ্রামের এক ফসলে পরিণত করতে চাইতেন। যুদ্ধজয়ের অভিযাত্রী অজিত রায় তাই নতুন বল্পুব্দ হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে। সে বল্পুব্দত্ব আমাদের করে তুলেছিল আত্মীয়তার মৈত্রীতে বাঁধা যাত্রাপথের এক মহৎপ্রাণ যোদ্ধা। সে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই অজিতদা চলে গেলেন। আমি রয়ে গেলাম।
'সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে...'
মাইকেল মধুসূদন দত্তের এ রচনা মাটির স্পর্শে মানুষকে আবেগপ্রবণ করে তুলত বলেই কপোতাক্ষ নদের প্রতি কবির আগ্রহকে অজিতদা সুরের মাঝে অসীম শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন। প্রবল আবেগের বিপুল গর্জন শুনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ দেখিতে পাই না আর'কে সুরের মোহনীয় জালে বেঁধে বাংলার মানুষের মনেরই বিপুল তরঙ্গ উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছিলেন। সুরস্রষ্টা নন কেবল, গায়কই ছিলেন তিনি। তাই জনপ্রিয়তার শীর্ষ শিখরে উপনীত হয়েছিলেন তিনি এ গানে। কোন গানে না তিনি আপন বলিষ্ঠ সত্তার বিপুল প্রয়াস ঘোষণা করেছেন? মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতারে অজিত রায় গেয়েছেন গান, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অমর সৃষ্টি যত আন্দোলনের গান। জীবন আর যুদ্ধজয়ের গান।
আজও কানে বাজে 'স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে জাগছে বাঙালিরা আজ রুখবে তাদের কারা'র সুর। বাংলার অমিততেজ মানুষের জাগরণ-উত্থানের সমবেত কণ্ঠস্বর যেন ধ্বনিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক শহীদুল ইসলামের লেখায়; কিন্তু অজিত রায়ের অপরাজেয় সুরে। কেবল সুর সৃষ্টি হয়, গায়কীর বলিষ্ঠতায় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রবল প্রতিরোধ আর পরাজয় যেন ফুঁসে উঠেছে। অজিতদা কমরেড সত্যেন সেনের 'আজি সপ্ত সাগর উঠে উচ্ছলিয়া', মুক্তিযুদ্ধ বেতারে 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার' কিংবা 'চাঁদ তুমি ফিরে যাও'_ এসব গানের সুরস্রষ্টা। সময়ের তাগিদে রচিত ও সুর সৃষ্টি হলেও সেদিন যেমন মানুষকে আন্দোলিত করেছিল, আজও তেমনি। অজিতদাকে আমরা পেয়েছি সব সংকটে। তাই তো অপরাজেয় শিল্পী-সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তার পরিচয় ছিল গণশিল্পী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি গণসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নাম দিয়েছিলেন 'অভ্যুদয়'। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অজিতদা শিক্ষা দিতেন দেশপ্রেম আর মানুষকে ভালোবাসার।
এমন মহৎপ্রাণ শিল্পী-সংগ্রামী বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২৭ আগস্ট রাতে, সম্ভবত চিকিৎসকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে কোনো একজন অনকোলজিস্টকে দেখাতে চেষ্টা করেও বারডেম ও পরিবার ব্যর্থ হয়েছিল ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অবশেষে দিন-রাত চেষ্টা করার পর একজনকে রাজি করানো সম্ভব হয়েছিল অজিতদাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। অনকোলজিস্টের সিদ্ধান্তই আইসিইউতে চিকিৎসারত অজিত রায়ের প্রয়োজন ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। ক্যান্সার হাসপাতালের চিফ অনকোলজিস্ট পারভিন শাহিদা আখতার নিজ হাসপাতালের রোগী সেবার ব্যস্ততা সত্ত্বেও দুপুরে নিজেই চলে আসেন বারডেমে এবং তার মত জানিয়ে দেন।
অজিতদা যে পর্যায়ে পেঁৗছে গিয়েছিলেন সেখান থেকে হয়তো কেন, ফেরানোই যেত না। তা সত্ত্বেও সবাই চান রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকু হোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কী যন্ত্রণাদায়ক, ৩১ আগস্ট ঈদ হয়ে যাওয়ার পরও চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাউকেই যথাসময়ে পাওয়া গেল না; কারণ তারা হয় ছুটিতে, না হয় টেলিফোন বন্ধ, আবার কাউকে পেয়েও আসতে রাজি করানো গেল না। বহু পীড়াপীড়ি করেও তাদের হাজির করা যায়নি।
অজিতদার মতো একজন বরেণ্য গায়ক-মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা সংগ্রামীকে কেন এমন যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় প্রাণ দিতে হলো? যে আচরণ দেখলাম, শুনলাম, এ কি চিকিৎসকের ধর্ম, শপথ?
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments