চাই নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব এবং সুশৃঙ্খল মানুষের সমন্বয়-ধর নির্ভয় গান by আলী যাকের
তবে এখনও সময় আছে। এখনও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি যদি বাংলাদেশের আদর্শ এবং মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বার্থহীনভাবে এ দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন এবং আপসহীনভাবে শক্ত হাতে দেশটির শাসনভার গ্রহণ করেন।
আমি জানি আমাদের সমস্যা ত্বরিত কোনো সমাধান নেই; কিন্তু সঠিক পথে পথচলা শুরু করলে আমাদের প্রজন্ম তা দেখতে পাক বা না পাক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুশাসিত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সম্ভাবনার দেশের নাগরিক হতে পারবে নিশ্চয়
সম্প্রতি সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। এই নগর রাষ্ট্রটি আমার অত্যন্ত পছন্দের একটি স্থান। সেই '৯০ সাল থেকে কাজে-অকাজে, বিভিন্ন সময় সিঙ্গাপুরে গিয়েছি আমি। অতএব, শহরটি আমার বেশ চেনাজানা হয়ে গেছে। এটা সত্য যে, এই শহরে আমার সফরগুলো কখনোই দীর্ঘদিনের জন্য হয়নি। সবচেয়ে বেশি দিন যেবার থেকেছিলাম, সেবারও দিন দশেকের জন্য। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব বলে যে, সিঙ্গাপুর স্বল্প সময়ের সফরের জন্য খুবই চমৎকার একটি জায়গা। কিন্তু দীর্ঘদিন থাকতে হলে বড্ড বিরক্তিকর ঠেকবে। এটা সত্য যে, এখানকার দর্শনীয় যা কিছু আছে, সবই তিন দিনের মধ্যে দেখা হয়ে যায়। তখন আর কিছুই করার থাকে না বিশেষ। এই স্থানগুলো যেমন_ পক্ষী উদ্যান, নাইট সাফারি, ছবির সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা সন্তোষা দ্বীপ, যেখানে কেবল কারে করে যেতে হয়_ এসবই দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে দেখে ফেলা সম্ভব। আমি এসবই দেখেছি। যদিও অতি সুচারুভাবে রচিত বোটানিক্যাল গার্ডেন আমায় প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। কেননা সেখানে অতিপ্রাচীন বৃক্ষ থেকে শুরু করে লতাগুল্ম, বৃক্ষ, ফুল এবং নানাবিধ উদ্ভিদের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এসবই আমার অত্যন্ত প্রিয়। অতএব, প্রতিবার সিঙ্গাপুরে গেলেই আমি একবার অন্তত বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাই। এবারে আমার সব কাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিঙ্গাপুরের প্রখ্যাত সড়ক অরচার্ড রোডে গিয়েছিলাম। বিকেলে যখন অফিস-আদালত ছুটি হয়, তখন হাজার হাজার মানুষ এই রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরে। সে এক দৃশ্য বটে! আমি মাঝে মধ্যেই রাস্তার কোনায় রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে এই জনসমুদ্রের দৃশ্য অবলোকন করেছি। নানা ধরনের মানুষ এই জনতায় এসে মিশেছে। তাদের কেউ চাইনিজ, কেউ মালয়, ভারতীয় অথবা ছিটেফোঁটা দু'চারজন বাংলাদেশি। রাস্তা দিয়ে অজস্র গাড়ি ছুটে চলেছে। এক কথায় বলা যায়, প্রচণ্ড ভিড় থাকে ওই সময় সিঙ্গাপুরের এই প্রধান সড়কটিতে। কিন্তু এই জনসমাগম কিংবা এই ভিড়কে চক্ষুশূল বলে মনে হয় না কখনও।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন আগে পড়া এক ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদের একটি গ্রন্থের কথা মনে পড়ে গেল। গ্রন্থটি জনসংখ্যা বিষয়ক এবং লেখকের নাম, যতদূর মনে পড়ে, মাহমুদ মামদোত। এই বইয়ের শুরুতেই তিনি একটি অত্যন্ত বৈধ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জনসংখ্যা তখনই অত্যধিক বলে মনে হয় না, যখন জনতার গুণগত মান সংখ্যাকে ছাপিয়ে যায়। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেছিলেন, কোনো গ্রীষ্মের বিকেলে লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাসে অফিসফেরতা জনগণের ভিড় দেখলে মনে হয় না যে, লন্ডন শহরটি জনসংখ্যার ভারে ভেঙে পড়বে। কিন্তু একই সময় দিলি্ল শহরের কনট সার্কাসে একই সংখ্যার জনগণকে দেখলে মনে হয় প্রাণ ওষ্ঠাগত। অরচার্ড রোডে দাঁড়িয়ে সিঙ্গাপুরের জনগণকে অবলোকন করছিলাম আর এই চিন্তাটি বারবার মনে আসছিল। আমি সবসময়ই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি, জনতা বা যানবাহনের সংখ্যাধিক্য কখনোই অসহনীয় বলে মনে হয় না, সিঙ্গাপুরের কোনো শহরে, দিনের কোনো সময়। তার কারণ এই উপচেপড়া ভিড়েরও একটা নিজস্ব চরিত্র আছে এবং এই চরিত্রটি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলোর দিকে তাকালে পার্থক্যটা সহজেই বোঝা যায়। এখানে যেমন মহাসড়কে কেউই নিয়ম মেনে চলে না। বস্তুতপক্ষে আইন লঙ্ঘন করাই হচ্ছে আমাদের জাতীয় চরিত্র। সবচেয়ে ভারী যানবাহন যেই লেন দিয়ে যাওয়ার কথা, সেখান দিয়ে না গিয়ে একেবারে ফুটপাত সংলগ্ন লেন দিয়ে চলাচল করে। মোটরসাইকেল উঠে আসে পথচারীদের চলাচলের জন্য নির্ধারিত ফুটপাতের ওপর এবং পথচারী বেচারার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অথবা রাস্তার পার্শ্ববর্তী ড্রেনে জায়গা হয়। দিব্যি ফুটওভারব্রিজের নিচ দিয়ে দ্রুতগতি যানবাহনের পথ রোধ করে ছোটাছুটি করে পথচারীরা রাস্তা পার হয়। এই যে নিয়ম ভাঙার আমাদের সংস্কৃতি, এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে কোথায় এর শেষ, কে বলতে পারে?
একবার সিঙ্গাপুরে থাকার সময় কোনো একটি টিভি চ্যানেলে আধুনিক সিঙ্গাপুর বিনির্মাণের স্থপতি লি হুয়ান য়ুর একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিক তার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন উপহাস করে লিকে বললেন, 'আপনি কি জানেন, সিঙ্গাপুরকে ব্যঙ্গ করে মানুষ জরিমানার শহর বলে ডাকে?' যে শব্দ দুটি এই সাংবাদিক ব্যবহার করেছিলেন তা হলো, 'ফাইন সিটি'। যদিও কথাটি দ্ব্যর্থবোধক, লি হুয়ান য়ু কিন্তু আসল অর্থটি বুঝেছিলেন। তিনি বললেন, তিনি জানেন লোকে সিঙ্গাপুরকে নিয়ে নানা রকম উপহাস করে। সাংবাদিক তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন মানুষকে কথায় কথায় এ রকম জরিমানা দিতে হয়? অনিয়মিতভাবে রাস্তা পার হলে জরিমানা, লালবাতির ইশারা না মানলে জরিমানা, হাতের কাগজের ঠোঙাটি যত্রতত্র ফেললে জরিমানা, এ রকম আরও অজস্র জরিমানার কথা উল্লেখ করা যায়। লি বলেছিলেন, এটা না হলে মানুষ আইন মেনে চলবে না। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে আইন না মানা। সেই মার্কিন সাংবাদিক তখন লিকে বলেছিলেন, শিক্ষার ওপর জোর দিয়েও তো এই বিষয়টি অর্জন করা যেতে পারে। লি জবাবে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ পারে, তবে তাতে দীর্ঘদিন সময় লাগবে। আমি আমার জীবদ্দশাতেই একটি সুশৃঙ্খল সিঙ্গাপুর দেখতে চাই।'
আমি জানি যে এই ধরনের ব্যবস্থাকে অনেকেই স্বৈরাচারী বলে মনে করবেন; কিন্তু গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বর্তমান চেহারা দেখলে কেন যেন আমার সিঙ্গাপুরের ব্যবস্থাকেই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগে দেশটি সংযুক্ত ছিল মালয়েশিয়ার সঙ্গে। ষাটের দশকের মধ্যভাগে সিঙ্গাপুরের শাসক দল পিপলস অ্যাকশন পার্টির সঙ্গে মালয়েশিয়ার অ্যালায়েন্স পার্টির মতের অমিল থেকেই সিঙ্গাপুরের আলাদা হয়ে যাওয়া। সিঙ্গাপুর অবশ্য চেয়েছিল মালয়েশিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে। কেননা তখনও তাদের বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না, যার ওপর নির্ভর করে একটি স্বাধীন দেশ চলতে পারে। কিন্তু মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের ঝামেলা আর নিজেদের কাঁধে বহন করতে চায়নি। অতএব, জন্মের পর থেকেই নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে এই নগর রাষ্ট্রটিকে। বেকারত্ব, আবাসন সমস্যা, শিক্ষার স্বল্পতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি এই দেশটির জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে এসেছিল। যদিও আসিয়ান এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের সংযোগ সেই শুরু থেকেই, তবুও তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ছিল। সিঙ্গাপুরের এমন প্রায় ভগ্নদশা থেকে দেশটিকে টেনে তোলেন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান য়ু। তার নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর বিশ্বের এক অনুকরণীয় রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে এবং এই নেতার আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি জাতি সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনী রাষ্ট্রের একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই কথাগুলো ভাবছিলাম অরচার্ড রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে আর বারবার আমার দেশের কথা মনে পড়ছিল। আমাদের এখানে স্বার্থহীন নেতৃত্বের যেমন অভাব আছে, তেমনি অরাজক ও আইন অমান্যকারী গণমানুষের অভাব নেই বললেই চলে। এই দুয়ে মিলে আমাদের দেশটিকে আমরা আজ ধ্বংস করতে বসেছি। তবে এখনও সময় আছে। এখনও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি যদি বাংলাদেশের আদর্শ এবং মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বার্থহীনভাবে এ দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন এবং আপসহীনভাবে শক্ত হাতে দেশটির শাসনভার গ্রহণ করেন। আমি জানি আমাদের সমস্যা ত্বরিত কোনো সমাধান নেই; কিন্তু সঠিক পথে পথচলা শুরু করলে আমাদের প্রজন্ম তা দেখতে পাক বা না পাক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুশাসিত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সম্ভাবনার দেশের নাগরিক হতে পারবে নিশ্চয়।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সম্প্রতি সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। এই নগর রাষ্ট্রটি আমার অত্যন্ত পছন্দের একটি স্থান। সেই '৯০ সাল থেকে কাজে-অকাজে, বিভিন্ন সময় সিঙ্গাপুরে গিয়েছি আমি। অতএব, শহরটি আমার বেশ চেনাজানা হয়ে গেছে। এটা সত্য যে, এই শহরে আমার সফরগুলো কখনোই দীর্ঘদিনের জন্য হয়নি। সবচেয়ে বেশি দিন যেবার থেকেছিলাম, সেবারও দিন দশেকের জন্য। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব বলে যে, সিঙ্গাপুর স্বল্প সময়ের সফরের জন্য খুবই চমৎকার একটি জায়গা। কিন্তু দীর্ঘদিন থাকতে হলে বড্ড বিরক্তিকর ঠেকবে। এটা সত্য যে, এখানকার দর্শনীয় যা কিছু আছে, সবই তিন দিনের মধ্যে দেখা হয়ে যায়। তখন আর কিছুই করার থাকে না বিশেষ। এই স্থানগুলো যেমন_ পক্ষী উদ্যান, নাইট সাফারি, ছবির সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা সন্তোষা দ্বীপ, যেখানে কেবল কারে করে যেতে হয়_ এসবই দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে দেখে ফেলা সম্ভব। আমি এসবই দেখেছি। যদিও অতি সুচারুভাবে রচিত বোটানিক্যাল গার্ডেন আমায় প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। কেননা সেখানে অতিপ্রাচীন বৃক্ষ থেকে শুরু করে লতাগুল্ম, বৃক্ষ, ফুল এবং নানাবিধ উদ্ভিদের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এসবই আমার অত্যন্ত প্রিয়। অতএব, প্রতিবার সিঙ্গাপুরে গেলেই আমি একবার অন্তত বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাই। এবারে আমার সব কাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিঙ্গাপুরের প্রখ্যাত সড়ক অরচার্ড রোডে গিয়েছিলাম। বিকেলে যখন অফিস-আদালত ছুটি হয়, তখন হাজার হাজার মানুষ এই রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরে। সে এক দৃশ্য বটে! আমি মাঝে মধ্যেই রাস্তার কোনায় রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে এই জনসমুদ্রের দৃশ্য অবলোকন করেছি। নানা ধরনের মানুষ এই জনতায় এসে মিশেছে। তাদের কেউ চাইনিজ, কেউ মালয়, ভারতীয় অথবা ছিটেফোঁটা দু'চারজন বাংলাদেশি। রাস্তা দিয়ে অজস্র গাড়ি ছুটে চলেছে। এক কথায় বলা যায়, প্রচণ্ড ভিড় থাকে ওই সময় সিঙ্গাপুরের এই প্রধান সড়কটিতে। কিন্তু এই জনসমাগম কিংবা এই ভিড়কে চক্ষুশূল বলে মনে হয় না কখনও।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন আগে পড়া এক ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদের একটি গ্রন্থের কথা মনে পড়ে গেল। গ্রন্থটি জনসংখ্যা বিষয়ক এবং লেখকের নাম, যতদূর মনে পড়ে, মাহমুদ মামদোত। এই বইয়ের শুরুতেই তিনি একটি অত্যন্ত বৈধ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জনসংখ্যা তখনই অত্যধিক বলে মনে হয় না, যখন জনতার গুণগত মান সংখ্যাকে ছাপিয়ে যায়। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেছিলেন, কোনো গ্রীষ্মের বিকেলে লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাসে অফিসফেরতা জনগণের ভিড় দেখলে মনে হয় না যে, লন্ডন শহরটি জনসংখ্যার ভারে ভেঙে পড়বে। কিন্তু একই সময় দিলি্ল শহরের কনট সার্কাসে একই সংখ্যার জনগণকে দেখলে মনে হয় প্রাণ ওষ্ঠাগত। অরচার্ড রোডে দাঁড়িয়ে সিঙ্গাপুরের জনগণকে অবলোকন করছিলাম আর এই চিন্তাটি বারবার মনে আসছিল। আমি সবসময়ই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি, জনতা বা যানবাহনের সংখ্যাধিক্য কখনোই অসহনীয় বলে মনে হয় না, সিঙ্গাপুরের কোনো শহরে, দিনের কোনো সময়। তার কারণ এই উপচেপড়া ভিড়েরও একটা নিজস্ব চরিত্র আছে এবং এই চরিত্রটি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলোর দিকে তাকালে পার্থক্যটা সহজেই বোঝা যায়। এখানে যেমন মহাসড়কে কেউই নিয়ম মেনে চলে না। বস্তুতপক্ষে আইন লঙ্ঘন করাই হচ্ছে আমাদের জাতীয় চরিত্র। সবচেয়ে ভারী যানবাহন যেই লেন দিয়ে যাওয়ার কথা, সেখান দিয়ে না গিয়ে একেবারে ফুটপাত সংলগ্ন লেন দিয়ে চলাচল করে। মোটরসাইকেল উঠে আসে পথচারীদের চলাচলের জন্য নির্ধারিত ফুটপাতের ওপর এবং পথচারী বেচারার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অথবা রাস্তার পার্শ্ববর্তী ড্রেনে জায়গা হয়। দিব্যি ফুটওভারব্রিজের নিচ দিয়ে দ্রুতগতি যানবাহনের পথ রোধ করে ছোটাছুটি করে পথচারীরা রাস্তা পার হয়। এই যে নিয়ম ভাঙার আমাদের সংস্কৃতি, এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে কোথায় এর শেষ, কে বলতে পারে?
একবার সিঙ্গাপুরে থাকার সময় কোনো একটি টিভি চ্যানেলে আধুনিক সিঙ্গাপুর বিনির্মাণের স্থপতি লি হুয়ান য়ুর একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিক তার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন উপহাস করে লিকে বললেন, 'আপনি কি জানেন, সিঙ্গাপুরকে ব্যঙ্গ করে মানুষ জরিমানার শহর বলে ডাকে?' যে শব্দ দুটি এই সাংবাদিক ব্যবহার করেছিলেন তা হলো, 'ফাইন সিটি'। যদিও কথাটি দ্ব্যর্থবোধক, লি হুয়ান য়ু কিন্তু আসল অর্থটি বুঝেছিলেন। তিনি বললেন, তিনি জানেন লোকে সিঙ্গাপুরকে নিয়ে নানা রকম উপহাস করে। সাংবাদিক তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন মানুষকে কথায় কথায় এ রকম জরিমানা দিতে হয়? অনিয়মিতভাবে রাস্তা পার হলে জরিমানা, লালবাতির ইশারা না মানলে জরিমানা, হাতের কাগজের ঠোঙাটি যত্রতত্র ফেললে জরিমানা, এ রকম আরও অজস্র জরিমানার কথা উল্লেখ করা যায়। লি বলেছিলেন, এটা না হলে মানুষ আইন মেনে চলবে না। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে আইন না মানা। সেই মার্কিন সাংবাদিক তখন লিকে বলেছিলেন, শিক্ষার ওপর জোর দিয়েও তো এই বিষয়টি অর্জন করা যেতে পারে। লি জবাবে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ পারে, তবে তাতে দীর্ঘদিন সময় লাগবে। আমি আমার জীবদ্দশাতেই একটি সুশৃঙ্খল সিঙ্গাপুর দেখতে চাই।'
আমি জানি যে এই ধরনের ব্যবস্থাকে অনেকেই স্বৈরাচারী বলে মনে করবেন; কিন্তু গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বর্তমান চেহারা দেখলে কেন যেন আমার সিঙ্গাপুরের ব্যবস্থাকেই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগে দেশটি সংযুক্ত ছিল মালয়েশিয়ার সঙ্গে। ষাটের দশকের মধ্যভাগে সিঙ্গাপুরের শাসক দল পিপলস অ্যাকশন পার্টির সঙ্গে মালয়েশিয়ার অ্যালায়েন্স পার্টির মতের অমিল থেকেই সিঙ্গাপুরের আলাদা হয়ে যাওয়া। সিঙ্গাপুর অবশ্য চেয়েছিল মালয়েশিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে। কেননা তখনও তাদের বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না, যার ওপর নির্ভর করে একটি স্বাধীন দেশ চলতে পারে। কিন্তু মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের ঝামেলা আর নিজেদের কাঁধে বহন করতে চায়নি। অতএব, জন্মের পর থেকেই নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে এই নগর রাষ্ট্রটিকে। বেকারত্ব, আবাসন সমস্যা, শিক্ষার স্বল্পতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি এই দেশটির জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে এসেছিল। যদিও আসিয়ান এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের সংযোগ সেই শুরু থেকেই, তবুও তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ছিল। সিঙ্গাপুরের এমন প্রায় ভগ্নদশা থেকে দেশটিকে টেনে তোলেন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান য়ু। তার নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর বিশ্বের এক অনুকরণীয় রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে এবং এই নেতার আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি জাতি সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধনী রাষ্ট্রের একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই কথাগুলো ভাবছিলাম অরচার্ড রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে আর বারবার আমার দেশের কথা মনে পড়ছিল। আমাদের এখানে স্বার্থহীন নেতৃত্বের যেমন অভাব আছে, তেমনি অরাজক ও আইন অমান্যকারী গণমানুষের অভাব নেই বললেই চলে। এই দুয়ে মিলে আমাদের দেশটিকে আমরা আজ ধ্বংস করতে বসেছি। তবে এখনও সময় আছে। এখনও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি যদি বাংলাদেশের আদর্শ এবং মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বার্থহীনভাবে এ দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন এবং আপসহীনভাবে শক্ত হাতে দেশটির শাসনভার গ্রহণ করেন। আমি জানি আমাদের সমস্যা ত্বরিত কোনো সমাধান নেই; কিন্তু সঠিক পথে পথচলা শুরু করলে আমাদের প্রজন্ম তা দেখতে পাক বা না পাক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুশাসিত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সম্ভাবনার দেশের নাগরিক হতে পারবে নিশ্চয়।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments