নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-নির্বাচন ও সৎ মানুষের খোঁজে by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী রাজনীতিক হেরেছিলেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায় অপরিচিত মন্জুর আলমের কাছে। সেই তুলনায় বরং নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানকে লড়তে হয়েছে অনেক শক্তিশালী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে। পরাজিত এই দুই প্রভাবশালী প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল—তাঁরা দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েও হেরেছেন আওয়ামী ঘরানার দুই প্রার্থীর কাছে।
তবে দলের সমর্থনবঞ্চিত মন্জুরকে নির্ভর করতে হয়েছিল বিএনপির সমর্থনের ওপর, আইভীকে তা করতে হয়নি। আলী আহাম্মেদ চুনকার মেয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের দলীয় পরিচয় অস্বীকার না করেও সমর্থন পেয়েছেন তাঁর দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে বাম ঘরানার রাজনীতিক, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের নাগরিকের।
চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে, মন্জুর আলমের জয়ের পেছনে নেতিবাচক ভোটের প্রভাব যতটা কার্যকর ছিল, সেলিনা হায়াৎ আইভীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম নয়। তিনি জিতেছেন ইতিবাচক ভোটে। বিষয়টা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
তিন মেয়াদে ১৩ বছর চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর মধ্যে দুটি নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেছেন যখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল না। তৃতীয়বার দল যখন ক্ষমতায়, তখন বিরোধী দলের বর্জনের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, একমাত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল তাঁকে। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হবে, রাজনৈতিক জীবনের একটি দীর্ঘ সময়জুড়ে যে বিপুল জনসমর্থন মহিউদ্দিন পেয়েছিলেন, তার উদাহরণ এ অঞ্চলে বিরল। চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রশ্নে তাঁর আপসহীন অবস্থান এখানকার মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে, এমনকি চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সরকারের বরাদ্দের দিকে তাকিয়ে না থেকে বিভিন্ন আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়ে সিটি করপোরেশনকে স্বাবলম্বী করে তুলেছিলেন তিনি। করের বোঝা না চাপিয়েও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সরকারি দলের মেয়র হয়েও উন্নয়ন ও দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দ্বিধা করেননি তিনি। বিশেষ করে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা’র (এসএসএ) সঙ্গে একটি অসম চুক্তির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বেসরকারি কনটেইনার টার্মিনাল তাদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ রুখে দিয়ে মহিউদ্দিন মানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন, নগরবাসীর কাছে প্রকৃত অভিভাবকের মর্যাদা পেয়েছিলেন।
কিন্তু তৃতীয়বার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই যেন দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। একসময় কালাপাহাড়ি মনোভাবের জন্য জনসমর্থন পেয়েছিলেন, কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাঁর আচরণকে দুর্বিনীত মনে হতে থাকল সবার কাছে। সিটি করপোরেশনের কর্মপরিধি ছাড়িয়ে তাঁর নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগের সঙ্গে সিভিল সোসাইটির বিরোধ ক্রমেই বাড়তে লাগল। কারও কোনো সমালোচনাকে তোয়াক্কা না করে একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে সমালোচিত হতে থাকলেন তিনি। এ সময় অপর্ণাচরণ স্কুল প্রাঙ্গণে বহুতল বিপণিকেন্দ্র নির্মাণ, লালদীঘিতে সুইমিংপুল, চাক্তাই রিংরোডে হকার মার্কেট তৈরি কিংবা গোলপাহাড়ের পশুশালার জায়গা দখল প্রভৃতি উদ্যোগ সচেতন নাগরিক সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে।
তৎকালীন সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার মন্জুর আলমের সঙ্গে ছিল তাঁর গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। মহিউদ্দিন চৌধুরী কোনো কাজে দেশের বাইরে থাকলে বেশির ভাগ সময়ই ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন মন্জুর আলমের হাতে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হলে মন্জুর পালন করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর মহিউদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে তাঁর। এ সময় নানাভাবে তাঁকে অপমান করেন মহিউদ্দিন। তাঁর কর্মী-সমর্থকদের হাতেও বিভিন্নভাবে নাজেহাল হন মন্জুর। কিন্তু এত কিছুর পরও কোনো ধরনের বাগিবতণ্ডা বা সংঘর্ষে না জড়িয়ে নিজের নির্বিরোধী ভালো মানুষের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন মন্জুর। গত সংসদ নির্বাচনে দলের (আওয়ামী লীগ) মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। অবশেষে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্জুর প্রার্থী হলেন মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে। সংসদ নির্বাচনে পর্যুদস্ত বিএনপির পক্ষে তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া ছিল এক কঠিন কাজ। ফলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতিটাই প্রয়োগ করলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা, সমর্থন দিলেন মন্জুরকে।
সংসদ নির্বাচনে যে ব্যক্তি জামানত খুইয়েছিলেন, বিপুল ভোটে তাঁর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পেছনে যতটা না নিজের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল দাম্ভিক, দুর্বিনীত মহিউদ্দিনের বিপক্ষে জনরায়। এটাকেই নেতিবাচক (নেগেটিভ) ভোট বলতে চেয়েছি আমরা।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অন্যদের মতামতকে মূল্য না দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করা ইত্যাদি নানা কারণে মহিউদ্দিনের বিপক্ষে দলের ভেতরেই তখন জমে উঠেছিল অসন্তোষের পাহাড়। ঢাকায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সেই ক্ষোভ-অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রবীণ-নবীন নেতারা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা চট্টগ্রামে এসেও দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন দলের নেতা-কর্মীদের মনোভাব। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কোনো তরুণ নেতাকে এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দিলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারত বলে অনেকের ধারণা। কেননা, এই রায় যতটা মন্জুরের পক্ষে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মহিউদ্দিনের বিপক্ষে।
মনে হয়েছিল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দেবে। কিন্তু দিন বদলের অঙ্গীকার যাঁরা করেছিলেন, মানুষের মন বদলের হদিস তাঁরা পাননি। তাই শামীম ওসমানের মতো একজন বিতর্কিত সমালোচিত ব্যক্তিকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির পক্ষে যে জনমত তৈরি হয়েছিল; ‘সুশীল সমাজ’ নামের যে জনগোষ্ঠীকে প্রায়ই রাজনীতিকেরা ঠাট্টা-বিদ্রূপে বিদ্ধ করেন, তাঁরা যে ধরনের প্রার্থীর জন্য আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছিলেন মানুষের মনে, আইভী ছিলেন সে রকমই একজন প্রার্থী। এখানে তাই শুধু শামীম ওসমানের বিপক্ষেই নয়, আইভীর পক্ষে ইতিবাচক ভোট দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।
চট্টগ্রামে বিএনপি দলের ভেতর যোগ্য প্রার্থীর সন্ধান না পেয়ে মন্জুরকে সমর্থন দিয়েছিল; নারায়ণগঞ্জে আসলে যোগ্য প্রার্থীর সন্ধান তারা পায়নি। তৈমুর আলম খন্দকারকে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলে সেই ব্যর্থতার ভার লাঘবের চেষ্টা করেছে।
চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ—অনতিদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দুটি নির্বাচনে ভোটাররা একটি নতুন বার্তা রেখেছেন দুই প্রধান দলের কাছে। খ্যাতি-কুখ্যাতি যে কারণেই হোক, বহুল আলোচিত দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি ছাড়া কাউকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়—এ রকম প্রথাবদ্ধ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়তো হয়েছে। নিপাট ভদ্রলোক মন্জুর আলম আর ‘পাশের বাড়ির মেয়ের’ ইমেজের আইভীর বিজয় সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদি দলগুলো তা অনুধাবন করে, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই নামতে হবে সৎ মানুষের খোঁজে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে, মন্জুর আলমের জয়ের পেছনে নেতিবাচক ভোটের প্রভাব যতটা কার্যকর ছিল, সেলিনা হায়াৎ আইভীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম নয়। তিনি জিতেছেন ইতিবাচক ভোটে। বিষয়টা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
তিন মেয়াদে ১৩ বছর চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর মধ্যে দুটি নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেছেন যখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল না। তৃতীয়বার দল যখন ক্ষমতায়, তখন বিরোধী দলের বর্জনের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, একমাত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল তাঁকে। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হবে, রাজনৈতিক জীবনের একটি দীর্ঘ সময়জুড়ে যে বিপুল জনসমর্থন মহিউদ্দিন পেয়েছিলেন, তার উদাহরণ এ অঞ্চলে বিরল। চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রশ্নে তাঁর আপসহীন অবস্থান এখানকার মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে, এমনকি চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সরকারের বরাদ্দের দিকে তাকিয়ে না থেকে বিভিন্ন আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়ে সিটি করপোরেশনকে স্বাবলম্বী করে তুলেছিলেন তিনি। করের বোঝা না চাপিয়েও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সরকারি দলের মেয়র হয়েও উন্নয়ন ও দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দ্বিধা করেননি তিনি। বিশেষ করে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা’র (এসএসএ) সঙ্গে একটি অসম চুক্তির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বেসরকারি কনটেইনার টার্মিনাল তাদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ রুখে দিয়ে মহিউদ্দিন মানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন, নগরবাসীর কাছে প্রকৃত অভিভাবকের মর্যাদা পেয়েছিলেন।
কিন্তু তৃতীয়বার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই যেন দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। একসময় কালাপাহাড়ি মনোভাবের জন্য জনসমর্থন পেয়েছিলেন, কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাঁর আচরণকে দুর্বিনীত মনে হতে থাকল সবার কাছে। সিটি করপোরেশনের কর্মপরিধি ছাড়িয়ে তাঁর নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগের সঙ্গে সিভিল সোসাইটির বিরোধ ক্রমেই বাড়তে লাগল। কারও কোনো সমালোচনাকে তোয়াক্কা না করে একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে সমালোচিত হতে থাকলেন তিনি। এ সময় অপর্ণাচরণ স্কুল প্রাঙ্গণে বহুতল বিপণিকেন্দ্র নির্মাণ, লালদীঘিতে সুইমিংপুল, চাক্তাই রিংরোডে হকার মার্কেট তৈরি কিংবা গোলপাহাড়ের পশুশালার জায়গা দখল প্রভৃতি উদ্যোগ সচেতন নাগরিক সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে।
তৎকালীন সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার মন্জুর আলমের সঙ্গে ছিল তাঁর গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। মহিউদ্দিন চৌধুরী কোনো কাজে দেশের বাইরে থাকলে বেশির ভাগ সময়ই ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন মন্জুর আলমের হাতে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হলে মন্জুর পালন করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর মহিউদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে তাঁর। এ সময় নানাভাবে তাঁকে অপমান করেন মহিউদ্দিন। তাঁর কর্মী-সমর্থকদের হাতেও বিভিন্নভাবে নাজেহাল হন মন্জুর। কিন্তু এত কিছুর পরও কোনো ধরনের বাগিবতণ্ডা বা সংঘর্ষে না জড়িয়ে নিজের নির্বিরোধী ভালো মানুষের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন মন্জুর। গত সংসদ নির্বাচনে দলের (আওয়ামী লীগ) মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। অবশেষে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্জুর প্রার্থী হলেন মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে। সংসদ নির্বাচনে পর্যুদস্ত বিএনপির পক্ষে তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া ছিল এক কঠিন কাজ। ফলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতিটাই প্রয়োগ করলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা, সমর্থন দিলেন মন্জুরকে।
সংসদ নির্বাচনে যে ব্যক্তি জামানত খুইয়েছিলেন, বিপুল ভোটে তাঁর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পেছনে যতটা না নিজের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল দাম্ভিক, দুর্বিনীত মহিউদ্দিনের বিপক্ষে জনরায়। এটাকেই নেতিবাচক (নেগেটিভ) ভোট বলতে চেয়েছি আমরা।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অন্যদের মতামতকে মূল্য না দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করা ইত্যাদি নানা কারণে মহিউদ্দিনের বিপক্ষে দলের ভেতরেই তখন জমে উঠেছিল অসন্তোষের পাহাড়। ঢাকায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সেই ক্ষোভ-অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রবীণ-নবীন নেতারা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা চট্টগ্রামে এসেও দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন দলের নেতা-কর্মীদের মনোভাব। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কোনো তরুণ নেতাকে এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দিলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারত বলে অনেকের ধারণা। কেননা, এই রায় যতটা মন্জুরের পক্ষে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মহিউদ্দিনের বিপক্ষে।
মনে হয়েছিল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দেবে। কিন্তু দিন বদলের অঙ্গীকার যাঁরা করেছিলেন, মানুষের মন বদলের হদিস তাঁরা পাননি। তাই শামীম ওসমানের মতো একজন বিতর্কিত সমালোচিত ব্যক্তিকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির পক্ষে যে জনমত তৈরি হয়েছিল; ‘সুশীল সমাজ’ নামের যে জনগোষ্ঠীকে প্রায়ই রাজনীতিকেরা ঠাট্টা-বিদ্রূপে বিদ্ধ করেন, তাঁরা যে ধরনের প্রার্থীর জন্য আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছিলেন মানুষের মনে, আইভী ছিলেন সে রকমই একজন প্রার্থী। এখানে তাই শুধু শামীম ওসমানের বিপক্ষেই নয়, আইভীর পক্ষে ইতিবাচক ভোট দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।
চট্টগ্রামে বিএনপি দলের ভেতর যোগ্য প্রার্থীর সন্ধান না পেয়ে মন্জুরকে সমর্থন দিয়েছিল; নারায়ণগঞ্জে আসলে যোগ্য প্রার্থীর সন্ধান তারা পায়নি। তৈমুর আলম খন্দকারকে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলে সেই ব্যর্থতার ভার লাঘবের চেষ্টা করেছে।
চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ—অনতিদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দুটি নির্বাচনে ভোটাররা একটি নতুন বার্তা রেখেছেন দুই প্রধান দলের কাছে। খ্যাতি-কুখ্যাতি যে কারণেই হোক, বহুল আলোচিত দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি ছাড়া কাউকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়—এ রকম প্রথাবদ্ধ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়তো হয়েছে। নিপাট ভদ্রলোক মন্জুর আলম আর ‘পাশের বাড়ির মেয়ের’ ইমেজের আইভীর বিজয় সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদি দলগুলো তা অনুধাবন করে, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই নামতে হবে সৎ মানুষের খোঁজে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments