সময়ের প্রতিধ্বনি-নির্দলীয় দক্ষ জনপ্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই by মোস্তফা কামাল

সরকারের একজন উপসচিব দুঃখ করে বললেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি একজন মন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। পরে তিনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে বদলি হয়ে যান। সেখানে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি দেশে ফেরেন। এর মধ্যে দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়েছে। কাজেই তাঁকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে।


ওই কর্মকর্তার প্রশ্ন, 'মন্ত্রীর একান্ত সচিব হওয়াটা কি দোষের ছিল? একান্ত সচিব হতে রাজি না হলে তো সরকারের আদেশ অমান্য করার দায়ে আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো। তার দায় কে নিত?'
এটা একটা উদাহরণ। বিভিন্ন পর্যায়ের এ রকম অনেক কর্মকর্তা ওএসডি হয়ে আছেন। তাঁরা বেতন ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, অথচ তাঁদের দক্ষতা ও মেধা জনপ্রশাসনের কোনো কাজে আসছে না। আমি এ কথা বলছি না যে সরকার দুর্নীতিবাজ কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি কেন করল? কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে (দুর্নীতি কিংবা চারিত্রিক স্খলনজনিত কারণে), তাহলে তাঁর অবশ্যই শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। তবে দলীয় প্রলেপ লাগিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করা উচিত নয়। এতে সরকারের জনপ্রশাসনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার সময় নিশ্চয়ই তাঁদের দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি। তাহলে এখন কেন দলীয় প্রলেপ লাগানো হচ্ছে? এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তারাও যে দায়ী নন তা বলা যাবে না। এক শ্রেণীর কর্মকর্তা নিজেদের ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য কারো কারো গায়ে রাজনৈতিক প্রলেপ লাগিয়ে নিচ্ছেন। এটা স্রেফ সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের একটা অপকৌশল। সেই অপকৌশলের ফাঁদে পা দিচ্ছে রাজনৈতিক সরকার। কি আওয়ামী লীগ, কি বিএনপি_উভয়েই জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করেছে। এ কারণে বিগত ৪০ বছরেও জনপ্রশাসন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি; বরং দিনে দিনে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে_যদিও এটা কারোই কাম্য ছিল না।
সরকার আসবে, সরকার যাবে; প্রশাসন থাকবে। সেই প্রশাসন হবে সামগ্রিক বিবেচনায় যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক। একটা দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার জন্য ৪০ বছর কম সময় নয়। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে আমরা একটা মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন পেয়েছি। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই প্রশাসনকে কোনো অবস্থানেই ফেলা যায় না; আমাদের জনপ্রশাসনের যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়ে বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হয়। প্রশাসনের লোকরাও নিশ্চয়ই এটা আশা করেন না!
বলা হয়ে থাকে, প্রশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে বিএনপি। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়ে প্রথম জনপ্রশাসনকে দলীয় প্রশাসন হিসেবে তৈরির উদ্যোগ নেয়। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দলীয় লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। পুলিশ প্রশাসনে ছাত্রদলের ক্যাডাররা নিয়োগ লাভ করে। বিচারক নিয়োগ হয় দলীয় পরিচয়ে। এভাবে সর্বক্ষেত্রে দলীয় লোকদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রশাসনকে তারা দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলে। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ। সেই ধারাবাহিকতা চলে আসছে। এখনো চলছে। এখন আর যোগ্যতা-দক্ষতার প্রয়োজন হয় না; দলীয় পরিচয় জেনে নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফলে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা ছিটকে পড়েন।
অবশ্য সরকারবদলের সঙ্গে সঙ্গে অযোগ্য-অথর্ব-সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিরা ঠিকই খোলস পাল্টে ফেলেন। একসময় যিনি সাফারি ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরতেন না, শহীদ জিয়া শহীদ জিয়া বলে মুখে ফেনা তুলতেন; তাঁকেই দেখা গেল সাফারির বদলে মুজিব কোট গায়ে জড়িয়ে বেশ আয়েশে ঘুরে বেড়ান। তিনি অতিমাত্রায় বঙ্গবন্ধুর ভক্ত বনে যান। বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে নিতে মুখে ফেনা তোলেন। অনেকে দেয়ালে কিংবা নিজ দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর ছবি রেখে প্রমাণ করতে চান, তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক!
সরকারি কর্মকর্তারা কেন বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়ার সৈনিক হবেন? এ প্রশ্ন কি কোনো দিন শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া করেছেন? তাঁরা যদি একবারও স্মরণ করিয়ে দিতেন, 'আপনারা দলীয় লোক নন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আপনারা দলীয় লোকের মতো আচরণ করবেন না', তাহলে কিন্তু প্রশাসনের লোকরা দলীয় লোকের মতো আচরণ করার সাহস পেতেন না। অথচ আমরা এর উল্টোটাই দেখি। উভয় নেত্রীই মতলববাজ কর্মকর্তাদের শুধু প্রশ্রয়ই দেন না, তাঁদের কাছেও টানেন। এ কারণে অনেকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের চেয়েও বেশি দলীয় লোকে পরিণত হন। আবার অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার লোভে দলীয় লোকের মতো আচরণ করেন। এই প্রবণতার কারণেই প্রশাসনে এখনো স্থবির অবস্থা।
প্রশাসনকে দলীয়করণের এই ন্যক্কারজনক খেলা আগে ছিল না। এরশাদের আমলেও প্রশাসন অনেকটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল_যদিও পুলিশবাহিনীকে তখনো সরকার ব্যবহার করেছিল। তবে জনপ্রশাসন রাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা এত বেশি ছিল না। এখন জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি_এই দুটি ধারায় পুরোপুরি বিভক্ত। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে জামায়াত। ভেতরে ভেতরে জামায়াত সর্বত্র তাদের কর্মীদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে স্বাধীনতার চেতনায় প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর সুযোগ খুবই কম।
আমাদের কাছে তথ্য আছে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের লোকরা বেশি সুযোগ পেয়েছে। ফলে প্রশাসনে জামায়াতপন্থীদের একটা বড় অংশ দখল করে আছে। উপজেলা পর্যায় থেকে সচিব পর্যন্ত সর্বত্রই জামায়াতের একটা অংশের সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং তারা বেশ সক্রিয়।
এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বারবার বলে আসছেন, 'প্রশাসন সরকারকে কোনো সহযোগিতা করছে না। প্রশাসনের শৈথিল্যের কারণে সরকারের অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।' অথচ সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূল কাজটি করে প্রশাসন। প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে জনগণকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ প্রশাসনিক দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও শৈথিল্যের কারণে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সরকার-সমর্থক কর্মকর্তারা চেষ্টা করলেও সরকারবিরোধী আরেকটি ধারা এর বিপক্ষে কাজ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য নানা অঘটনও ঘটাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ বিভাগের কিছু কর্মকাণ্ড সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ ছাত্রদের ডাকাত, সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী বানিয়ে পুলিশের অমানবিক নির্যাতনের ঘটনাটি এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সংস্কার না করায় রাজধানীসহ সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অথচ সংস্কারের কাজটি সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর বর্তায়। তাঁরা কিন্তু নির্বিকার। এসবের জন্য তাঁদের জবাবদিহি করতে হয় না। যেহেতু রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়, তাই জবাবদিহি তাদেরই করতে হয়। কারণ পাঁচ বছর পরে হলেও জনগণের কাছে তাদেরই যেতে হয়।
এক দিকে আমাদের অযোগ্য প্রশাসন, আরেক দিকে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের অদক্ষতা_এই দুয়ে মিলে সরকারি কাজকর্ম মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোনোমতে ঠেলাধাক্কা দিয়ে প্রশাসন চালানো হচ্ছে। এই প্রশাসন দিয়ে আর যা-ই হোক, দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করা যাবে না। দেশ বদলাতে হলে আগে প্রশাসনের খোলনলচে পাল্টাতে হবে। কোনো দলীয়, মতলববাজ লোককে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারবে না। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের তদ্বির করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে অযোগ্য বিবেচনা করতে হবে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর ভারত একটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছে। তারা জনপ্রশাসনের একটি শক্ত ভিত্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এখন সেখানকার প্রশাসনিক কাঠামো অত্যন্ত মজবুত। সেখানে সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু নীতি বদল হয় না। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অথবা উন্নয়নকাজ থেমে যায় না। প্রশাসন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর আমাদের এখানে সরকার বদল হলেই উন্নয়নকাজ থেমে যায়, নীতি বদলে যায়। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বিভিন্ন উন্নয়নকাজের অর্ধেক বা তার চেয়েও বেশি কাজ হওয়ার পর আর অর্থ ছাড় করা হয়নি। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক সেতু অর্ধেক হওয়ার পর আর হচ্ছে না। বিএনপি সরকারের আমলেও একই চিত্র আমরা দেখেছি। এ নিয়ে কোনো কোনো পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র পর্যন্ত করেছে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
আমরা যদি গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাই, তাহলেও কিন্তু দক্ষ প্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা যাবে না। প্রশাসনকে সাজাতে হবে সম্পূর্ণ নির্দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার দেশের ও গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি নির্দলীয় জনপ্রশাসন গড়ে তুলবে। এটা দেশের আপামর জনগণের দাবি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.