সহজিয়া কড়চা-সংবাদপত্র: জাতীয় চেতনা ও চ্যালেঞ্জ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
প্রথম আলো আজ চৌদ্দতে পড়ল। একটি দৈনিক পত্রিকার জন্য এটি কম বয়স নয়। পত্রিকারও মানুষের মতো জন্ম-মৃত্যু আছে। চিরকাল কোনো কাগজ প্রকাশিত হয় না। জন্মের পর একটি পত্রিকার প্রথম ১০-১৫ বছরই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠা না ঘটলে অথবা চারিত্র দাঁড়িয়ে না গেলে, পাঠকের মন জয় করতে না পারলে, দীর্ঘকাল টিকে থেকেও তা সমাজে কোনো অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে না। উপমহাদেশে বহু দীর্ঘজীবী পত্রিকার ক্ষেত্রে তা দেখা গেছে।
আবার কোনো কোনো কাগজ দীর্ঘায়ু শুধু নয়, টিকে আছে স্বমহিমায়। ঘটেছে তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, পালন করছে বৃহত্তর ভূমিকা। কলকাতা ও চেন্নাই থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা ও দ্য হিন্দুর কথা বলতে পারি।
কোনো কাজের পেছনে যদি কোনো এষণা না থাকে, তাহলে কাজটি সর্বাঙ্গসুন্দর হলেও তা একঘেয়ে ও প্রাণহীন হতে বাধ্য। উজ্জ্বলতা আসে সৃষ্টিশীলতায়, গতানুগতিকতায় নয়। সংবাদপত্র একটি পণ্য। সংবাদপত্র প্রকাশ একটি ব্যবসা বটে এবং সংবাদপত্র আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। কিন্তু সংবাদ তৈরি ও সংবাদপত্র সম্পাদনা একটি সম্পূর্ণ সৃষ্টিশীল কাজ। যে কাগজের সৃষ্টিশীলতা কম, পাঠকের কাছে তার আবেদন ও কদর কম। প্রথম আলোর সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এই কাগজে যাঁরা কাজ করেন এবং এখানে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা নন, সঠিক রায়টি দিতে পারবেন পাঠকেরাই।
প্রথম আলোর বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার অথবা স্বপ্নের স্বদেশ গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা মনে হতে পারে স্রেফ স্লোগান। কিন্তু তার ১৩ বছরের ভূমিকা রক্ষণশীল দৃষ্টিতে দেখলেও বোঝা যাবে, ওগুলোই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমাজের প্রতি তার একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা এবং পাঠকের রুচি নির্মাণ খুবই কঠিন কাজ। প্রথম আলো তা করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
একটি সময়ে বড় বড় কাগজকেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়েছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে আজ সে সংকট নেই। কিন্তু সংবাদপত্রের আজকের সংকট অতীতের অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও কঠিন। প্রকাশক, সম্পাদক ও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীদের অপ্রকাশ্য-প্রকাশ্য মারাত্মক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। সে চাপ শুধু স্বৈরতান্ত্রিক সরকার থেকে চাপ নয়, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর চাপ আরও কুৎসিত ও ভয়ংকর।
যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই বা নামমাত্র আছে, পার্লামেন্ট অকার্যকর, সরকারের দায়বদ্ধতা বলে কিছু নেই, প্রশাসনে সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনীতি কলুষিত ও দুর্বৃত্তায়িত, দুর্বল ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ সামাজিক অনাচারের কোনো শেষ নেই, সেখানে সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের কর্মীদের বিপদ প্রতিমুহূর্তে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনবহুল দেশগুলোর সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক ও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীদের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের একজন সম্পাদক ও সাংবাদিক যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, বাংলাদেশ, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদের সে সৌভাগ্য নেই।
প্রতিটি দেশের সংবাদপত্র তার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। প্রতিটি যুগের সংবাদপত্র সেই যুগেরই সৃষ্টি এবং যুগকেই ধারণ করে। প্রতিটি প্রগতিশীল সংবাদপত্র তার যুগকে বদলে দেওয়ারও চেষ্টা করে। জাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের অঙ্গীকার তার। ইংরেজ আমলে দেশপ্রেমিক সংবাদপত্রগুলোর মূল লড়াইয়ের জায়গাটা ছিল সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিক সরকার। লক্ষ্য ছিল, তা থেকে জনগণের মুক্তি। পাকিস্তানি যুগের গণমাধ্যমের প্রধান লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রের অবাঙালি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের আবেগকে তুলে ধরা। স্বাধীনতার পরে আমাদের গণমাধ্যমের ঘাড়ে যে দায়িত্ব বর্তায় তা আরও শক্ত: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও দেশ গঠন। বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি সামরিক স্বৈরশাসন অথবা নির্বাচিত স্বৈরাচার। ফলে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে প্রবল চাপ ও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়।
বিষয়ভিত্তিক সংবাদ সাময়িকীর একরকম কাজ। কিন্তু একালের মূলধারার সংবাদপত্র মূলত পলিটিক্যাল জার্নালিজম—রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। রাজনীতির সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতিও যুক্ত। রাজনৈতিক সাংবাদিকদের রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের কঠোর নজরদারির মধ্যে কাজ করতে হয়। যেখানে উদার গণতন্ত্র নেই, রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সংঘাতময়, সেখানে সংবিধান ও আইনের যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ ঘটা খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সাংবাদিকদের রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের বহু পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও তাঁদের সহকর্মী সাংবাদিকদের নামে বহু মামলা ঝুলছে। তাঁদের দৌড়ুতে হচ্ছে এক জেলা থেকে আরেক জেলার আদালতে। বাদী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার নয়, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। উন্নত বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এমনটি হয় না। যদিও দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো সাংবাদিকই পলিটিক্যাল মিশন নিয়ে কাজ করেন না। তাঁরা জনস্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে স্বেচ্ছায় বিপদ ডেকে আনেন।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই রাজনীতি এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সাংবাদিকতাও চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট, ভয়াবহ বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অকল্পনীয় দূরত্ব, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, আধিপত্যবাদী চাপ প্রভৃতি সমস্যার মধ্যে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতা কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় বা পথটি তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির সমস্যা সংবাদমাধ্যমেরও সমস্যা। বিশ্বব্যাপী আজ যে উত্তেজনা, তা থেকে উত্তরণে রাজনীতিকদের গণমাধ্যমের সহযোগিতা নিতে হবে। যদি তাঁরা তা না নেন, তাহলে আরও বড় বিপর্যয় ঘটবে। সে পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যম নয়—ভেসে যাবে প্রথাগত রাজনীতিও। সে জন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতার মধ্যে সমন্বয়মূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বর্তমান অবস্থা টিকিয়ে রাখতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চরম বৈরী আচরণ করছে। সাংবাদিকদের হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধার উদ্দেশ্যে তাদের ছলচাতুরীর অভাব হচ্ছে না। রচনা করা হচ্ছে, নতুন নতুন কালাকানুন ও অসভ্য বিধিবিধান।
আমরা আমাদের বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, তাহলে দেখব, ৫০ বছর আগের চেয়ে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের পরিধি আজ অনেক বেশি বিস্তৃত শুধু নয়, জটিলও বটে। এ অবস্থায় সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের দায়দায়িত্ব হাজার গুণ বেড়ে গেছে। রাষ্ট্র হয়ে উঠছে এক দানবীয় শক্তি। সংবাদপত্র রাষ্ট্রেরও পক্ষে, জনগণেরও পক্ষে। তবে কথাটা খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ শোনালেও বলতে হচ্ছে, যেখানে সরকারের স্বার্থের সঙ্গে জনগণের স্বার্থের সংঘাত ঘটবে, সেখানে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম জনগণেরই পাশে থাকবে। নিপীড়নকারী অন্যায় রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করা সংবাদপত্রের ধর্ম। বহু আগে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের পঞ্চম প্রধান শক্তি সংবাদপত্র।’ এখন আমরা তাঁর সেই বক্তব্যকে সংশোধন করে বলব, রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি হিসেবে সংবাদপত্রের রোল নম্বর পাঁচ থেকে আরও নিচে নেমে এসেছে। গণতন্ত্র ছাড়া রাষ্ট্র চলে, গণমাধ্যম ছাড়া চলে না।
নিন্দুকও বলতে বাধ্য, প্রথম আলো সাংবাদিকতায় নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। সম্পাদনার ক্ষেত্রে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। তৈরি করছে উন্নত রুচি। নারী ও যুবসমাজকেও সে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করছে। তবে শুধু প্রথম আলো নয়, বাংলাদেশে আজ বহু আধুনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম আছে বলেই আজও আমাদের সমাজে দুর্বলেরা বসবাস করতে পারছে। প্রশাসনের ওপর মানুষের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই, শেষ আশ্রয়স্থল আদালতের ওপরও মানুষের বিশ্বাস নড়ে গেছে, এই অবস্থায় সংবাদমাধ্যমই মানুষের শেষ ভরসা।
অনেক দিন আগে জার্মানির হামবুর্গে এক আলোচনায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানে একজন খ্যাতনামা সম্পাদক তাঁর বক্তৃতাপত্রে বলেছিলেন: কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে একুশ শতকে বহু সংবাদপত্রকে—অর্থাৎ প্রকাশক, সম্পাদক ও সাংবাদিককে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেখতে পাচ্ছি, কথাটি ষোলোআনা সত্য।
প্রথম আলো সার্বিক যুগের চৈতন্য ও জাতীয় চেতনাকে আরও বেশি করে ধারণ করবে—আজকের শুভলগ্নে সেই প্রত্যাশা করি।
l সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোনো কাজের পেছনে যদি কোনো এষণা না থাকে, তাহলে কাজটি সর্বাঙ্গসুন্দর হলেও তা একঘেয়ে ও প্রাণহীন হতে বাধ্য। উজ্জ্বলতা আসে সৃষ্টিশীলতায়, গতানুগতিকতায় নয়। সংবাদপত্র একটি পণ্য। সংবাদপত্র প্রকাশ একটি ব্যবসা বটে এবং সংবাদপত্র আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। কিন্তু সংবাদ তৈরি ও সংবাদপত্র সম্পাদনা একটি সম্পূর্ণ সৃষ্টিশীল কাজ। যে কাগজের সৃষ্টিশীলতা কম, পাঠকের কাছে তার আবেদন ও কদর কম। প্রথম আলোর সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এই কাগজে যাঁরা কাজ করেন এবং এখানে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা নন, সঠিক রায়টি দিতে পারবেন পাঠকেরাই।
প্রথম আলোর বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার অথবা স্বপ্নের স্বদেশ গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা মনে হতে পারে স্রেফ স্লোগান। কিন্তু তার ১৩ বছরের ভূমিকা রক্ষণশীল দৃষ্টিতে দেখলেও বোঝা যাবে, ওগুলোই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমাজের প্রতি তার একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা এবং পাঠকের রুচি নির্মাণ খুবই কঠিন কাজ। প্রথম আলো তা করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
একটি সময়ে বড় বড় কাগজকেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়েছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে আজ সে সংকট নেই। কিন্তু সংবাদপত্রের আজকের সংকট অতীতের অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও কঠিন। প্রকাশক, সম্পাদক ও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীদের অপ্রকাশ্য-প্রকাশ্য মারাত্মক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। সে চাপ শুধু স্বৈরতান্ত্রিক সরকার থেকে চাপ নয়, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর চাপ আরও কুৎসিত ও ভয়ংকর।
যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই বা নামমাত্র আছে, পার্লামেন্ট অকার্যকর, সরকারের দায়বদ্ধতা বলে কিছু নেই, প্রশাসনে সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনীতি কলুষিত ও দুর্বৃত্তায়িত, দুর্বল ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ সামাজিক অনাচারের কোনো শেষ নেই, সেখানে সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের কর্মীদের বিপদ প্রতিমুহূর্তে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনবহুল দেশগুলোর সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক ও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীদের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের একজন সম্পাদক ও সাংবাদিক যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, বাংলাদেশ, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদের সে সৌভাগ্য নেই।
প্রতিটি দেশের সংবাদপত্র তার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। প্রতিটি যুগের সংবাদপত্র সেই যুগেরই সৃষ্টি এবং যুগকেই ধারণ করে। প্রতিটি প্রগতিশীল সংবাদপত্র তার যুগকে বদলে দেওয়ারও চেষ্টা করে। জাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের অঙ্গীকার তার। ইংরেজ আমলে দেশপ্রেমিক সংবাদপত্রগুলোর মূল লড়াইয়ের জায়গাটা ছিল সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিক সরকার। লক্ষ্য ছিল, তা থেকে জনগণের মুক্তি। পাকিস্তানি যুগের গণমাধ্যমের প্রধান লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রের অবাঙালি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের আবেগকে তুলে ধরা। স্বাধীনতার পরে আমাদের গণমাধ্যমের ঘাড়ে যে দায়িত্ব বর্তায় তা আরও শক্ত: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও দেশ গঠন। বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি সামরিক স্বৈরশাসন অথবা নির্বাচিত স্বৈরাচার। ফলে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে প্রবল চাপ ও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়।
বিষয়ভিত্তিক সংবাদ সাময়িকীর একরকম কাজ। কিন্তু একালের মূলধারার সংবাদপত্র মূলত পলিটিক্যাল জার্নালিজম—রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। রাজনীতির সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতিও যুক্ত। রাজনৈতিক সাংবাদিকদের রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের কঠোর নজরদারির মধ্যে কাজ করতে হয়। যেখানে উদার গণতন্ত্র নেই, রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সংঘাতময়, সেখানে সংবিধান ও আইনের যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ ঘটা খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সাংবাদিকদের রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের বহু পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও তাঁদের সহকর্মী সাংবাদিকদের নামে বহু মামলা ঝুলছে। তাঁদের দৌড়ুতে হচ্ছে এক জেলা থেকে আরেক জেলার আদালতে। বাদী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার নয়, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। উন্নত বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এমনটি হয় না। যদিও দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো সাংবাদিকই পলিটিক্যাল মিশন নিয়ে কাজ করেন না। তাঁরা জনস্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে স্বেচ্ছায় বিপদ ডেকে আনেন।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই রাজনীতি এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সাংবাদিকতাও চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট, ভয়াবহ বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অকল্পনীয় দূরত্ব, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, আধিপত্যবাদী চাপ প্রভৃতি সমস্যার মধ্যে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতা কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় বা পথটি তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির সমস্যা সংবাদমাধ্যমেরও সমস্যা। বিশ্বব্যাপী আজ যে উত্তেজনা, তা থেকে উত্তরণে রাজনীতিকদের গণমাধ্যমের সহযোগিতা নিতে হবে। যদি তাঁরা তা না নেন, তাহলে আরও বড় বিপর্যয় ঘটবে। সে পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যম নয়—ভেসে যাবে প্রথাগত রাজনীতিও। সে জন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতার মধ্যে সমন্বয়মূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বর্তমান অবস্থা টিকিয়ে রাখতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চরম বৈরী আচরণ করছে। সাংবাদিকদের হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধার উদ্দেশ্যে তাদের ছলচাতুরীর অভাব হচ্ছে না। রচনা করা হচ্ছে, নতুন নতুন কালাকানুন ও অসভ্য বিধিবিধান।
আমরা আমাদের বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, তাহলে দেখব, ৫০ বছর আগের চেয়ে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের পরিধি আজ অনেক বেশি বিস্তৃত শুধু নয়, জটিলও বটে। এ অবস্থায় সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের দায়দায়িত্ব হাজার গুণ বেড়ে গেছে। রাষ্ট্র হয়ে উঠছে এক দানবীয় শক্তি। সংবাদপত্র রাষ্ট্রেরও পক্ষে, জনগণেরও পক্ষে। তবে কথাটা খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ শোনালেও বলতে হচ্ছে, যেখানে সরকারের স্বার্থের সঙ্গে জনগণের স্বার্থের সংঘাত ঘটবে, সেখানে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম জনগণেরই পাশে থাকবে। নিপীড়নকারী অন্যায় রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করা সংবাদপত্রের ধর্ম। বহু আগে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের পঞ্চম প্রধান শক্তি সংবাদপত্র।’ এখন আমরা তাঁর সেই বক্তব্যকে সংশোধন করে বলব, রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি হিসেবে সংবাদপত্রের রোল নম্বর পাঁচ থেকে আরও নিচে নেমে এসেছে। গণতন্ত্র ছাড়া রাষ্ট্র চলে, গণমাধ্যম ছাড়া চলে না।
নিন্দুকও বলতে বাধ্য, প্রথম আলো সাংবাদিকতায় নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। সম্পাদনার ক্ষেত্রে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। তৈরি করছে উন্নত রুচি। নারী ও যুবসমাজকেও সে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করছে। তবে শুধু প্রথম আলো নয়, বাংলাদেশে আজ বহু আধুনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম আছে বলেই আজও আমাদের সমাজে দুর্বলেরা বসবাস করতে পারছে। প্রশাসনের ওপর মানুষের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই, শেষ আশ্রয়স্থল আদালতের ওপরও মানুষের বিশ্বাস নড়ে গেছে, এই অবস্থায় সংবাদমাধ্যমই মানুষের শেষ ভরসা।
অনেক দিন আগে জার্মানির হামবুর্গে এক আলোচনায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানে একজন খ্যাতনামা সম্পাদক তাঁর বক্তৃতাপত্রে বলেছিলেন: কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে একুশ শতকে বহু সংবাদপত্রকে—অর্থাৎ প্রকাশক, সম্পাদক ও সাংবাদিককে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেখতে পাচ্ছি, কথাটি ষোলোআনা সত্য।
প্রথম আলো সার্বিক যুগের চৈতন্য ও জাতীয় চেতনাকে আরও বেশি করে ধারণ করবে—আজকের শুভলগ্নে সেই প্রত্যাশা করি।
l সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments