যুদ্ধে পৌরুষ হারানোর বিষয়টি জানতাম না-অদিতি ফাল্গুনীর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পিয়াস মজিদ
পিয়াস মজিদ: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আপনি কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁদের লেখা ডায়েরি উদ্ধার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পৌরুষহারাদের মর্মন্তুদ কাহিনিকে অপৌরুষেয় ১৯৭১ নামে সুদীর্ঘ গল্পের কাঠামো দিয়েছেন। এই গল্প লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নতুন কোনো সত্য কি আপনার সামনে উন্মোচিত হয়েছে?
অদিতি ফাল্গুনী: আসলে ঢাকার মোহাম্মদপুরের কলেজ গেটে অবস্থিত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ পরিচালিত একটি রোগমুক্তি বিশ্রামাগারে প্রথম আমি যাই ২০০০ সালে। সেখানে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোদাস্বার হোসেন মধু আমাকে তাঁর লেখা একটি দিনলিপি দেন। ওই যোদ্ধা স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেটের হিসাবে হয়তো ‘স্বল্পশিক্ষিত’ ছিলেন। কাঁচা অক্ষর, ভুল বানান। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর একধরনের নির্মোহ অবলোকনে। সেই দিনলিপি থেকেই প্রথম জানতে পারি, শুধু হাত-পা-চোখ বা কানই নয়, যুদ্ধে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা জৈবিক অর্থে পৌরুষের দিকটাও হারিয়েছেন। এই দিনপঞ্জিতে বলা হচ্ছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কিছু মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে ১৮ বছর বয়সী সিলেটের মুক্তিযোদ্ধা রহমান বঙ্গবন্ধুর সামনে ট্রাউজার খুলে বলেছিলেন, ‘দ্যাখেন, আমরা যুদ্ধে কী হারিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধু তখন তাঁর মুখ ঢেকে ফেলেছিলেন। মধু নিজেও যুদ্ধে পৌরুষ হারিয়েছেন বলে দিনলিপিতে আক্ষেপ করেছেন। দিনলিপিটা ফটোকপি করে মোদাস্বার হোসেন মধুকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর অনেক বছর আমি এ বিষয়ে আর কাজ করিনি। ২০০৯ সালের মার্চে ওই বিশ্রামাগারে গিয়ে জানতে পারি, মধু আর বেঁচে নেই। তিনি ২০০৫ সালে মারা গেছেন।
যুদ্ধে নারীর সম্ভ্রমহানির ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু যুদ্ধে পৌরুষ হারানোর এই বিষয়টি আমি অন্তত আগে কখনো শুনিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আমার এই গল্পে...এটা কিন্তু খুব বেশি বাস্তব জীবনভিত্তিক...এক বীরাঙ্গনা নারীর কথা বলা হচ্ছে। যুদ্ধের পর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামাগারে সেই তরুণী এসে প্রায়ই বলতেন, তাঁর যেমন ‘নারীত্ব’ নেই, মধুরাও তো তাদের ‘পুরুষত্ব’ হারিয়েছেন। বরং তিনি হাঁটতে পারেন, মধুরা তা-ও পারেন না। মধুর দিনলিপির এই জায়গাটা পড়ার সময় এবং সেটা আমার গল্পে ব্যবহারের সময় ব্যক্তিগতভাবে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
পিয়াস: প্রাচীন উপকথা, ইতিহাস ইত্যাদি গল্পে (যেমন—‘লতাটানা গান ও হাতি খেদার উপকথা’, ‘বারগির, রেশম ও রসুন বোনার গল্প’) রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে একালের লেখক হিসেবে আপনার মনে বিশেষ কোন চিন্তা কাজ করেছে?
অদিতি: এই প্রশ্নটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগল। আসলে অপৌরুষেয় ১৯৭১-এ এই দুটো গল্প লিখতেই লেখক হিসেবে যাকে বলে ‘সৃজনশীল আনন্দ’, তা আমি সবচেয়ে বেশি পেয়েছি। সাত মাস আগেও আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম, সেখানে এক হাজং আদিবাসী ভদ্রমহিলা আমাদের সহকর্মী ছিলেন। টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজংয়ের মেয়ে অঞ্জলি হাজং। যেহেতু উপমহাদেশের অন্যতম বামপন্থী নেতা কমরেড মণি সিংহের জীবনসংগ্রাম নামের আত্মজীবনী পাঠ মারফত ব্রিটিশ আমলের শেষ ও পাকিস্তান আমলের শুরুতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ এলাকার ‘টঙ্ক’ আন্দোলন বা ফসলের ন্যায্য হিস্যার জন্য হাজং আদিবাসীদের আন্দোলন সম্পর্কে আমার সামান্য কিছু ধারণা ছিল, সেহেতু অঞ্জলি দি-কে ডেকে মাঝেমধ্যেই আমি হাজং ইতিহাস, ভাষা ও ঐতিহ্য নিয়ে এটা-সেটা প্রশ্ন করতাম। ১২৮০ সালে সোমনাথ পাঠক নামের এক ব্রাহ্মণ অভিযাত্রী যুবক একটি তীর্থদলের সঙ্গে পরিভ্রমণরত অবস্থায় সুসং দুর্গাপুর গিয়ে সেখানে প্রথম বাঙালি বসতি স্থাপন করেন। আগে এই এলাকা ছিল গারো ও হাজংদের আবাসভূমি। সোমনাথ পাঠকের নামেই ওই এলাকার নদীটির নাম হয় সোমেশ্বরী। বিদ্রোহের নায়ক মনা হাজংকে নিয়ে এই গল্প। মনার বাবাও হাতি খেদার কাজে নিহত হয়েছিলেন। সদ্য বিবাহিত যুবক মনা জমিদারের অন্যায় নির্দেশ পালন না করে হাজং বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। তাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে হত্যা করে জমিদারের পরিবার। মনার নাতি-নাতনিরা টঙ্ক আন্দোলনে অংশ নেবে—এমন এক আভাসে শেষ হচ্ছে এই গল্প।
পিয়াস: ‘স্বপ্ন সংহিতা’ গল্পে একদিকে যেমন দুর্ভিক্ষ ভারাতুর সময়ের চিত্র পাই, তেমনি নারীর প্রতীকে শস্যের স্বপ্নও সাকার হতে দেখি। চূড়ান্ত নেতিমূলক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এমন স্বপ্নের প্রণোদনা পান কোথা থেকে?
অদিতি: স্বপ্ন তো স্বপ্নই, যার কোনো ধড়-মুণ্ড, শিং-লেজ নেই। আমার বিভিন্ন সময়ে দেখা বিভিন্ন স্বপ্নের একটি গ্রন্থনা এই ‘স্বপ্ন সংহিতা’। জাপানি চলচ্চিত্রনির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার ড্রিমস নিশ্চয়ই দেখেছেন। ফ্রয়েড বা ইয়ুংয়ের স্বপ্ন ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে আমাদের দেশের সোলেমানি খাবনামা...স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই। ব্যাখ্যাতীত।
পিয়াস: আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে অপৌরুষেয় ১৯৭১ গল্পগ্রন্থেও আদিবাসী জনজীবনের প্রতি বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করি। এ আগ্রহের উৎস কোথায়?
অদিতি: ঘোর শৈশবের এক থেকে দেড়টি বছর বাবার চাকরিসূত্রে আমরা রাঙামাটি ছিলাম। নীল লেক, বৌদ্ধ প্যাগোডা, পাহাড় আর আদিবাসী মানুষজন...সেই বোধ করি ধমনিতে আদিবাসী মানুষের জন্য একটি আলাদা আগ্রহ আর ভালোবাসা সঞ্চারিত হয়েছিল। এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে সেই একই ‘...হয় বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি মুসলমানের গল্প’ ছাড়াও অন্যতর মানুষের কাহিনি বলাটাও লেখক হিসেবে জরুরি মনে হয়েছে।
পিয়াস: ‘বলো আমার নাম লাল!’ শীর্ষক গল্পে দেখতে পাই, প্রাচ্যকন্যার সঙ্গে প্রেমের ক্ষেত্রেও প্রতীচ্যপুরুষ তার প্রভুত্বের বিষয়টি কেন্দ্রে রাখে আর প্রাচ্যকন্যা ‘আমি তোমার উপনিবেশ নই’ বলে প্রেমাস্পদকে প্রত্যাখ্যান করে। দেখা যাচ্ছে, গল্পে হূদয়বৃত্তির প্রকাশকেও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত-বিযুক্ত করে দেখেন না আপনি। আপনার এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানতে চাই।
অদিতি: নারী-পুরুষের সম্পর্ক পৃথিবীর আদিতম রাজনৈতিক সম্পর্ক। এই বিষয়টি আরও জোরদার হয় যখন পুরুষটি তথাকথিত ‘উন্নততর’ পশ্চিমের মানুষ ও মেয়েটি সাদা পশ্চিমের ‘বাদামি/কালো/পীত’ উপনিবেশের মেয়ে। তাই বলে কি প্রেম হয় না? ‘বলো, আমার নাম লাল!’—এই গল্পে মার্কিন ছেলে ও বাঙালি মেয়ের প্রেম তো হয়েছে। আবার সেই প্রেমে কিছু সাংস্কৃতিক ব্যবধানও ছিল। এই ব্যবধান ঠিক এই আঙ্গিকে না হলেও...একটি বাঙালি ছেলে ও বাঙালি মেয়ের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। যে দূরত্বের কারণে প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গে মিললেও শান্তি পাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন কবি শহীদ কাদরী। পৃথিবীর সুখীতম স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গনের মধ্যেও দূরপ্রসারী শূন্যতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যখন কাউকে আলিঙ্গন করি, আসলে আমরা আমাদের শূন্যতা ও একাকিত্বকেই কোনো না কোনোভাবে আলিঙ্গন করি। লালন সাঁইয়ের গানে যেমন লালন ও তার পড়শি এক স্থানে থেকেও লক্ষ যোজন দূরে থাকে। খুব বেশি পেঁচিয়ে ফেললাম কি?
পিয়াস: উদ্দিষ্ট বিষয়ের যথাযথ ব্যাখ্যার জন্য আপনার গল্পে প্রায়ই কবিতা আর গানের শরণ নিতে দেখা যায় কথককে। আবার কখনো প্রাসঙ্গিক অনেক দলিল-দস্তাবেজেরও সমাবেশ ঘটে। গল্পে বিভিন্ন মাধ্যমের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে আপনি কি ধারাবাহিক বর্ণনার ক্লান্তি থেকে পাঠককে মুক্তি দিতে চান?
অদিতি: ইদানীং ততটা না দেখলেও একটা সময় আমি প্রচুর বিদেশি সিনেমা দেখেছি। হলিউডের অ্যাকশন বা থ্রিলার ছবি না। কুরোসাওয়া, তারাকোভস্কি, ফেলিনি, ডিসিকা, জাঁ লুক গদার...এঁদের ছবি। আমি খুব প্রভাবিত হয়েছি এসব বিদেশি ধ্রুপদি চলচ্চিত্রনির্মাতার কথনভঙ্গিতে। জেমস জয়েসের উপন্যাসে যেমন চেতনা প্রবাহরীতির ব্যবহার পাওয়া যায়। ‘সাদা দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে’ বলার বদলে জয়েস বলবেন ‘সাদা...দেয়াল। টয়োটা কার লাল!’ আপনাকে বুঝে নিতে হবে, সাদা দেয়ালে টয়োটা কোম্পানির লাল গাড়ির ছবিসংবলিত ক্যালেন্ডার ঝুলছে।
যুদ্ধে নারীর সম্ভ্রমহানির ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু যুদ্ধে পৌরুষ হারানোর এই বিষয়টি আমি অন্তত আগে কখনো শুনিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। আমার এই গল্পে...এটা কিন্তু খুব বেশি বাস্তব জীবনভিত্তিক...এক বীরাঙ্গনা নারীর কথা বলা হচ্ছে। যুদ্ধের পর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামাগারে সেই তরুণী এসে প্রায়ই বলতেন, তাঁর যেমন ‘নারীত্ব’ নেই, মধুরাও তো তাদের ‘পুরুষত্ব’ হারিয়েছেন। বরং তিনি হাঁটতে পারেন, মধুরা তা-ও পারেন না। মধুর দিনলিপির এই জায়গাটা পড়ার সময় এবং সেটা আমার গল্পে ব্যবহারের সময় ব্যক্তিগতভাবে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
পিয়াস: প্রাচীন উপকথা, ইতিহাস ইত্যাদি গল্পে (যেমন—‘লতাটানা গান ও হাতি খেদার উপকথা’, ‘বারগির, রেশম ও রসুন বোনার গল্প’) রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে একালের লেখক হিসেবে আপনার মনে বিশেষ কোন চিন্তা কাজ করেছে?
অদিতি: এই প্রশ্নটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগল। আসলে অপৌরুষেয় ১৯৭১-এ এই দুটো গল্প লিখতেই লেখক হিসেবে যাকে বলে ‘সৃজনশীল আনন্দ’, তা আমি সবচেয়ে বেশি পেয়েছি। সাত মাস আগেও আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম, সেখানে এক হাজং আদিবাসী ভদ্রমহিলা আমাদের সহকর্মী ছিলেন। টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজংয়ের মেয়ে অঞ্জলি হাজং। যেহেতু উপমহাদেশের অন্যতম বামপন্থী নেতা কমরেড মণি সিংহের জীবনসংগ্রাম নামের আত্মজীবনী পাঠ মারফত ব্রিটিশ আমলের শেষ ও পাকিস্তান আমলের শুরুতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ এলাকার ‘টঙ্ক’ আন্দোলন বা ফসলের ন্যায্য হিস্যার জন্য হাজং আদিবাসীদের আন্দোলন সম্পর্কে আমার সামান্য কিছু ধারণা ছিল, সেহেতু অঞ্জলি দি-কে ডেকে মাঝেমধ্যেই আমি হাজং ইতিহাস, ভাষা ও ঐতিহ্য নিয়ে এটা-সেটা প্রশ্ন করতাম। ১২৮০ সালে সোমনাথ পাঠক নামের এক ব্রাহ্মণ অভিযাত্রী যুবক একটি তীর্থদলের সঙ্গে পরিভ্রমণরত অবস্থায় সুসং দুর্গাপুর গিয়ে সেখানে প্রথম বাঙালি বসতি স্থাপন করেন। আগে এই এলাকা ছিল গারো ও হাজংদের আবাসভূমি। সোমনাথ পাঠকের নামেই ওই এলাকার নদীটির নাম হয় সোমেশ্বরী। বিদ্রোহের নায়ক মনা হাজংকে নিয়ে এই গল্প। মনার বাবাও হাতি খেদার কাজে নিহত হয়েছিলেন। সদ্য বিবাহিত যুবক মনা জমিদারের অন্যায় নির্দেশ পালন না করে হাজং বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। তাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে হত্যা করে জমিদারের পরিবার। মনার নাতি-নাতনিরা টঙ্ক আন্দোলনে অংশ নেবে—এমন এক আভাসে শেষ হচ্ছে এই গল্প।
পিয়াস: ‘স্বপ্ন সংহিতা’ গল্পে একদিকে যেমন দুর্ভিক্ষ ভারাতুর সময়ের চিত্র পাই, তেমনি নারীর প্রতীকে শস্যের স্বপ্নও সাকার হতে দেখি। চূড়ান্ত নেতিমূলক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এমন স্বপ্নের প্রণোদনা পান কোথা থেকে?
অদিতি: স্বপ্ন তো স্বপ্নই, যার কোনো ধড়-মুণ্ড, শিং-লেজ নেই। আমার বিভিন্ন সময়ে দেখা বিভিন্ন স্বপ্নের একটি গ্রন্থনা এই ‘স্বপ্ন সংহিতা’। জাপানি চলচ্চিত্রনির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার ড্রিমস নিশ্চয়ই দেখেছেন। ফ্রয়েড বা ইয়ুংয়ের স্বপ্ন ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে আমাদের দেশের সোলেমানি খাবনামা...স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই। ব্যাখ্যাতীত।
পিয়াস: আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে অপৌরুষেয় ১৯৭১ গল্পগ্রন্থেও আদিবাসী জনজীবনের প্রতি বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করি। এ আগ্রহের উৎস কোথায়?
অদিতি: ঘোর শৈশবের এক থেকে দেড়টি বছর বাবার চাকরিসূত্রে আমরা রাঙামাটি ছিলাম। নীল লেক, বৌদ্ধ প্যাগোডা, পাহাড় আর আদিবাসী মানুষজন...সেই বোধ করি ধমনিতে আদিবাসী মানুষের জন্য একটি আলাদা আগ্রহ আর ভালোবাসা সঞ্চারিত হয়েছিল। এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে সেই একই ‘...হয় বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি মুসলমানের গল্প’ ছাড়াও অন্যতর মানুষের কাহিনি বলাটাও লেখক হিসেবে জরুরি মনে হয়েছে।
পিয়াস: ‘বলো আমার নাম লাল!’ শীর্ষক গল্পে দেখতে পাই, প্রাচ্যকন্যার সঙ্গে প্রেমের ক্ষেত্রেও প্রতীচ্যপুরুষ তার প্রভুত্বের বিষয়টি কেন্দ্রে রাখে আর প্রাচ্যকন্যা ‘আমি তোমার উপনিবেশ নই’ বলে প্রেমাস্পদকে প্রত্যাখ্যান করে। দেখা যাচ্ছে, গল্পে হূদয়বৃত্তির প্রকাশকেও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত-বিযুক্ত করে দেখেন না আপনি। আপনার এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানতে চাই।
অদিতি: নারী-পুরুষের সম্পর্ক পৃথিবীর আদিতম রাজনৈতিক সম্পর্ক। এই বিষয়টি আরও জোরদার হয় যখন পুরুষটি তথাকথিত ‘উন্নততর’ পশ্চিমের মানুষ ও মেয়েটি সাদা পশ্চিমের ‘বাদামি/কালো/পীত’ উপনিবেশের মেয়ে। তাই বলে কি প্রেম হয় না? ‘বলো, আমার নাম লাল!’—এই গল্পে মার্কিন ছেলে ও বাঙালি মেয়ের প্রেম তো হয়েছে। আবার সেই প্রেমে কিছু সাংস্কৃতিক ব্যবধানও ছিল। এই ব্যবধান ঠিক এই আঙ্গিকে না হলেও...একটি বাঙালি ছেলে ও বাঙালি মেয়ের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। যে দূরত্বের কারণে প্রেমিক প্রেমিকার সঙ্গে মিললেও শান্তি পাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন কবি শহীদ কাদরী। পৃথিবীর সুখীতম স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গনের মধ্যেও দূরপ্রসারী শূন্যতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যখন কাউকে আলিঙ্গন করি, আসলে আমরা আমাদের শূন্যতা ও একাকিত্বকেই কোনো না কোনোভাবে আলিঙ্গন করি। লালন সাঁইয়ের গানে যেমন লালন ও তার পড়শি এক স্থানে থেকেও লক্ষ যোজন দূরে থাকে। খুব বেশি পেঁচিয়ে ফেললাম কি?
পিয়াস: উদ্দিষ্ট বিষয়ের যথাযথ ব্যাখ্যার জন্য আপনার গল্পে প্রায়ই কবিতা আর গানের শরণ নিতে দেখা যায় কথককে। আবার কখনো প্রাসঙ্গিক অনেক দলিল-দস্তাবেজেরও সমাবেশ ঘটে। গল্পে বিভিন্ন মাধ্যমের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে আপনি কি ধারাবাহিক বর্ণনার ক্লান্তি থেকে পাঠককে মুক্তি দিতে চান?
অদিতি: ইদানীং ততটা না দেখলেও একটা সময় আমি প্রচুর বিদেশি সিনেমা দেখেছি। হলিউডের অ্যাকশন বা থ্রিলার ছবি না। কুরোসাওয়া, তারাকোভস্কি, ফেলিনি, ডিসিকা, জাঁ লুক গদার...এঁদের ছবি। আমি খুব প্রভাবিত হয়েছি এসব বিদেশি ধ্রুপদি চলচ্চিত্রনির্মাতার কথনভঙ্গিতে। জেমস জয়েসের উপন্যাসে যেমন চেতনা প্রবাহরীতির ব্যবহার পাওয়া যায়। ‘সাদা দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে’ বলার বদলে জয়েস বলবেন ‘সাদা...দেয়াল। টয়োটা কার লাল!’ আপনাকে বুঝে নিতে হবে, সাদা দেয়ালে টয়োটা কোম্পানির লাল গাড়ির ছবিসংবলিত ক্যালেন্ডার ঝুলছে।
No comments