সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও বাংলাদেশ by ড. সুব্রত কুমার সাহা
ভূপৃষ্ঠ ও এর ভেতরের অংশ এক বিশাল শক্তির আধার। এটি বেশ কিছু শীলাস্তর বা ভাঁজের সমষ্টি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূত্বক কতকগুলো প্লেটে বিভক্ত, যেগুলোর নাম টেকটোনিক প্লেট। এগুলো সব সময় চলমান। চলন্ত অবস্থায় একটি প্লেটের সঙ্গে অন্য প্লেটের সংঘর্ষে কম্পন অনুভূত হয়। আবার কখনো ভূ-অভ্যন্তরে জমে থাকা বিপুল শক্তি মুক্ত হয়ে ঝাঁকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি করে। এ কম্পন বা তরঙ্গ পার্শ্ববর্তী শীলাস্তরে ছড়িয়ে পড়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে।
ভূ-অভ্যন্তরে যেখানে শক্তি মুক্ত হয়, তাকে কেন্দ্র (Foens) এবং কেন্দ্র বরাবর লম্বালম্বিভাবে ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্থানকে উপকেন্দ্র বা (Epicentre) বলে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সিকিমের গ্যাংটকে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পটি Indian Plate ও Euresian Plate-এর মধ্যে সংঘর্ষের ফল। এটি Plate boundaryতে সৃষ্টি হয়েছে। USGS-এর ভাষ্য অনুযায়ী, এটি পর পর তিনবার ছোটবড় আঘাত হানে এবং সর্বমোট ২০ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়।
উপাত্ত থেকে দেখা গেছে, ভূমিকম্পটির উপকেন্দ্র Lesser Himalaya region সিকিমের গ্যাংটকের কাছাকাছি অবস্থিত এবং এটি উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর ধাবিত হয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান তিনটি প্লেটের মধ্যবর্তী।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে ভূপ্রবণ হিসেবে তিনটি জোনে ভাগ করেছেন। প্রথম জোন উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশ, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ, দ্বিতীয় জোন ঢাকা, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, বগুড়া ও দিনাজপুর এবং তৃতীয় জোন বাংলাদেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চল। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও (৫.৫ থেকে ৬ রিখটার স্কেল) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা শহর। কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশেষ করে নদী, খালবিল, পুকুর ভরাট করে হাউজিং প্রকল্পগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভূমিকম্পসহিষ্ণু কোনো ভবন তৈরি করা হয়নি। নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, প্রয়োজন অনুযায়ী মাটির গুণাগুণ যাচাই না করা এবং পর্যাপ্ত পাইলিং না করে ভবন তৈরি করা হয়। ভূকম্পন তুলনামূলকভাবে বেশি হবে রামপুরা, বেগুনবাড়ী খালের আশপাশ, পাগলা খালের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ এলাকা, আদাবর, বসুন্ধরা, শ্যামলী ও তুরাগ নদীসংলগ্ন এলাকায়। এ এলাকাগুলো তুলনামূলকভাবে নরম মাটির ওপর অবস্থিত। শক্ত মাটিতে (মধুপুর ব্লে বা লাল রঙের মাটি) এ ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় সর্বশেষ বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৮৯৭ সালের ১২ জুন, যার মাত্রা ছিল ৮.৭। কিন্তু তখন ছোট শহর ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি ছিল কম। ভূমিকম্পের উপাত্তে দেখা যায়, প্রতি ১০০ বছর অন্তর বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। যদি মধুপুর ফল্ট সক্রিয় হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ঢাকা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বরের ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে ২২ জন এবং ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে চারজন মারা যায়। বাংলাদেশে গড়ে ২৫টি ভূকম্পন হয়। বিশ্বের আশঙ্কাজনক তালিকার ২২টি নগরীর মধ্যে ঢাকা অন্যতম।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ভারত ও নেপালে ৬৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। ভূমিধসসহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে জাতীয় অনেক সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক আতঙ্ক। ভূমিকম্পবিষয়ক পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো আমাদের দেশে হয়নি। CDMP-এর প্রকল্পে ঢাকাসহ বড় কয়েকটি জেলায় সিসমিক ম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। তারা বেশ কিছু ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় করণীয় যেসব ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়েছে, প্রচারের অভাবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ জন্য গণমাধ্যমের সচেতনতা তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার পর আমাদের টনক নড়ে। টক শো, পত্রিকার নিবন্ধ_এগুলোর রেশ সপ্তাহখানেক চলে। জরুরি বিষয় হলো, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সামাজিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে উদ্দীপনামূলক প্রচারণা সারা বছর ধরে চালাতে পারে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। সম্প্রতি বেশ কিছু বিষয়ে সামাজিক সংগঠনগুলো আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এভাবে সামাজিকের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণও জরুরি হয়ে পড়েছে। রুটিন ওয়ার্কের বাইরে অ্যাকশনধর্মী ওয়ার্কে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সিকিমের গ্যাংটকে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পটি Indian Plate ও Euresian Plate-এর মধ্যে সংঘর্ষের ফল। এটি Plate boundaryতে সৃষ্টি হয়েছে। USGS-এর ভাষ্য অনুযায়ী, এটি পর পর তিনবার ছোটবড় আঘাত হানে এবং সর্বমোট ২০ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়।
উপাত্ত থেকে দেখা গেছে, ভূমিকম্পটির উপকেন্দ্র Lesser Himalaya region সিকিমের গ্যাংটকের কাছাকাছি অবস্থিত এবং এটি উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর ধাবিত হয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান তিনটি প্লেটের মধ্যবর্তী।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে ভূপ্রবণ হিসেবে তিনটি জোনে ভাগ করেছেন। প্রথম জোন উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশ, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ, দ্বিতীয় জোন ঢাকা, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, বগুড়া ও দিনাজপুর এবং তৃতীয় জোন বাংলাদেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চল। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও (৫.৫ থেকে ৬ রিখটার স্কেল) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা শহর। কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশেষ করে নদী, খালবিল, পুকুর ভরাট করে হাউজিং প্রকল্পগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভূমিকম্পসহিষ্ণু কোনো ভবন তৈরি করা হয়নি। নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, প্রয়োজন অনুযায়ী মাটির গুণাগুণ যাচাই না করা এবং পর্যাপ্ত পাইলিং না করে ভবন তৈরি করা হয়। ভূকম্পন তুলনামূলকভাবে বেশি হবে রামপুরা, বেগুনবাড়ী খালের আশপাশ, পাগলা খালের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ এলাকা, আদাবর, বসুন্ধরা, শ্যামলী ও তুরাগ নদীসংলগ্ন এলাকায়। এ এলাকাগুলো তুলনামূলকভাবে নরম মাটির ওপর অবস্থিত। শক্ত মাটিতে (মধুপুর ব্লে বা লাল রঙের মাটি) এ ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় সর্বশেষ বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৮৯৭ সালের ১২ জুন, যার মাত্রা ছিল ৮.৭। কিন্তু তখন ছোট শহর ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি ছিল কম। ভূমিকম্পের উপাত্তে দেখা যায়, প্রতি ১০০ বছর অন্তর বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। যদি মধুপুর ফল্ট সক্রিয় হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ঢাকা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বরের ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে ২২ জন এবং ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে চারজন মারা যায়। বাংলাদেশে গড়ে ২৫টি ভূকম্পন হয়। বিশ্বের আশঙ্কাজনক তালিকার ২২টি নগরীর মধ্যে ঢাকা অন্যতম।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ভারত ও নেপালে ৬৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। ভূমিধসসহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে জাতীয় অনেক সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক আতঙ্ক। ভূমিকম্পবিষয়ক পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো আমাদের দেশে হয়নি। CDMP-এর প্রকল্পে ঢাকাসহ বড় কয়েকটি জেলায় সিসমিক ম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। তারা বেশ কিছু ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় করণীয় যেসব ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়েছে, প্রচারের অভাবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ জন্য গণমাধ্যমের সচেতনতা তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার পর আমাদের টনক নড়ে। টক শো, পত্রিকার নিবন্ধ_এগুলোর রেশ সপ্তাহখানেক চলে। জরুরি বিষয় হলো, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সামাজিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে উদ্দীপনামূলক প্রচারণা সারা বছর ধরে চালাতে পারে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। সম্প্রতি বেশ কিছু বিষয়ে সামাজিক সংগঠনগুলো আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এভাবে সামাজিকের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণও জরুরি হয়ে পড়েছে। রুটিন ওয়ার্কের বাইরে অ্যাকশনধর্মী ওয়ার্কে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments