শিক্ষা আন্দোলন এবং শিক্ষা সংস্কারের বুলি by শহিদুল ইসলাম

এক. ১৯৬২ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামেরই স্বর্ণোজ্জ্বল এক অধ্যায়। পাকিস্তানের 'লৌহমানব' বলে পরিচিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কড়া সামরিক শাসনের প্রচণ্ড অত্যাচার-নির্যাতনের শক্ত দেয়াল উপেক্ষা করে সেদিনের ছাত্রসমাজ দেশব্যাপী শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তার নজির ইতিহাসে মেলা ভার।


সামরিক শাসনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ছাত্ররা সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি পাবলিক প্লেস, দোকানপাট ও অফিস-আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে টাঙানো আইয়ুব খানের ছবির বহ্ন্যুৎসব করেছিল ছাত্ররা। কয়েক দিনের মধ্যে সব জায়গা থেকে আইয়ুব খানের ছবি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা। সে আন্দোলনের খুঁটিনাটি নিয়ে আজ আর আলোচনার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু কেন সেদিনের সে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছাত্র আন্দোলন? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সব সময়ই খুঁজতে হবে। প্রতিটি শাসকশ্রেণীর একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন থাকে। তারা সে দর্শন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দেয়_শিক্ষা সংস্কারের গালভরা বুলি মুখে নিয়ে। আইয়ুব খানও সেদিন ব্যতিক্রম কিছু করেননি। ক্ষমতা দখলের মাত্র ৫৪ দিন পর তিনিও সংস্কারের নামে তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন সমগ্র জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সচেতন ছাত্রসমাজ সেদিন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং আইয়ুব খানকে বাধ্য করেছিল শরীফ কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাহার করতে। একে বলা যায় ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর আইয়ুব খানের প্রথম পরাজয়। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের সে বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে। কিন্তু কেন সে আন্দোলন_এ নিয়ে তেমন কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ চোখে পড়ে না। পাকিস্তানি প্রচারণা শুধু দুই বছরের ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছরের কোর্সে পরিণত করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চেয়েছে। হ্যাঁ, সেদিনের আন্দোলনের সামনে এ প্রশ্নটিই উঠে এসেছিল, তা ঠিক; কিন্তু বিষয়টি এত ক্ষুদ্র ছিল না।
দুই. মূল আলোচনায় ঢোকার আগে একটি ভ্রান্তির কথা বলি। সম্প্রতি বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের ওপর একটি লেখা লিখতে গিয়ে কিছু বইপত্র ঘাঁটতে হয় আমাকে। অবাক বিস্ময়ে দেখি, ফখরুদ্দীন আহমদ ও খোকা রায়ের মতো মানুষও তাঁদের বইয়ে লিখেছেন যে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল হামুদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে। এমনকি ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (বিমক) যে ২০ বছরের কৌশলপত্র প্রস্তুত করেছে, সেখানেও শরীফ কমিশন ও হামুদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা লিখেছে। এ ভুলটি এখন সাধারণের মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত। সে কথা ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের লেখক মোহাম্মদ হাননান দ্বিতীয় খণ্ডের ৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত বইটি লেখার সময় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের নায়কদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাঁদেরও অনেকে আজ ভুলে গেছেন সেটা শরীফ কমিশন নাকি হামুদুর রহমান কমিশন? ক্ষমতা দখলের ৫৪ দিন পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এস এম শরীফের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন আইয়ুব খান এবং ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি কমিশন উদ্বোধন করে যে ভাষণ দেন, তার মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শনটি পরিষ্কার ফুটে ওঠে। ২৬ আগস্ট কমিশন তার অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় এবং সেটি ছাপা হয়ে বের হয় ১৯৬২ সালে। তার পরই শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। আর হামুদুর রহমান কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন ১৯৬৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর এবং সেটি মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ পায় ১৯৬৬ সালে। শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধান এবং সেটি পর্যালোচনার জন্য হামুদুর রহমান কমিশন গঠিত হয়। তাই বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন কোনোভাবেই হামুদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে হতে পারে না। আশা করি, ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে সজাগ থাকবেন।
তিন. বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিমক বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর ২০ বছরের যে কৌশলপত্র রচনা করেছে, সেখানে মাত্র তিনটি শব্দে শরীফ কমিশনের রাজনৈতিক দর্শনটি সুন্দরভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শরীফ কমিশন কেন সেদিন প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, তার কারণের কথা উল্লেখ করেছে মাত্র ওই তিনটি শব্দে। শরীফ কমিশনের রিপোর্টটি ছিল-'elitist, discriminatory and anti-poor bias.' ২০০৬ সালে বিমক সে কথা স্বীকার করে। আসলেও তা-ই। ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল এ দেশে শিক্ষাকে একটি মূল্যবান পণ্যে পরিণত করার জন্য, যা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। সে কথা উদ্বোধনী ভাষণে কমিশনকে মনে করিয়ে দেন আইয়ুব খান; এবং একটি গাইডলাইন সরবরাহ করেন। তিনি বলেন, ছাত্রদের প্রবণতা ও ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ছাত্র ভর্তি সংকুচিত করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, গরিব ছাত্ররা যেন কোনোভাবেই বাদ না পড়ে। সেই সঙ্গে তিনি কমিশনকে আহ্বান জানান যে দেশের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথাটা যেন তারা ভুলে না যায়। কমিশনও সে উপদেশ শিরোধার্য করে বলে যে শিক্ষা সম্পর্কে দেশবাসীর পুরনো ঐতিহ্যবাহী ধারণা পাল্টাতে হবে। সস্তায় শিক্ষা পাওয়া যায়_এই ভুল ধারণা তাদের দ্রুত ভুলে যেতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, ভালো শিক্ষা ব্যয়বহুল। যেহেতু শিক্ষার মূল সুযোগ ভোগ করে দেশের সাধারণ মানুষ, তাই ট্যাঙ্রে মাধ্যমে তাদের শিক্ষাব্যয়ের ৫০ শতাংশ সরকারকে দেওয়া উচিত। মানুষকে বুঝতে হবে, যেহেতু তারা এবং তাদের সন্তানরা শিক্ষা দ্বারা বেশি লাভবান হয়, সুতরাং শিক্ষার জন্য তাদের বেশি ব্যয় করতে হবে। উপসংহারে বলা হয়, ভালো শিক্ষা সস্তায় পাওয়া যায় না। কমিশন সুপারিশ করে, প্রাথমিক শিক্ষার খরচের ৫০ শতাংশ ট্যাঙ্রে মাধ্যমে জনসাধারণকে দিতে হবে। তার পরও কমিশন দুঃখ প্রকাশ করে এই বলে যে আগামী কিছুদিন সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। এই দর্শনের সঙ্গে সংগতি রেখে কমিশন তার সুপারিশমালা সাজায়। তারই একটি স্নাতক ডিগ্রি কোর্সকে দুই বছরের জায়গায় তিন বছর করা হয়। সেদিন ওই বাড়তি এক বছরের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা এ দেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ছাত্রসমাজ ও তাদের অভিভাবকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। ভয়ভীতি প্রদর্শন করেও সে বিক্ষোভ দমন করা যায়নি। বাধ্য হয়ে রিপোর্ট প্রত্যাহার করে নেন সামরিক শাসক আইয়ুব খান।
চার. আগস্টে শুরু হয়ে ছাত্র আন্দোলন বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৭ সেপ্টেম্বর প্রদেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। সরকার তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ভোর থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। সারা দেশে আগুন জ্বলে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু ছাত্র আহত হয়। যশোরে ৪৩ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়। ২৭ জন ছাত্রসহ ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সব মিলিয়ে ওই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাত্র ২৭ দিন ক্লাস হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালে অংশগ্রহণকারীদের ওপর গুলিতে নিহত হন বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ। স্বাভাবিক নিয়মে আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পায়। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টনে এক ছাত্র জনসভায় অবিলম্বে ছাত্রদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সরকার বিচারপতি ইদ্রিসের সভাপতিত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে, যার রিপোর্ট আজও সূর্যের আলো দেখেনি। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ক্রমে ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু এ কথা মিথ্যা নয় যে সে আন্দোলন কেবল শিক্ষাবিষয়ক আন্দোলন ছিল না। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক মুক্তির যে প্রগতিশীল ধারা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল, জন্ম দিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন সে ধারাকেই আরো শক্তিশালী করে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে দুর্বল রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন সে রাজনীতির সামনে একটি স্পষ্ট আদর্শ উপস্থিত করে এবং ষড়যন্ত্র, ক্যু, পাল্টা ক্যুর অতীত রাজনীতিকে একটি প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক চরিত্র দান করে। সেদিক থেকে বিচার করলে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মতো আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেকটি মাইলফলক। কড়া সামরিক শাসনের মধ্যেও যে আন্দোলন-সংগ্রাম করা যায়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন আমাদের রাজনীতিবিদদের সামনে সেই নজির উপস্থিত করে, যার পথ ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পৌঁছে যায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ ও রাজনীতির বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.