সাম্রাজ্যবাদী তামাশা ও জনগণের প্রতিরোধ by হায়দার আকবর খান রনো
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বসেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা হ্রাসের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই লেখার সময়ে সম্মেলন চলছে। এখনও পর্যন্ত কোনো ফলাফল বের হয়নি। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বের হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধরিত্রীর তাপমাত্রা হ্রাসের ব্যাপারে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের এই সম্মেলনে এখনও কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না হলেও সম্মেলন কক্ষে বেড়েছে বিতর্কের উত্তাপ। ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে বেড়েছে শীতলতা।
আর সম্মেলনস্থল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে সম্মেলনের এক সপ্তাহের মধ্যে বাইরের তাপমাত্রা কমেছে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে শূন্যের নিচে। তবে সম্মেলন কক্ষের বাইরের রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্মেলন কক্ষে রয়েছেন ১৩২টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, রয়েছেন অতগুলো দেশের ১৯২ জন প্রতিনিধি। উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। সম্মেলনের শেষ দিন যোগ দেবেন নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এক ব্যতিক্রমী পুরুষ, যিনি শান্তির জন্য কিছু না করেই সর্বোচ্চ শান্তি পুরস্কারটি পেয়েছেন। পুরস্কারদাতারা জানিয়েছেন, তিনি ভবিষ্যতে শান্তির জন্য অবদান রাখতে পারবেন বলে তাদের মনে হয়েছে। অনেকটা গণকের মতো। তিনিই প্রথম কালো মানুষ যিনি ওয়াশিংটনের সাদা ভবনে স্থান করে নিতে পেরেছেন। তিনি এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবেন এমন ভাবছেন অনেকে। কিন্তু তার প্রশাসনের পক্ষ থেকে যারা কূটনৈতিক তত্পরতায় ব্যস্ত রয়েছেন তারা এ পর্যন্ত সম্মেলনের সাফল্যের লক্ষে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। সম্মেলনের একই মঞ্চে বসেছেন ধনী-দরিদ্র দেশের প্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল টেলিভিশনে তার বক্তৃতার কিয়দাংশ শুনলাম। আজকের পত্রিকায় বক্তৃতার মূল কথাগুলো জানা গেল। ভালো কথা। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশের কথার কোনো দাম নেই, যদি না আমরা অন্যান্য গরিব দেশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারি। না, অতটা আশা করা যায় না এই সরকারের কাছ থেকে। তবে আফ্রিকার প্রতিনিধিরা দলবদ্ধভাবে চাপ সৃষ্টি করেছেন। তাদের দাবি উন্নত ধনী দেশ যে পরিবেশগত সর্বনাশ করতে চলেছে তা বন্ধ করো এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাও। ধনী দেশের নেতারা তা শুনতে বা মানতে রাজি নন। ধনী দরিদ্রের দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত পর্যায়ে রয়েছে। এই শীতল সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সম্মেলন কক্ষে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। আফ্রিকান প্রতিনিধিরা দু’বার ওয়াকআউট করেছেন। সম্মেলনের কাজেও বেশ বিশৃঙ্খলা। সম্মেলনের সভাপতি স্বাগতিক দেশ ডেনমার্কের মন্ত্রী আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করলেন। এরপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্বের দায়িত্ব নিলেন।
সম্মেলন কক্ষের উষ্ণ শীতল আবহাওয়ায় সবাই সন্দিহান ফলাফল নিয়ে। ঠিক একই সময়ে বাইরে চলছে তীব্র শীতের মধ্যে উত্তপ্ত আন্দোলন। ডেনমার্কের মতো ইউরোপীয় উন্নত দেশে, যেখানে সবকিছু সুশৃঙ্খল ও গোছানো, সেখানে চলছে তৃতীয় বিশ্বের দেশের মতোই রাস্তার জঙ্গি আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ, মিছিল, ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং তা মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না। জোর করে সম্মেলনের জায়গায় প্রবেশ প্রচেষ্টা, আইন অমান্য করে প্ল্যাকার্ড লাগানো ইত্যাদি। পুলিশও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ছে, গ্রেফতার করছে দলে দলে। এমন দৃশ্য ঢাকায় কিংবা কলকাতায় কিংবা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের সাধারণ চিত্র হলেও উন্নত পাশ্চাত্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খুব একটা দেখা যায়নি। অবশ্য ১৯৯৯ সালে আমেরিকার সিয়াটোলে প্রথম দেখলাম, তৃতীয় বিশ্বের মতোই গণবিক্ষোভ। আমেরিকার পুলিশ নেমেছিল একই ধরনের হিংস্র ভূমিকায়। তার পর কয়েক বছর ধরেই দেখে আসছি আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত দেশের ধনী শহরগুলোয় হাজার হাজার মানুষের জঙ্গি বিক্ষোভ। যেখানেই জি-আট, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিওর নেতা ও প্রতিনিধিরা মিলিত হচ্ছেন, সেখানেই গণপ্রতিরোধের এমন সাধারণ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামের এ এক নতুন ফর্মা। ইতালিতে এমনি এক বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে তথাকথিত সুসভ্য ইউরোপীয় দেশের পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল ২৩ বছরের যুবক কার্লো গিউলিয়ানিকে। বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামে প্রথম শহীদ।
কোপেনহেগেনে বিক্ষোভের ধরনটি প্রায় একই রকম। সম্মেলন কক্ষের অবস্থাটি সিয়াটোলের মতোই। সিয়াটোলে ছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ে সম্মেলন, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। উন্নত এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে টানাপড়েন এবং খানিকটা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণেও বটে অর্থাত্ ইউরোপ-আমেরিকার বিরোধাত্মক অবস্থানের কারণে। একই সঙ্গে বাইরের জঙ্গি সমাবেশ প্রভাব ফেলেছিল বৈকি। পরিবেশ নিয়ে আজকের এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ভেতরে ও বাইরে যে ক্ষোভ-আন্দোলন চলছে, সেটা নিছক পরিবেশের সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটাও বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামেরই অংশ।
জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলন থেকে যে বিশেষ কোনো ফল বের হয়ে আসবে না, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। তাই কিউবার প্রেসিডেন্ট রাহুল ক্যাস্ট্রো সেখানে যাননি এবং কিছু যে হবে না, তা আগেই তিনি উল্লেখ করেছিলেন। কারণ এখানেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক করপোরেশনের খেলা। পরিবেশ নিয়ে খেলা। মানবজাতির অস্তিত্ব নিয়ে খেলা। ভয়ঙ্কর, মারাত্মক খেলা। জাতিসংঘের নামে বিপুল অংকের টাকা খরচ করে লোক দেখানো পরিবেশ সম্মেলন। নিজেদের মুনাফার লালসার তাগিদে পরিবেশ ধ্বংস করতে এতটুকু যাদের বাধে না, তাদেরই উদ্যোগে এমন সম্মেলন অর্থবহ কিছুই করতে পারে না। কোপেনহেগেনে সেটা আরেকবার দেখা গেল।
পরিবেশের সমস্যাটি সাধারণ অর্থে কোনো রাজনৈতিক বিষয় হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, শ্রেণী ইত্যাদি বিষয়কে টানা হলে দুই দশক আগেও পণ্ডিতবর্গ কমিউনিস্টদের বাড়াবাড়ি বলে নিন্দা করতেন। সত্যিই তো, পরিবেশ দূষিত হলে তো গরিব-বড়লোক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে পরিবেশের প্রসঙ্গটি শ্রেণী প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এবং রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিবেশ প্রসঙ্গে রাজনীতিকরণের জন্য দায়ী কমিউনিস্টরা নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের রাষ্ট্রনায়করা এবং করপোরেট পুঁজির মালিকরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাতাসের দূষণ কমাতে হবে, কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে হবে। তারা নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই তা বলে থাকেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের কথা শুনতে রাজি নন পুঁজির মালিক এবং তাদেরই স্বার্থের পাহারাদার সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রনায়করা। কারণ তাদের কাছে মানবজাতির স্বার্থের চেয়ে বড় হলো মুনাফা। মুনাফায় টান পড়লে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বুর্জোয়ার এটাই সাধারণ ধর্ম। আর অন্যদিকে অধিক হারে মুনাফার সুযোগ থাকলে, হেন অপরাধ নেই যা তারা করতে পারে না।
১৯৯৫ সালে প্রথম জাতিসংঘের Intergovernmental Panel on Climate Change স্বীকার করেছিল যে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি (গ্রিনহাউস এফেক্ট), ওজন স্তরে ফাটল, পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ঘটনার জন্য মনুষ্য ক্রিয়াকর্ম দায়ী। অর্থাত্ তা আপনা থেকে হচ্ছে না। মানুষ যে পরিমাণে বাতাসে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করছে, সেই পরিমাণে বায়ুমণ্ডল দূষিত হচ্ছে এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। তা ছাড়া আরও কিছু গ্যাস নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তরে যে ওজন (তিনটি অক্সিজেন এটম নিয়ে একটা ওজনের মলিক্যুল) গ্যাসের স্তর আছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ ওজন গ্যাস পৃথিবীকে ছাতার মতো রক্ষা করছে মহাকাশের বহু মারাত্মক রশ্মি ও কণা থেকে। অন্যথায় পৃথিবীতে প্রাণীর অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ত। তাহলে এসব গ্যাসের ব্যবহার কমানো দরকার। গাড়ি, রিফ্রিজারেটর, ফ্রিজ আরও কিছু আছে, যা এরকম গ্যাস বাতাসে ছড়াচ্ছে। কিন্তু একদিকে এমন আরামদায়ক জীবনে অভ্যস্ত যে পাশ্চাত্যের মানুষ, তারা এসব জিনিসের ব্যবহার বাদ দেবে না। অন্যদিকে এসব দ্রব্য উত্পাদনকারী পুঁজিপতিরাও উত্পাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে রাজি নন। কারণ পুঁতিপতিরা নাকের ডগার বাইরে কিছু দেখতে পায় না। বর্তমানের মুনাফার তাগিদ এত বেশি যে, তারা ভবিষ্যত্ দেখতে পায় না। পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ তাই শুধু শোষকই নয়, তারা গোটা মানবজাতির শত্রু। পরিবেশ ধ্বংস করে মানবজাতির ভবিষ্যেক ধ্বংস করছে, বিপন্ন করছে প্রাণীকূলকে। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল। প্রাণের সমারোহে ভরপুর হয়েছিল এই গ্রহটি।
সভ্যতার বিকাশ ও বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক শিল্পের বিকাশের পর্যায়ে মানুষ পরিবেশের ওপর হাত দিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতেই কার্ল মার্কস এটা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে পুঁজিপতিরা মুনাফার লালসায় বনাঞ্চল ধ্বংস করে কাঠ বিক্রি করছে এবং এইভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। তিনি যথার্থভাবেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন মুনাফাখোর বুর্জোয়া শ্রেণীকে। এখন তাদের অপরাধ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিকরা যখন বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন, তখনও বাতাসকে কার্বনডাই-অক্সাইড দ্বারা দূষিত করা মানবতাবিরোধী অপরাধ। বর্তমানের মুনাফার জন্য ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে হত্যা করা হচ্ছে।
১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকে প্রথম পরিবেশবাদী আন্দোলন শুরু হয়। যারা শুরু করেছিলেন তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে মার্কসবাদী বা পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন না। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশ নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। তিনি বই লিখলেন— "Earth in the Balance-Ecology and the Human Spirit"। বইটি বিভিন্ন মহলে সমাদৃত হয়েছিল। তিনিই প্রস্তাব করেছিলেন "... it would be wise to establish a tradition of annual environmental Summit meetings, similar to the annual economic summits of today. (১৯৯২ সাল)। জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিবেশসংক্রান্ত প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় ১৯৯২ সালে রিয়ো ডি জেনেরোতে। এসব সম্মেলনে এ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পৃথিবীতে যত কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে তার এক-চতুর্থাংশের জন্যই দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, যার জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি হবে না। আর এর সঙ্গে যদি প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যুক্ত করি তাহলে দেখা যাবে নিঃসরিত কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাসের দুই-তৃতীয়াংশের জন্য এরাই দায়ী। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা যাদের আছে তাদের কাজের জন্য বাতাসে ছড়াচ্ছে মাত্র দুই-শতাংশ গ্যাস। তাহলে ধনী দেশগুলোকে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। তাতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনী দেশ।
১৯৯৭ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য একটা টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল, যাকে বলা হয় কিয়োটো প্রোটোকল। বলা হয়েছিল, বাতাসে এই গ্যাসের পরিমাণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ৫.২ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১২ সাল। সেই সময় প্রায় এসে গেছে। টার্গেট অর্জিত হয়নি। বরং বাতাসে ওই রকম গ্যাসের হার বেড়েছে। বেড়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দক্ষিণ মেরুর বরফ গলছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদি বিপর্যয় বাড়বে। তাই সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব যেমন হুমকির মুখে, তেমনি এখনই বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের মতো বেশকিছু দেশ।
স্বাভাবিকভাবে দাবি উঠেছে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাও। ধনী দেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করো। তা ছাড়াও দাবি উঠেছে এহেন ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জনগণের জন্য উন্নত দেশে অভিবাসনের ব্যবস্থা করো। এটাকে মানবাধিকার বলেই দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু ধনী দেশগুলো এসব দাবিতে কর্ণপাত করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এর আগের কিয়োটো সম্মেলনের সিদ্ধান্তও মানেনি। সরাসরি অস্বীকার করেছে। এ বারও শান্তির জন্য অগ্রিম নোবেল পুরস্কার পাওয়া কালো প্রেসিডেন্ট ওবামা, একচেটিয়া করপোরেট পুঁজির স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে মানবজাতির কল্যাণে পরিবেশ দূষণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেবেন বলে জানা যায়নি।
তাহলে আমাদের সামনে বড় ভয়ঙ্কর সময় উপস্থিত হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় মানে মানবজাতির বিপর্যয়। কিন্তু ধনীরা তাদের বিলাস ত্যাগ করতে রাজি নন। বহুজাতিক পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফার প্রয়োজনে মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছে বড় রকমের অস্তিত্ব সঙ্কটের দিকে। তাই মানবজাতিকে রক্ষা করতে হলে আজ পৃথিবী থেকে পুঁজিবাদকেই উচ্ছেদ করতে হবে।
কিউবার বিপ্লবের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রো একবার বলেছিলেন, ‘বিশ্বায়ন আজ বাস্তব সত্য, যেখানে আমরা সবাই চড়ে বসেছি একই জাহাজে; অর্থাত্ পৃথিবী নামক গ্রহটিতে। কিন্তু জাহাজের যাত্রীদের একেক জনের একেক দশা।’ তার পর তিনি বললেন, ‘জাহাজটি এমন এক অযৌক্তিক, কাণ্ডজ্ঞানহীন পথ নিয়েছে যে, এ জাহাজ কোনোদিনই কোনো নিরাপদ বন্দরে ভিড়তে পারবে না। মনে হচ্ছে, এ জাহাজের নিয়তি কোনো হিমশৈলে ধাক্কা খাওয়া। তা যদি হয়, তবে এর সঙ্গে আমরা সবাই ডুববো—কেউ বাদ যাবে না।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ আজ পৃথিবীকে চালাচ্ছে। পরিবেশ দূষিত তারাই করছে। কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো যে কাজ করছে তার প্রমাণ তো কোপেনহেগেন সম্মেলন। এদের অপরাধের জন্য গোটা মানবজাতিই ডুবতে বসেছে। তারা নিজেরাও, তাদের সন্তানরাও, তাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মও বাদ যাবে না। মুনাফার মদে বেহুঁশ পুঁজিপতির দল এবং শক্তিমদে কাণ্ডজ্ঞানহারা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা সবশুদ্ধ ডুবাতে বসেছে। তাই তো কোপেনহেগেনের সম্মেলনের বাইরে সমবেত সাধারণ মানুষের এত উদ্বেগ, এত ক্ষোভ, এত উত্তেজনা।
পরিবেশ রক্ষার্থে, সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে হবে এবং মানবজাতিকে বাঁচাতে হবে। আজ বাংলাদেশের মানুষকেও বিশ্বজনতার কাফেলায় শরিক হতে হবে। সরকার হয়তো মিন-মিন করে কথা বলবে, কারণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস তাদের নেই। কিন্তু সাহসী জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। পরিবেশ বাঁচানোর বিশ্বব্যাপী আন্দোলন, যা আসলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, তাতে ঘনিষ্ঠভাবে শরিক হতে হবে।
সম্মেলন কক্ষে রয়েছেন ১৩২টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, রয়েছেন অতগুলো দেশের ১৯২ জন প্রতিনিধি। উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। সম্মেলনের শেষ দিন যোগ দেবেন নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এক ব্যতিক্রমী পুরুষ, যিনি শান্তির জন্য কিছু না করেই সর্বোচ্চ শান্তি পুরস্কারটি পেয়েছেন। পুরস্কারদাতারা জানিয়েছেন, তিনি ভবিষ্যতে শান্তির জন্য অবদান রাখতে পারবেন বলে তাদের মনে হয়েছে। অনেকটা গণকের মতো। তিনিই প্রথম কালো মানুষ যিনি ওয়াশিংটনের সাদা ভবনে স্থান করে নিতে পেরেছেন। তিনি এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবেন এমন ভাবছেন অনেকে। কিন্তু তার প্রশাসনের পক্ষ থেকে যারা কূটনৈতিক তত্পরতায় ব্যস্ত রয়েছেন তারা এ পর্যন্ত সম্মেলনের সাফল্যের লক্ষে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। সম্মেলনের একই মঞ্চে বসেছেন ধনী-দরিদ্র দেশের প্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল টেলিভিশনে তার বক্তৃতার কিয়দাংশ শুনলাম। আজকের পত্রিকায় বক্তৃতার মূল কথাগুলো জানা গেল। ভালো কথা। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশের কথার কোনো দাম নেই, যদি না আমরা অন্যান্য গরিব দেশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারি। না, অতটা আশা করা যায় না এই সরকারের কাছ থেকে। তবে আফ্রিকার প্রতিনিধিরা দলবদ্ধভাবে চাপ সৃষ্টি করেছেন। তাদের দাবি উন্নত ধনী দেশ যে পরিবেশগত সর্বনাশ করতে চলেছে তা বন্ধ করো এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাও। ধনী দেশের নেতারা তা শুনতে বা মানতে রাজি নন। ধনী দরিদ্রের দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত পর্যায়ে রয়েছে। এই শীতল সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সম্মেলন কক্ষে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। আফ্রিকান প্রতিনিধিরা দু’বার ওয়াকআউট করেছেন। সম্মেলনের কাজেও বেশ বিশৃঙ্খলা। সম্মেলনের সভাপতি স্বাগতিক দেশ ডেনমার্কের মন্ত্রী আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করলেন। এরপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্বের দায়িত্ব নিলেন।
সম্মেলন কক্ষের উষ্ণ শীতল আবহাওয়ায় সবাই সন্দিহান ফলাফল নিয়ে। ঠিক একই সময়ে বাইরে চলছে তীব্র শীতের মধ্যে উত্তপ্ত আন্দোলন। ডেনমার্কের মতো ইউরোপীয় উন্নত দেশে, যেখানে সবকিছু সুশৃঙ্খল ও গোছানো, সেখানে চলছে তৃতীয় বিশ্বের দেশের মতোই রাস্তার জঙ্গি আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ, মিছিল, ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং তা মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না। জোর করে সম্মেলনের জায়গায় প্রবেশ প্রচেষ্টা, আইন অমান্য করে প্ল্যাকার্ড লাগানো ইত্যাদি। পুলিশও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ছে, গ্রেফতার করছে দলে দলে। এমন দৃশ্য ঢাকায় কিংবা কলকাতায় কিংবা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের সাধারণ চিত্র হলেও উন্নত পাশ্চাত্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খুব একটা দেখা যায়নি। অবশ্য ১৯৯৯ সালে আমেরিকার সিয়াটোলে প্রথম দেখলাম, তৃতীয় বিশ্বের মতোই গণবিক্ষোভ। আমেরিকার পুলিশ নেমেছিল একই ধরনের হিংস্র ভূমিকায়। তার পর কয়েক বছর ধরেই দেখে আসছি আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত দেশের ধনী শহরগুলোয় হাজার হাজার মানুষের জঙ্গি বিক্ষোভ। যেখানেই জি-আট, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিওর নেতা ও প্রতিনিধিরা মিলিত হচ্ছেন, সেখানেই গণপ্রতিরোধের এমন সাধারণ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামের এ এক নতুন ফর্মা। ইতালিতে এমনি এক বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে তথাকথিত সুসভ্য ইউরোপীয় দেশের পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল ২৩ বছরের যুবক কার্লো গিউলিয়ানিকে। বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামে প্রথম শহীদ।
কোপেনহেগেনে বিক্ষোভের ধরনটি প্রায় একই রকম। সম্মেলন কক্ষের অবস্থাটি সিয়াটোলের মতোই। সিয়াটোলে ছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ে সম্মেলন, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। উন্নত এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে টানাপড়েন এবং খানিকটা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণেও বটে অর্থাত্ ইউরোপ-আমেরিকার বিরোধাত্মক অবস্থানের কারণে। একই সঙ্গে বাইরের জঙ্গি সমাবেশ প্রভাব ফেলেছিল বৈকি। পরিবেশ নিয়ে আজকের এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ভেতরে ও বাইরে যে ক্ষোভ-আন্দোলন চলছে, সেটা নিছক পরিবেশের সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটাও বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামেরই অংশ।
জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলন থেকে যে বিশেষ কোনো ফল বের হয়ে আসবে না, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। তাই কিউবার প্রেসিডেন্ট রাহুল ক্যাস্ট্রো সেখানে যাননি এবং কিছু যে হবে না, তা আগেই তিনি উল্লেখ করেছিলেন। কারণ এখানেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক করপোরেশনের খেলা। পরিবেশ নিয়ে খেলা। মানবজাতির অস্তিত্ব নিয়ে খেলা। ভয়ঙ্কর, মারাত্মক খেলা। জাতিসংঘের নামে বিপুল অংকের টাকা খরচ করে লোক দেখানো পরিবেশ সম্মেলন। নিজেদের মুনাফার লালসার তাগিদে পরিবেশ ধ্বংস করতে এতটুকু যাদের বাধে না, তাদেরই উদ্যোগে এমন সম্মেলন অর্থবহ কিছুই করতে পারে না। কোপেনহেগেনে সেটা আরেকবার দেখা গেল।
পরিবেশের সমস্যাটি সাধারণ অর্থে কোনো রাজনৈতিক বিষয় হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, শ্রেণী ইত্যাদি বিষয়কে টানা হলে দুই দশক আগেও পণ্ডিতবর্গ কমিউনিস্টদের বাড়াবাড়ি বলে নিন্দা করতেন। সত্যিই তো, পরিবেশ দূষিত হলে তো গরিব-বড়লোক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাহলে পরিবেশের প্রসঙ্গটি শ্রেণী প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এবং রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিবেশ প্রসঙ্গে রাজনীতিকরণের জন্য দায়ী কমিউনিস্টরা নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের রাষ্ট্রনায়করা এবং করপোরেট পুঁজির মালিকরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাতাসের দূষণ কমাতে হবে, কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে হবে। তারা নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই তা বলে থাকেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের কথা শুনতে রাজি নন পুঁজির মালিক এবং তাদেরই স্বার্থের পাহারাদার সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রনায়করা। কারণ তাদের কাছে মানবজাতির স্বার্থের চেয়ে বড় হলো মুনাফা। মুনাফায় টান পড়লে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বুর্জোয়ার এটাই সাধারণ ধর্ম। আর অন্যদিকে অধিক হারে মুনাফার সুযোগ থাকলে, হেন অপরাধ নেই যা তারা করতে পারে না।
১৯৯৫ সালে প্রথম জাতিসংঘের Intergovernmental Panel on Climate Change স্বীকার করেছিল যে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি (গ্রিনহাউস এফেক্ট), ওজন স্তরে ফাটল, পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ঘটনার জন্য মনুষ্য ক্রিয়াকর্ম দায়ী। অর্থাত্ তা আপনা থেকে হচ্ছে না। মানুষ যে পরিমাণে বাতাসে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করছে, সেই পরিমাণে বায়ুমণ্ডল দূষিত হচ্ছে এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। তা ছাড়া আরও কিছু গ্যাস নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তরে যে ওজন (তিনটি অক্সিজেন এটম নিয়ে একটা ওজনের মলিক্যুল) গ্যাসের স্তর আছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ ওজন গ্যাস পৃথিবীকে ছাতার মতো রক্ষা করছে মহাকাশের বহু মারাত্মক রশ্মি ও কণা থেকে। অন্যথায় পৃথিবীতে প্রাণীর অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ত। তাহলে এসব গ্যাসের ব্যবহার কমানো দরকার। গাড়ি, রিফ্রিজারেটর, ফ্রিজ আরও কিছু আছে, যা এরকম গ্যাস বাতাসে ছড়াচ্ছে। কিন্তু একদিকে এমন আরামদায়ক জীবনে অভ্যস্ত যে পাশ্চাত্যের মানুষ, তারা এসব জিনিসের ব্যবহার বাদ দেবে না। অন্যদিকে এসব দ্রব্য উত্পাদনকারী পুঁজিপতিরাও উত্পাদন ও বিক্রি বন্ধ করতে রাজি নন। কারণ পুঁতিপতিরা নাকের ডগার বাইরে কিছু দেখতে পায় না। বর্তমানের মুনাফার তাগিদ এত বেশি যে, তারা ভবিষ্যত্ দেখতে পায় না। পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ তাই শুধু শোষকই নয়, তারা গোটা মানবজাতির শত্রু। পরিবেশ ধ্বংস করে মানবজাতির ভবিষ্যেক ধ্বংস করছে, বিপন্ন করছে প্রাণীকূলকে। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল। প্রাণের সমারোহে ভরপুর হয়েছিল এই গ্রহটি।
সভ্যতার বিকাশ ও বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক শিল্পের বিকাশের পর্যায়ে মানুষ পরিবেশের ওপর হাত দিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতেই কার্ল মার্কস এটা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে পুঁজিপতিরা মুনাফার লালসায় বনাঞ্চল ধ্বংস করে কাঠ বিক্রি করছে এবং এইভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। তিনি যথার্থভাবেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন মুনাফাখোর বুর্জোয়া শ্রেণীকে। এখন তাদের অপরাধ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিকরা যখন বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন, তখনও বাতাসকে কার্বনডাই-অক্সাইড দ্বারা দূষিত করা মানবতাবিরোধী অপরাধ। বর্তমানের মুনাফার জন্য ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে হত্যা করা হচ্ছে।
১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকে প্রথম পরিবেশবাদী আন্দোলন শুরু হয়। যারা শুরু করেছিলেন তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে মার্কসবাদী বা পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন না। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশ নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। তিনি বই লিখলেন— "Earth in the Balance-Ecology and the Human Spirit"। বইটি বিভিন্ন মহলে সমাদৃত হয়েছিল। তিনিই প্রস্তাব করেছিলেন "... it would be wise to establish a tradition of annual environmental Summit meetings, similar to the annual economic summits of today. (১৯৯২ সাল)। জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিবেশসংক্রান্ত প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় ১৯৯২ সালে রিয়ো ডি জেনেরোতে। এসব সম্মেলনে এ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পৃথিবীতে যত কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে তার এক-চতুর্থাংশের জন্যই দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, যার জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি হবে না। আর এর সঙ্গে যদি প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যুক্ত করি তাহলে দেখা যাবে নিঃসরিত কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাসের দুই-তৃতীয়াংশের জন্য এরাই দায়ী। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব এক-পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা যাদের আছে তাদের কাজের জন্য বাতাসে ছড়াচ্ছে মাত্র দুই-শতাংশ গ্যাস। তাহলে ধনী দেশগুলোকে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। তাতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনী দেশ।
১৯৯৭ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য একটা টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল, যাকে বলা হয় কিয়োটো প্রোটোকল। বলা হয়েছিল, বাতাসে এই গ্যাসের পরিমাণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ৫.২ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১২ সাল। সেই সময় প্রায় এসে গেছে। টার্গেট অর্জিত হয়নি। বরং বাতাসে ওই রকম গ্যাসের হার বেড়েছে। বেড়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দক্ষিণ মেরুর বরফ গলছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদি বিপর্যয় বাড়বে। তাই সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব যেমন হুমকির মুখে, তেমনি এখনই বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের মতো বেশকিছু দেশ।
স্বাভাবিকভাবে দাবি উঠেছে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাও। ধনী দেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করো। তা ছাড়াও দাবি উঠেছে এহেন ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জনগণের জন্য উন্নত দেশে অভিবাসনের ব্যবস্থা করো। এটাকে মানবাধিকার বলেই দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু ধনী দেশগুলো এসব দাবিতে কর্ণপাত করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এর আগের কিয়োটো সম্মেলনের সিদ্ধান্তও মানেনি। সরাসরি অস্বীকার করেছে। এ বারও শান্তির জন্য অগ্রিম নোবেল পুরস্কার পাওয়া কালো প্রেসিডেন্ট ওবামা, একচেটিয়া করপোরেট পুঁজির স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে মানবজাতির কল্যাণে পরিবেশ দূষণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেবেন বলে জানা যায়নি।
তাহলে আমাদের সামনে বড় ভয়ঙ্কর সময় উপস্থিত হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় মানে মানবজাতির বিপর্যয়। কিন্তু ধনীরা তাদের বিলাস ত্যাগ করতে রাজি নন। বহুজাতিক পুঁজিপতিরা তাদের মুনাফার প্রয়োজনে মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছে বড় রকমের অস্তিত্ব সঙ্কটের দিকে। তাই মানবজাতিকে রক্ষা করতে হলে আজ পৃথিবী থেকে পুঁজিবাদকেই উচ্ছেদ করতে হবে।
কিউবার বিপ্লবের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রো একবার বলেছিলেন, ‘বিশ্বায়ন আজ বাস্তব সত্য, যেখানে আমরা সবাই চড়ে বসেছি একই জাহাজে; অর্থাত্ পৃথিবী নামক গ্রহটিতে। কিন্তু জাহাজের যাত্রীদের একেক জনের একেক দশা।’ তার পর তিনি বললেন, ‘জাহাজটি এমন এক অযৌক্তিক, কাণ্ডজ্ঞানহীন পথ নিয়েছে যে, এ জাহাজ কোনোদিনই কোনো নিরাপদ বন্দরে ভিড়তে পারবে না। মনে হচ্ছে, এ জাহাজের নিয়তি কোনো হিমশৈলে ধাক্কা খাওয়া। তা যদি হয়, তবে এর সঙ্গে আমরা সবাই ডুববো—কেউ বাদ যাবে না।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ আজ পৃথিবীকে চালাচ্ছে। পরিবেশ দূষিত তারাই করছে। কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো যে কাজ করছে তার প্রমাণ তো কোপেনহেগেন সম্মেলন। এদের অপরাধের জন্য গোটা মানবজাতিই ডুবতে বসেছে। তারা নিজেরাও, তাদের সন্তানরাও, তাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মও বাদ যাবে না। মুনাফার মদে বেহুঁশ পুঁজিপতির দল এবং শক্তিমদে কাণ্ডজ্ঞানহারা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা সবশুদ্ধ ডুবাতে বসেছে। তাই তো কোপেনহেগেনের সম্মেলনের বাইরে সমবেত সাধারণ মানুষের এত উদ্বেগ, এত ক্ষোভ, এত উত্তেজনা।
পরিবেশ রক্ষার্থে, সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে হবে এবং মানবজাতিকে বাঁচাতে হবে। আজ বাংলাদেশের মানুষকেও বিশ্বজনতার কাফেলায় শরিক হতে হবে। সরকার হয়তো মিন-মিন করে কথা বলবে, কারণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস তাদের নেই। কিন্তু সাহসী জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। পরিবেশ বাঁচানোর বিশ্বব্যাপী আন্দোলন, যা আসলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, তাতে ঘনিষ্ঠভাবে শরিক হতে হবে।
No comments