শেকড়ের ডাক-জেনেশুনে বিষপান- আর কতকাল? by ফরহাদ মাহমুদ
সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশের মানুষের রক্তে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৫০ গুণ পর্যন্ত বেশি বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। এর কারণ মূলত ভেজাল বা দূষিত খাবার ও পানীয় গ্রহণ এবং মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশদূষণ। মাছে বা দুধে ফরমালিন, কলা পাকাতে কার্বাইড, মুড়ি ভাজতে ইউরিয়া, শাকসবজির পোকামাকড় বা পচন রোধে সরাসরি বিষ প্রয়োগ ও বিষের কার্যকারিতা শেষ হওয়ার আগেই বাজারে এনে বিক্রি করা, হাঁস-মুরগির খাবারে বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্যের ব্যবহার,
নদী-জলাশয়ে যথেচ্ছ বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য ফেলা এবং মাছ বা জলজ উদ্ভিদের মাধ্যমে সেগুলো আবার মানবদেহে আসা, মিষ্টি বা অন্যান্য রঙিন খাবারে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী শিল্পে ব্যবহৃত রঙের ব্যবহার, দূষিত পরিবেশে খাবার তৈরি এবং নিরাপদ উপাদান ব্যবহার না করা ইত্যাদি কতভাবেই না বিষের ব্যবহার ক্রমে বেড়ে চলেছে। খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে এসব বিষ গিয়ে জমা হচ্ছে মানুষের শরীরে। নষ্ট করে দিচ্ছে লিভার-কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বাড়ছে ক্যান্সার ও হৃদরোগের প্রকোপ। গর্ভবতী মায়েরা এসব বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জন্ম দিচ্ছে প্রতিবন্ধী বা বিকলাঙ্গ শিশু। শুধু কি তা-ই! জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষ যে ওষুধ সেবন করে তা-ও আজ ভেজাল বা বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। আপনারা অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন ২০০৯ সালের সেই বিয়োগান্ত ঘটনার কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রিড ফার্মাসহ তিনটি ওষুধ কম্পানির বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ বাজারজাত করার অভিযোগ উঠেছিল। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সেসব সিরাপ পান করে ২৭টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। বিদেশি দামি দামি কসমেটিকস তৈরি হয় আমাদের গলি-ঘুপচির কারখানায়। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এমন কিছু কারখানা ধরাও পড়ে। এসব কসমেটিকস ব্যবহারের ফলে স্কিন ক্যান্সারসহ নানা রকম শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বায়ুদূষণ, মাটিদূষণও আমাদের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, কেবল ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। রোগাক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারায় তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি মানুষ। এভাবে আর কত দিন চলবে?
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স এবং সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মানবদেহে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি বিষাক্ত পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর চেয়ে ভয়ংকর খবর আর কী হতে পারে! অথচ তা নিয়ে আমাদের কারো কোনো উদ্বেগ নেই, কোনো মাথাব্যথা নেই। না রাষ্ট্রের, না ব্যক্তির। শরীরে এ ধরনের বিষের উপস্থিতি ক্যান্সার সৃষ্টি, লিভার ও কিডনি অকেজো করাসহ নানা ধরনের রোগব্যাধির জন্ম দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন তথ্যে বাংলাদেশে এসব রোগব্যাধির ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানুষের শরীরে প্রতি গ্রাম রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ সহনীয় হলেও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্তে ৯.৭ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ পাওয়া গেছে। আবর্জনা অথবা ভারী ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজ করে এমন শিশুদের কারো কারো শরীরে ১৩.৬ মাইক্রোগ্রাম (৬৮ গুণ) পর্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজারে এখন এমন খাদ্যদ্রব্য পাওয়াই কঠিন, যাতে কোনো না কোনো ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নেই। ফরমালিন, কার্বাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার যেন একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ফসলি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে যেখানে কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল তিন কোটি ৮৫ লাখ টাকার, সেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে কীটনাশক আমদানি করা হয়েছে ১৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। আর আমদানির চেয়েও বেশি পরিমাণ কীটনাশক দেশে প্রবেশ করে অবৈধভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে। আমাদের কৃষকদের কোন ফসলের কতটুকু জমিতে কতটুকু কীটনাশক এবং কী ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে, সেই জ্ঞান নেই বললেই চলে। ফলে তারা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করে। অতিরিক্ত কীটনাশক খাদ্যবাহিত হয়ে মানব শরীরে আসে। প্রতিটি কীটনাশকেরই সক্রিয় আয়ুষ্কাল আছে। জ্ঞান না থাকায় যেখানে স্বল্প আয়ুষ্কালের কীটনাশক ব্যবহার করলে চলে, সেখানে দীর্ঘ আয়ুষ্কালের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহারের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেসব শাকসবজি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। অথচ দেখা যায়, তরিতরকারিতে কীটনাশক ব্যবহারের পরদিনই সেগুলো তারা বাজারে নিয়ে আসে। সেই তরিতরকারি খেলে শরীরেও বিষক্রিয়া হয়। অনেক কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী বা জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও পানির মাধ্যমে সেগুলো মানব শরীরে প্রবেশ করে। ভারী ধাতব কারখানায় কাজ করার সময় যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নেওয়া হয় না। ফলে সেসব কারখানায় কর্মরত শিশুরা সহজেই অধিক পরিমাণে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। একটি স্বাধীন-সভ্য দেশে এই নৈরাজ্য আর কত দিন চলবে?
পৃথিবীর সভ্য বা উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করার কিছু নিয়ম-কানুন আছে এবং সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয়। আমাদের দেশে নিয়ম থাকলেও তা মেনে চলার বা মানতে বাধ্য করার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য সংরক্ষণে কোনো রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করার আগে সংশ্লিষ্ট কম্পানিকে উপাদানের বৈজ্ঞানিক তথ্যাদিসহ নমুনা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএর কাছে জমা দিতে হয়। এফডিএর গবেষকরা মানবদেহ ও পরিবেশের ওপর তার প্রভাব যাচাই করেন এবং সন্তুষ্ট হলেই কেবল কম্পানিটিকে তা ব্যবহারের অনুমতি দেন। ফরমালিনের ব্যবহার উন্নত বিশ্বের সব দেশেই নিষিদ্ধ। ১৯০৬ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তার ১০০ বছর পরও বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ ফরমালিনযুক্ত মাছ খেলে কিডনির রোগ, রক্তের ক্যান্সার, জন্মত্রুটি (টেরাটোজেনিক ইফেক্টস), ক্যান্সার এবং মহিলাদের ঋতুস্রাবের সমস্যা ও বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।
আর শুধু ফরমালিনের সমস্যাই বা বলি কেন? পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য নির্ধারিত লেগুনগুলোতে অবৈধভাবে চাষ এবং সেই মাছ বিক্রি করার কথা কি আমাদের অজানা! ওয়াসার সিবিএ নেতাদের যোগসাজশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লেগুনগুলোতে অবৈধভাবে মাছের চাষ করত এবং সেসব মাছ ঢাকার বাজারে বিক্রি করত। আমাদের নৈতিকতার স্তর যেখানে নেমে গেছে, তাতে হিতোপদেশে কাজ হবে কি?
দেশে মারাত্মক পরিবেশদূষণকারী পাঁচ শতাধিক শিল্প-কারখানা চিহ্নিত করা হয়েছে প্রায় এক দশক আগে। এখন সেই সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কে জানে? এসব শিল্প-কারখানার অধিকাংশের অবস্থান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে। এগুলোর শিল্পবর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব কারখানার সক্রিয় বিষাক্ত বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায়ই নদী-নালা ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। জলজ পরিবেশ ধ্বংস করে, মাটি দূষিত করে কিংবা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে। এসব বর্জ্যে এমন কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যেগুলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত।
উন্নত দেশগুলো পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বা ইআইএ ছাড়া কোনো শিল্প স্থাপনের কথা কল্পনাও করা যায় না। আমাদের দেশেও ইআইএ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিল্প স্থাপন করার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু কাজির গরু কেতাবেই থেকে যায়। বিগত সরকারগুলো এ ব্যাপারে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। বর্তমান সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। গণতান্ত্রিক সরকার হলেও তারা গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত নয়। সে কারণেই তালিকাভুক্ত পাঁচ শ কারখানা বছরের পর বছর দিব্যি পরিবেশদূষণ করে যেতে পারছে। আমরা এ পরিস্থিতির অবসান চাই। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ আশা করি।
লেখক : সাংবাদিক
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স এবং সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মানবদেহে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি বিষাক্ত পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর চেয়ে ভয়ংকর খবর আর কী হতে পারে! অথচ তা নিয়ে আমাদের কারো কোনো উদ্বেগ নেই, কোনো মাথাব্যথা নেই। না রাষ্ট্রের, না ব্যক্তির। শরীরে এ ধরনের বিষের উপস্থিতি ক্যান্সার সৃষ্টি, লিভার ও কিডনি অকেজো করাসহ নানা ধরনের রোগব্যাধির জন্ম দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন তথ্যে বাংলাদেশে এসব রোগব্যাধির ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানুষের শরীরে প্রতি গ্রাম রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ সহনীয় হলেও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্তে ৯.৭ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ পাওয়া গেছে। আবর্জনা অথবা ভারী ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজ করে এমন শিশুদের কারো কারো শরীরে ১৩.৬ মাইক্রোগ্রাম (৬৮ গুণ) পর্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজারে এখন এমন খাদ্যদ্রব্য পাওয়াই কঠিন, যাতে কোনো না কোনো ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নেই। ফরমালিন, কার্বাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার যেন একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ফসলি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে যেখানে কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল তিন কোটি ৮৫ লাখ টাকার, সেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে কীটনাশক আমদানি করা হয়েছে ১৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। আর আমদানির চেয়েও বেশি পরিমাণ কীটনাশক দেশে প্রবেশ করে অবৈধভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে। আমাদের কৃষকদের কোন ফসলের কতটুকু জমিতে কতটুকু কীটনাশক এবং কী ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে, সেই জ্ঞান নেই বললেই চলে। ফলে তারা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করে। অতিরিক্ত কীটনাশক খাদ্যবাহিত হয়ে মানব শরীরে আসে। প্রতিটি কীটনাশকেরই সক্রিয় আয়ুষ্কাল আছে। জ্ঞান না থাকায় যেখানে স্বল্প আয়ুষ্কালের কীটনাশক ব্যবহার করলে চলে, সেখানে দীর্ঘ আয়ুষ্কালের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহারের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেসব শাকসবজি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। অথচ দেখা যায়, তরিতরকারিতে কীটনাশক ব্যবহারের পরদিনই সেগুলো তারা বাজারে নিয়ে আসে। সেই তরিতরকারি খেলে শরীরেও বিষক্রিয়া হয়। অনেক কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী বা জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও পানির মাধ্যমে সেগুলো মানব শরীরে প্রবেশ করে। ভারী ধাতব কারখানায় কাজ করার সময় যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নেওয়া হয় না। ফলে সেসব কারখানায় কর্মরত শিশুরা সহজেই অধিক পরিমাণে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। একটি স্বাধীন-সভ্য দেশে এই নৈরাজ্য আর কত দিন চলবে?
পৃথিবীর সভ্য বা উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করার কিছু নিয়ম-কানুন আছে এবং সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয়। আমাদের দেশে নিয়ম থাকলেও তা মেনে চলার বা মানতে বাধ্য করার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য সংরক্ষণে কোনো রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করার আগে সংশ্লিষ্ট কম্পানিকে উপাদানের বৈজ্ঞানিক তথ্যাদিসহ নমুনা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএর কাছে জমা দিতে হয়। এফডিএর গবেষকরা মানবদেহ ও পরিবেশের ওপর তার প্রভাব যাচাই করেন এবং সন্তুষ্ট হলেই কেবল কম্পানিটিকে তা ব্যবহারের অনুমতি দেন। ফরমালিনের ব্যবহার উন্নত বিশ্বের সব দেশেই নিষিদ্ধ। ১৯০৬ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তার ১০০ বছর পরও বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ ফরমালিনযুক্ত মাছ খেলে কিডনির রোগ, রক্তের ক্যান্সার, জন্মত্রুটি (টেরাটোজেনিক ইফেক্টস), ক্যান্সার এবং মহিলাদের ঋতুস্রাবের সমস্যা ও বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।
আর শুধু ফরমালিনের সমস্যাই বা বলি কেন? পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য নির্ধারিত লেগুনগুলোতে অবৈধভাবে চাষ এবং সেই মাছ বিক্রি করার কথা কি আমাদের অজানা! ওয়াসার সিবিএ নেতাদের যোগসাজশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লেগুনগুলোতে অবৈধভাবে মাছের চাষ করত এবং সেসব মাছ ঢাকার বাজারে বিক্রি করত। আমাদের নৈতিকতার স্তর যেখানে নেমে গেছে, তাতে হিতোপদেশে কাজ হবে কি?
দেশে মারাত্মক পরিবেশদূষণকারী পাঁচ শতাধিক শিল্প-কারখানা চিহ্নিত করা হয়েছে প্রায় এক দশক আগে। এখন সেই সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কে জানে? এসব শিল্প-কারখানার অধিকাংশের অবস্থান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে। এগুলোর শিল্পবর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব কারখানার সক্রিয় বিষাক্ত বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায়ই নদী-নালা ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। জলজ পরিবেশ ধ্বংস করে, মাটি দূষিত করে কিংবা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে। এসব বর্জ্যে এমন কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যেগুলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত।
উন্নত দেশগুলো পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বা ইআইএ ছাড়া কোনো শিল্প স্থাপনের কথা কল্পনাও করা যায় না। আমাদের দেশেও ইআইএ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিল্প স্থাপন করার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু কাজির গরু কেতাবেই থেকে যায়। বিগত সরকারগুলো এ ব্যাপারে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। বর্তমান সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। গণতান্ত্রিক সরকার হলেও তারা গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত নয়। সে কারণেই তালিকাভুক্ত পাঁচ শ কারখানা বছরের পর বছর দিব্যি পরিবেশদূষণ করে যেতে পারছে। আমরা এ পরিস্থিতির অবসান চাই। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ আশা করি।
লেখক : সাংবাদিক
No comments