চারদিক-মন ভইরা গোশত খাই

তখন পড়ন্ত বিকেল। ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কসংলগ্ন রবীন্দ্রসরোবরের পুরোটা জুড়েই জম্পেশ আড্ডা। বিভিন্ন বয়সের মানুষের সমাগমে আসরগুলো ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। কেউ হয়তো গিটার হাতে উচ্চস্বরে গান গাইছে। কেউ আবার বৈকালিক হাঁটা সেরে বিশ্রাম করছেন। তবে এত সব আয়োজনের মধ্যেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা আসলেই কষ্ট দেয়।


হয়তো আড্ডার মধ্যে পানির বোতল কিংবা কফি শেষ করে পাত্রটা ছুড়ে ফেলেছেন। তবেই সেরেছে, একঝাঁক ছোট্ট শিশু এসে হাজির। সবার নজর ওই বোতলের দিকে। আর এমন একটা করে বোতল আর টোকানো পত্রিকা দিয়েই হয়তো দিনের রোজগারটা হয় ওদের।
বয়স খুব বেশি নয়, ছয়-সাত কিংবা নয় হবে হয়তো। বয়সের ভার নয়, বরং ব্যাগের ভারেই নুয়ে পড়ছে এই ছোট শিশুরা। তবে ব্যাগের ওজন যতই বেশি হোক, বইতে একদমই কষ্ট হচ্ছে না, বরং আনন্দই যেন ঢের।
ঈদের মাত্র কয়েক দিন বাকি। আর এখন টাকা খুব বেশি দরকার। কেননা, ঈদের নতুন জামাটা এখনো জোটেনি। ব্যাগের ভার বেশি হওয়ায় খোকনের কোনো রকম কষ্ট হচ্ছে না। বরং হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা তার। খোকন, ফাতেমা আর মিলন। ওরা বিভিন্ন বয়সের। তবে ওদের সবচেয়ে বড় মিল হলো, ওরা কেউ ভিক্ষা করে না। একসঙ্গে টোকাইয়ের কাজ করে। সবাই থাকে রায়েরবাজার বস্তিতে। প্রতিদিন ৬০ টাকা, ভাগ্য ভালো হলে ১২০ টাকার বোতল বিক্রি করে। সকালে রায়েরবাজার থেকে দলবেঁধে একসঙ্গে আসে রবীন্দ্রসরোবরে। কাজের ফাঁকে খেলা, মারামারি আর খাওয়াদাওয়ার পর্বটাও চলে। তবে শীত চলে আসায় কিছুটা মন খারাপ। শীতের সময় পানির বোতল খুব বেশি হয় না, তাই কামাই-রোজগার কিছুটা কম। সবাই ছোট, হাত পেতে আছে, আর খোকন প্রতিটা হাতে হিসাব করেই বাদাম দিচ্ছে। কেউ যেন কম কিংবা বেশি না পায়। এটা তার কঠিন দায়িত্ব। খোকন বলে, ‘এই বাদাম এক আপায় দিছে। ফাতেমা আর মিলনরে না দিয়া একলা কেমনে খাই!’
খোকনকে প্রশ্ন করি, ‘বাড়িতে কে কে আছে?’ ‘আমি আর নানি। নানি বাড়িতে কাম করে আর আমি বুতুল টুকাই। সারা দিন যে কয় ট্যাকা হয়, নানিরে দেই।’
ফাতেমা কয়েক দিন হলো ওদের সঙ্গে কাজে যোগ দিয়েছে। ফাতেমা বলে, ‘আগে তো স্কুলে যাইতাম, তয় মায়ে কইছে স্কুলে গিয়া কাম নাই, তাই বুতুল টুকাইতাছি।’
ফাতেমা তো বলেই ফেলে, ‘দেন আপা, আপনার হাতের কলম আর খাতা দেন, আমার নাম লেইখ্যা দেই।’ কাগজ-কলম দিতেই গোটা হরফে নিজের নাম লেখে বীরদর্পে। নিজের বন্ধুদের সামনে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরে দারুণ খুশি সে।
এদের সবার মাঝে ছোট্ট মিলনের ঝোলাটা বেশি ভারী। মিলন বলে, ‘আমিও লায়েরবাজার থাহি। আমি, মা আর আছে ছুড বোইন। ওর নাম সুজনা। আমি ট্যাকা দিলে মায়ে ওরে কইটের (গুঁড়াদুধ) দুধ কিন্যা খাওয়ায়।’
আর বাবা?
মাটির দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বলে, ‘মায়ে কইছে, বাহে মইরা গেছে।’
আর ঈদের দিন কীভাবে কাটে?
এবার সবার মুখে হাসি। ঈদ মানেই যে খুশি, তা এই কচি মুখের হাসি বলে দেয়। উত্তরটা সবার আগে দেয় খোকন, ‘রোজার ঈদের কালে তো সক্কালে সুমুই খাইছি। পরে নতুন কাপড় পিনছিলাম।’ ছোট্ট মিলন বলে, ‘আজইকা এক ভাইয়া একটা শার্ট আর এক আপায় একটা প্যান দিছে। এবার নতুন শার্ট আর প্যান পিইন্দা গোস্ত টুকামু।’
কিছুটা শান্ত ফাতেমা বলে, ‘আমিও গোস্ত টুকামু।’ খোকন বলে, ‘ঈদের দিন মেলা বাড়ি যাইয়া গোস্ত টুকাই। মন ভইর‌্যা গোস্ত খাই। কেউ কিছু কয় না। নানি বাজার থেইক্যা গোস্ত কিনলে বেশি খাইতে দেয় না। কোরবানির ঈদের সব গোস্তই আমি টুকাই। তাই বেশি খাইলে নানি কিছু কয় না।’
ওদের সবার চোখ চকচক করছে। কোরবানির মাংসের লোভ ওদের চোখে-মুখে। হাতের কর গুনে ফাতেমা হিসাব করে বলে, ‘কোরবানির আর তিন দিন বাকি।’
কোরবানির ঈদে সবার ছোট মিলন বাদে আর কেউ নতুন পোশাক পায়নি, তাতেও ওদের কষ্ট নেই। মাংস টোকাতে পারবে—এই আশায় তারা দিন গুনছে।
এরই মাঝে ফেলানো পানির একটা বোতল দেখে ওরা সবাই ছুটে যায়। যে আগে পৌঁছাবে, সে-ই এই বোতলের গর্বিত মালিক হবে।
সূর্য তখন রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে। লাল সূর্যের আভায় নিষ্পাপ কচি মুখগুলো দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে, একেকটা স্বপ্নময় সূর্য যেন আলো ছড়াচ্ছে চারপাশে।
 শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.