চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-আমরা কি পাকিস্তান আমলেই অনেক বেশি ভালো ছিলাম? by যতীন সরকার
দৃশ্যমান বাস্তবে যখন কোনো ঘটনা ঘটে যায়, তখন সেই ঘটনাই মানুষের চিন্তায় আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ঘটে যাওয়া ঘটনার মোকাবিলা করতেই মানুষ নানা কর্মপন্থা গ্রহণ করে। সেই পথ ধরেই সে অনাগত ভবিষ্যতের অভিমুখে চলতে থাকে। সে রকম চলার মধ্য দিয়ে সে অতীতের ভুল সম্বন্ধেও সচেতন হয়ে ওঠে এবং সেই ভুল সংশোধনে ব্রতী হয়। এমনটিই গড়পড়তা সাধারণ মানুষের দস্তুর।
কিন্তু যাঁদের আমরা অসাধারণ মানুষ বলি, যাঁরা 'মণীষী' বলে গণ্য, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই তাঁদের মানস জগতে অনেক অনাগত ঘটনার প্রতিভাস দেখা দেয়। অবিভক্ত ভারতের এমনই একজন অসাধারণ মানুষ ও মণীষীর কথা আজ আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি, যাঁর নাম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। ১৯৪৫-৪৬ সালে ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যখন তুঙ্গে, যখন এ দেশের প্রায় সব মুসলমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে ভারতবর্ষের সব মুসলমানের অবিসংবাদিত নেতারূপে স্বীকৃত ও সম্মানিত, তখনো উজানস্রোতে নৌকা বেয়ে চলেছেন অসাধারণ প্রাজ্ঞ মুসলমান মনীষী মাওলানা আবুর কালাম আজাদ। কম্বুকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করছেন_'পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের জন্য আত্মহত্যা।' তাঁর সে সময়ে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকার 'দৈনিক কালের কণ্ঠ' পত্রিকার সৌজন্যে সম্প্রতি বাংলা একাডেমীর 'উত্তরাধিকার'-এ (আশ্বিন, ১৪১৮) পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ওই সাক্ষাৎকারটি পাঠ করে আমরা চমৎকৃত হয়ে গেছি। যখন বাস্তবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি, অথচ তার প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, তখনই মাওলানা আজাদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টি স্ফটিক স্বচ্ছ হয়ে যেতে দেখেছি, তখনই অনাগত পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সঙ্গে পূর্ব অংশের বিভেদের এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বিবৃত করেছিলেন_
'আরেকটা বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি জানেন না, বাংলাদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।... বাংলাদেশের পরিবেশ এমনই যে বাঙালিরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং তখনই বিদ্রোহ করে, যখন তাদের অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা বিশেষভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। যত দিন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী জীবিত আছেন, তত দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি তাদের বিশ্বাস থাকবে। কিন্তু ওঁরা যখন থাকবেন না তখন যেকোনো ছোট ছোট ঘটনায় ওঁদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা মোটেই সম্ভব নয়।... পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একেবারে আলাদা। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এখন ওদের মনে যে উষ্ণতা আছে, তা পরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে এবং বিরোধ ও প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠবে। তখন বাইরের শক্তিগুলো এতে ইন্ধন জোগাবে ও একসঙ্গে এই খণ্ড আলাদা হয়ে যাবে।'
মাওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি সঠিক প্রমাণিত করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর পরবর্তীকালে অবশিষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাগ্যে কী ঘটবে, সে সম্পর্কেও এই প্রাজ্ঞ মাওলানা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন_
'...(পাকিস্তানের) অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব
সামরিক শাসন ডেকে আনবে, যা নাকি অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ঘটেছে।... পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র (চলবে)। এ অবস্থায় পাকিস্তানের স্থায়িত খুবই একটা চাপের মুখে পড়বে এবং কোনো মুসলিম রাষ্ট্র থেকেই কার্যকরী সাহায্য পাওয়া যাবে না। অন্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষ সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, তবে পাকিস্তানের মূলমন্ত্র ও রাষ্ট্রকে এর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হবে।'
এখন মূল পাকিস্তানে যা-ই ঘটুক না কেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে পাকিস্তানের ভূতের আছরে খুব দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিতে যা যা ঘটেছিল এবং বিংশ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সেখানে যা যা ঘটছে, পাকিস্তানের ভূতের আছরগ্রস্ত বাংলাদেশে ঠিক সেই সবই যেন ঘটে চলছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো মনে হয় যে আসল পাকিস্তানের চেয়ে তার ভূত আরো বেশি শক্তিমান। পাকিস্তানের 'জাতির পিতা' বা তথাকথিত কায়েদে আজম কারো হাতে নিহত হননি।
অথচ বাংলাদেশে এ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি, ভূতের হাতেই নিহত হলেন সপরিবারে। বাংলাদেশের অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের চারজন নেতাকে কারাবন্দি অবস্থায় ঘাতকের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হলো। প্রায় দুই দশক ধরে দুজন সামরিক শাসকের হাতে নিষ্পিষ্ট হয়ে দেশটি তার প্রায় সব অর্জনই হারিয়ে ফেলল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির অবস্থা কী দাঁড়াবে সে বিষয়ে মাওলানা আজাদের অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আমরা অবহিত হয়েছি। কিন্তু পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মাওলানা কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন কি না আমরা জানতে পারিনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই এ রাষ্ট্রটি সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়েছিল যাঁদের, সে সময় থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যেসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা, তাঁরাও স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূতের আছরগ্রস্ত হওয়ার কথা ভাবতে পেরেছিলেন কি?
এ বিষয়েও আমরা কিছু জানি না।
তবে যাদের ইচ্ছায় ও আচরণে ভূত হয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তারা বোধ হয় পাকিস্তানকেই তাদের বাপ বলে বিবেচনা করে। তাদের বাপটি যে অত্যন্ত মন্দ ছিল, সে বিষয়ে বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষরাও অবহিত। অথচ স্বাধীনতার চার বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই দেশটিকে পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি দুরবস্থায় নিপতিত হতে দেখে এখানকার অনেক সাধারণ মানুষের কণ্ঠেও শোনা যেতে লাগল_'এর চেয়ে আমরা পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম।'
কথাটি যেন 'এর চেয়ে এর বাপটা ভালো ছিল'_এ রকম একটি কথারই প্রতিধ্বনি। কথাটি আমি ছেলেবেলায় ময়মনসিংহ শহরে শুনেছিলাম। ওই শহরে একসময় একজন খুব বড় পণ্ডিত অবস্থান করতেন। কিন্তু পণ্ডিত হলে কী হবে? তিনি ছিলেন পাঁড় মাতাল। তাঁর বাপও মাতাল ছিলেন। মাতাল হওয়ার দরুনই ওই পণ্ডিতের বাপকে লোকে খুবই মন্দ বলত। সেই মাতাল বাপের পণ্ডিত ছেলে বললেন, 'আমি এমন কাজ করব, যাতে লোকে আমার বাপকে ভালো বলতে বাধ্য হবে।'
যে কথা সেই কাজ। ওই পণ্ডিত মানুষটি মদ খেয়ে মাতাল হতেন না শুধু, মাতাল হয়ে আশপাশের সব মানুষকে অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতেন। লোকে তখন বলতে লাগল যে এর চেয়ে তো এর বাপটা ভালো ছিল। সে মদ খেত বটে, কিন্তু কাউকে গালাগাল দিত না। ছেলে তো এ ব্যাপারে বাপকে ছাড়িয়ে গেছে।'
আমাদেরও হয়েছে সেই দশা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আমাদের যেরকম শোষণ-নির্যাতন করত, স্বাধীনতার পর যাদের কাঁধে পাকিস্তানের ভূত এসে ভর করেছে, তারা শোষণ-নির্যাতন ও চুরিচামারিতে পাকিস্তানকেও অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছে। লোকে বলতে বাধ্য হচ্ছে যে এদের চেয়ে তো এদের বাপটা (অর্থাৎ পাকিস্তান) অনেক ভালো ছিল।
এর কারণ কী? একাত্তরের সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু যে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'_সে কথাটিকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছি মাত্র, দেশের সব মানুষের মুক্তি সাধন করতে পারিনি, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে ওপরতলার কিছু মানুষই স্বাধীনতার সব মজা লুটে নিচ্ছে। অগণিত গরিব মানুষ আরো গরিব হচ্ছে। সেসব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজের ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটিতে করতে পেরেছি কি?
এ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হবে। তার জন্যই নতুন করে মুক্তির সংগ্রামে আমাদের নেমে পড়তে হবে। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান/মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।'_যদি আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই সাবধান-বাণী এখনো স্মরণ না করি, তাহলে অচিরেই আমাদের মতো সুবিধাভোগী মানুষদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
তবে সুখের বিষয় এই যে আমাদের তরুণ সমাজ এরই মধ্যে সচেতন ও সতর্ক হয়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সবাইকে উদ্যোগী হয়ে উঠতে হবে। আমাদের এই নেত্রকোনার লোক কবি জালাল উদ্দীন খাঁ যে বলেছিলেন_
'মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে? মানুষ ভজ কোরান খোঁজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।'
_তাঁর সেই আহ্বানে সাড়া দিতেই হবে আমাদের।
আজ সারা বিশ্বের মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জেগে উঠেছে। আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশেই 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' বলে শতকরা এক ভাগ শোষকের হাত থেকে শতকরা নিরানব্বই জন শোষিত মানুষকে রক্ষার জন্য মানুষ গর্জে উঠেছে। তাদের গলার সঙ্গে আমাদেরও গলা মেলানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এবং এভাবেই শুরু করতে হবে নতুন মুক্তিসংগ্রাম। সেই সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারলেই আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভটি যথাযথ সার্থক হয়ে উঠবে, আমাদের বিজয় সম্পন্ন হবে, জনগণ তাদের হারানো মালিকানা ফিরে পাবে। 'পাকিস্তান আমলেই আমরা ভালো ছিলাম'_তখন এমন কথা কাউকেই বলতে হবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ
'আরেকটা বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি জানেন না, বাংলাদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।... বাংলাদেশের পরিবেশ এমনই যে বাঙালিরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং তখনই বিদ্রোহ করে, যখন তাদের অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা বিশেষভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। যত দিন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী জীবিত আছেন, তত দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি তাদের বিশ্বাস থাকবে। কিন্তু ওঁরা যখন থাকবেন না তখন যেকোনো ছোট ছোট ঘটনায় ওঁদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা মোটেই সম্ভব নয়।... পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একেবারে আলাদা। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এখন ওদের মনে যে উষ্ণতা আছে, তা পরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে এবং বিরোধ ও প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠবে। তখন বাইরের শক্তিগুলো এতে ইন্ধন জোগাবে ও একসঙ্গে এই খণ্ড আলাদা হয়ে যাবে।'
মাওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি সঠিক প্রমাণিত করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর পরবর্তীকালে অবশিষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাগ্যে কী ঘটবে, সে সম্পর্কেও এই প্রাজ্ঞ মাওলানা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন_
'...(পাকিস্তানের) অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব
সামরিক শাসন ডেকে আনবে, যা নাকি অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ঘটেছে।... পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র (চলবে)। এ অবস্থায় পাকিস্তানের স্থায়িত খুবই একটা চাপের মুখে পড়বে এবং কোনো মুসলিম রাষ্ট্র থেকেই কার্যকরী সাহায্য পাওয়া যাবে না। অন্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষ সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, তবে পাকিস্তানের মূলমন্ত্র ও রাষ্ট্রকে এর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হবে।'
এখন মূল পাকিস্তানে যা-ই ঘটুক না কেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে পাকিস্তানের ভূতের আছরে খুব দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিতে যা যা ঘটেছিল এবং বিংশ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সেখানে যা যা ঘটছে, পাকিস্তানের ভূতের আছরগ্রস্ত বাংলাদেশে ঠিক সেই সবই যেন ঘটে চলছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো মনে হয় যে আসল পাকিস্তানের চেয়ে তার ভূত আরো বেশি শক্তিমান। পাকিস্তানের 'জাতির পিতা' বা তথাকথিত কায়েদে আজম কারো হাতে নিহত হননি।
অথচ বাংলাদেশে এ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি, ভূতের হাতেই নিহত হলেন সপরিবারে। বাংলাদেশের অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের চারজন নেতাকে কারাবন্দি অবস্থায় ঘাতকের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হলো। প্রায় দুই দশক ধরে দুজন সামরিক শাসকের হাতে নিষ্পিষ্ট হয়ে দেশটি তার প্রায় সব অর্জনই হারিয়ে ফেলল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির অবস্থা কী দাঁড়াবে সে বিষয়ে মাওলানা আজাদের অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আমরা অবহিত হয়েছি। কিন্তু পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মাওলানা কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন কি না আমরা জানতে পারিনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই এ রাষ্ট্রটি সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়েছিল যাঁদের, সে সময় থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যেসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা, তাঁরাও স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূতের আছরগ্রস্ত হওয়ার কথা ভাবতে পেরেছিলেন কি?
এ বিষয়েও আমরা কিছু জানি না।
তবে যাদের ইচ্ছায় ও আচরণে ভূত হয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তারা বোধ হয় পাকিস্তানকেই তাদের বাপ বলে বিবেচনা করে। তাদের বাপটি যে অত্যন্ত মন্দ ছিল, সে বিষয়ে বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষরাও অবহিত। অথচ স্বাধীনতার চার বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই দেশটিকে পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি দুরবস্থায় নিপতিত হতে দেখে এখানকার অনেক সাধারণ মানুষের কণ্ঠেও শোনা যেতে লাগল_'এর চেয়ে আমরা পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম।'
কথাটি যেন 'এর চেয়ে এর বাপটা ভালো ছিল'_এ রকম একটি কথারই প্রতিধ্বনি। কথাটি আমি ছেলেবেলায় ময়মনসিংহ শহরে শুনেছিলাম। ওই শহরে একসময় একজন খুব বড় পণ্ডিত অবস্থান করতেন। কিন্তু পণ্ডিত হলে কী হবে? তিনি ছিলেন পাঁড় মাতাল। তাঁর বাপও মাতাল ছিলেন। মাতাল হওয়ার দরুনই ওই পণ্ডিতের বাপকে লোকে খুবই মন্দ বলত। সেই মাতাল বাপের পণ্ডিত ছেলে বললেন, 'আমি এমন কাজ করব, যাতে লোকে আমার বাপকে ভালো বলতে বাধ্য হবে।'
যে কথা সেই কাজ। ওই পণ্ডিত মানুষটি মদ খেয়ে মাতাল হতেন না শুধু, মাতাল হয়ে আশপাশের সব মানুষকে অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতেন। লোকে তখন বলতে লাগল যে এর চেয়ে তো এর বাপটা ভালো ছিল। সে মদ খেত বটে, কিন্তু কাউকে গালাগাল দিত না। ছেলে তো এ ব্যাপারে বাপকে ছাড়িয়ে গেছে।'
আমাদেরও হয়েছে সেই দশা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আমাদের যেরকম শোষণ-নির্যাতন করত, স্বাধীনতার পর যাদের কাঁধে পাকিস্তানের ভূত এসে ভর করেছে, তারা শোষণ-নির্যাতন ও চুরিচামারিতে পাকিস্তানকেও অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছে। লোকে বলতে বাধ্য হচ্ছে যে এদের চেয়ে তো এদের বাপটা (অর্থাৎ পাকিস্তান) অনেক ভালো ছিল।
এর কারণ কী? একাত্তরের সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু যে বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'_সে কথাটিকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছি মাত্র, দেশের সব মানুষের মুক্তি সাধন করতে পারিনি, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে ওপরতলার কিছু মানুষই স্বাধীনতার সব মজা লুটে নিচ্ছে। অগণিত গরিব মানুষ আরো গরিব হচ্ছে। সেসব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজের ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটিতে করতে পেরেছি কি?
এ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হবে। তার জন্যই নতুন করে মুক্তির সংগ্রামে আমাদের নেমে পড়তে হবে। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান/মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।'_যদি আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই সাবধান-বাণী এখনো স্মরণ না করি, তাহলে অচিরেই আমাদের মতো সুবিধাভোগী মানুষদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
তবে সুখের বিষয় এই যে আমাদের তরুণ সমাজ এরই মধ্যে সচেতন ও সতর্ক হয়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সবাইকে উদ্যোগী হয়ে উঠতে হবে। আমাদের এই নেত্রকোনার লোক কবি জালাল উদ্দীন খাঁ যে বলেছিলেন_
'মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে? মানুষ ভজ কোরান খোঁজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।'
_তাঁর সেই আহ্বানে সাড়া দিতেই হবে আমাদের।
আজ সারা বিশ্বের মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জেগে উঠেছে। আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশেই 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' বলে শতকরা এক ভাগ শোষকের হাত থেকে শতকরা নিরানব্বই জন শোষিত মানুষকে রক্ষার জন্য মানুষ গর্জে উঠেছে। তাদের গলার সঙ্গে আমাদেরও গলা মেলানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এবং এভাবেই শুরু করতে হবে নতুন মুক্তিসংগ্রাম। সেই সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারলেই আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভটি যথাযথ সার্থক হয়ে উঠবে, আমাদের বিজয় সম্পন্ন হবে, জনগণ তাদের হারানো মালিকানা ফিরে পাবে। 'পাকিস্তান আমলেই আমরা ভালো ছিলাম'_তখন এমন কথা কাউকেই বলতে হবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments