খোলা চোখে-পুনরায় জুকোটি পার্কে by হাসান ফেরদৌস

গেল সপ্তাহান্তে জুকোটি পার্কে গিয়েছিলাম, সঙ্গে কন্যা ও ডেনভার থেকে আসা এক অধ্যাপক বন্ধু। এই পার্কেই দেড় মাস ধরে চলছে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ (ওয়াল স্ট্রিট দখল করো) আন্দোলন। ইতিমধ্যে ঠান্ডা জেঁকে বসতে শুরু করেছে। অক্টোবরেই এমন ঠান্ডা পড়বে কে ভেবেছিল! ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে লোকজন ছোট ছোট তাঁবু গেড়ে নিয়েছে।


গোটা দুই জেনারেটর নজরে এল, রাতে আলো ও উত্তাপের জন্য। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন ঠান্ডায় থাকবে কী করে? তার সদাপ্রসন্ন উত্তর, ‘থাকবার জন্য এসেছি, হটবার জন্য নয়। উই আর হিয়ার ফর দি লং হল।’ আমার হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে বলল, ‘কাল এসো, আমরা স্টক এক্সচেঞ্জ ঘেরাও করতে যাব।’ কাগজে লেখা—‘আই অ্যাম দ্য ৯৯ পারসেন্ট’।
তার কথা শুনে আমার মাথায় একটি প্রশ্ন জাগল। আচ্ছা, সারা দুনিয়ায় অকুপাই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ১৫ অক্টোবর পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশে একই সময়ে অকুপাই আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল হয়েছে। তার থেকে এই আন্দোলনের নতুন স্লোগান দাঁড়িয়েছে, অকুপাই এভরি হোয়ার। কোথাও কোথাও বিক্ষোভকারীরা সাময়িকভাবে হলেও নিজেদের প্রতীকী দখলদারি কায়েম করেছে। কিন্তু ঢাকায় এর কোনো প্রভাব নেই কেন? আমাদের দেশেও তো ওই ১ শতাংশ মানুষ সব চেটেপুটে খাচ্ছে। শেয়ারবাজারে চলছে হরির লুট। সেখানেও তো ওই ১ শতাংশ নিজেদের স্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করে বসে আছে। শেয়ারবাজার সংস্কারের নামে যেসব নতুন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তাতেও সব চেনা মুখ ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তাহলে ঢাকায় অকুপাই স্টক এক্সচেঞ্জের কথা কেউ ভাবছে না কেন?
যেকোনো পরিবর্তন, তা দেশের রাজনীতি বা অর্থনীতি—যে ক্ষেত্রেই হোক, তার জন্য দরকার কিছুটা পরিকল্পিত উদ্যোগ, কিছুটা ত্যাগ স্বীকার। ইদানীং আমেরিকায় একটা কথা খুব চালু হয়েছে, ডেমোক্রেসি ইজ নট এ স্পেকটেটর স্পোর্ট। এই নামে প্রকাশিত একটি বইয়ের মোদ্দা কথা, গ্যালারিতে বসে বসে দেখবে আর নিরাপদ দূরত্ব থেকে হয় হাততালি দেবে, নয়তো দুয়ো দুয়ো করবে—গণতন্ত্র ব্যাপারটা এ রকম নয়। নিজেকে মাঠে নামতে হবে, দরকার পড়লে পুলিশের লাঠির বাড়ি বা বুটের গুঁতো খেতে হবে। মাটি কামড়ে থাকতে হবে দিনের পর দিন।
এই অকুপাই আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। কাগজ-কলমে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঠিক দেড় মাস আগে, ১৭ সেপ্টেম্বর, হাতে গোনা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। একদম আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হলেও এর পেছনে কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছিল না, তা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চলছিল। খুব অল্পসংখ্যক হলেও কয়েকজন রোদে পোড়া বহু অভিজ্ঞ রাজনৈতিক কর্মী এই অকুপাই আন্দোলনের পরিকল্পনার পেছনে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। প্রথম জমায়েতের মাস আড়াই আগে, ১৩ জুলাই অকুপাইয়ের প্রস্তাব করে একটি ই-মেইল ছাড়া হয়, সঙ্গে টুইটারে একটি বার্তা: ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। প্রায় একই সময়ে অকুপাই ফ্রিডম প্লাজা, ওয়াশিংটন ডিসির আহ্বান জানিয়ে আরেকটি বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে। ‘এনোনিমাস’ নামের অন্তরালে একদল ইন্টারনেট অ্যাকটিভিস্ট তাদের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঝটপট সেই খবর চতুর্দিকে রাষ্ট্র করে দেয়। তার পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। খুব পাকাপোক্ত না হলেও একটি ঢিলেঢালা পরিকল্পনা কমিটি রয়েছে, যারা আন্দোলন বেগবান করতে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো সময়ে আলোচনায় বসছে, কী করা যায় তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করছে। এই কমিটির নাম রাখা হয়েছে জেনারেল অ্যাসেম্বলি। খোলা মাঠে বা কোনো চত্বরে এই সাধারণ সভায় যে কেউই অংশ নিতে পারে। গড়পড়তা ৫০-৬০ জন নিয়মিত এই সভায় অংশ নিচ্ছে। ক্রমেই এই জেনারেল অ্যাসেম্বলি পরিণত হয়েছে অকুপাই আন্দোলনের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কমিটিতে।
কেউই ভাবতে পারেনি যে এই অকুপাই আন্দোলন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বা এত দিন তা জিইয়ে থাকবে। দক্ষিণপন্থীরা গোড়া থেকেই বলে আসছে, এই হচ্ছে পুরোনো হিপ্পিদের গাঁজা খাওয়ার, খোলামেলা যৌন মিলনের আরেক ফন্দি। সে কথা যে মোটেই সত্যি নয়, তা এখন সব পক্ষই মেনে নিয়েছে। যাঁরা আমেরিকার বিভিন্ন শহরে পুলিশি হামলা ও প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে দিনের পর দিন বিক্ষোভ ও জমায়েত করে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্র, শিক্ষক, বেকার যুবক, পেনশনভোগী, যুদ্ধ-ফেরত সেনা, সেবিকা, শ্রমিক, গির্জার সদস্য। বস্তুত, ১ শতাংশ সুবিধাভোগী ছাড়া বাকি যে ৯৯ শতাংশ, তাদের সব অংশেরই প্রতিনিধিত্ব এতে রয়েছে। সন্দেহ নেই, মিছিলের অগ্রভাগে যারা, তাদের অনেকেই ছাত্র। আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত। লেখাপড়া শেষ হয়নি, কিন্তু প্রায় সবাই ইতিমধ্যে ভারী অঙ্কের ঋণের বোঝায় ডুবে আছে। দেশের অর্থনীতি যেভাবে ক্রমেই গাড্ডায় ডুবছে, তাতে লেখাপড়া শেষে চাকরি জুটবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে তারাই সবচেয়ে উদ্বিগ্ন।
দক্ষিণপন্থীরা অভিযোগ তুলেছে, অকুপাই আন্দোলন হচ্ছে একধরনের ‘শ্রেণীযুদ্ধ’। এক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তো বলেই বসেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে সফল মানুষের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করে এমন লোকজনই এই আন্দোলনের সমর্থক। যাঁরা শ্রেণীর কথা বলেন, তাঁরা স্পষ্টতই এই কথাটা এড়িয়ে যান যে রোনাল্ড রিগানের সময় থেকে ওবামা পর্যন্ত আঙুল ফুলে যাঁরা কলাগাছ হয়েছেন, তাঁরা আমেরিকার সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে, শঠতার আশ্রয় নিয়ে পয়সা বানিয়েছেন। সম্প্রতি আমেরিকার কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস গত ৩০ বছরের পরিসংখ্যান নিরীক্ষা করে জানিয়েছে, এই সময়ে আমেরিকানদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু সবচেয়ে ধনী যে ১ শতাংশ, তাদের আয় বেড়েছে কম করে হলেও ২৭৫ শতাংশ। অন্য কথায়, বাকি ৯৯ শতাংশের তুলনায় তাদের বর্ধিত আয়ের পরিমাণ সাত গুণ বেশি। অন্যদিকে সবচেয়ে নিচের যে ২০ শতাংশ, তাদের আয় বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১৮ শতাংশ।
আমেরিকার ধনবান ১ শতাংশের এই অবিশ্বাস্য বর্ধিত উপার্জন সম্ভব হলো কীভাবে? এর সহজ উত্তর, সাধারণ মানুষকে কলা দেখিয়ে। প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদেরা বাজেট অফিসের পরিসংখ্যান থেকে যে মডেল তৈরি করেছেন, তা থেকেই স্পষ্ট যে এই পুকুরচুরি কীভাবে সম্ভব হয়েছে। নিজেদের খুশিমতো তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মার্কিন নাগরিকদের প্রতি মাসে বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে ৮২ ডলার। কংগ্রেসের যোগসাজশে ধনীদের ‘ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স’-এর ওপর রেয়াত দেওয়ার ফলে ধনিক ১ শতাংশ পকেটে ঢোকাচ্ছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার অধিকাংশ বড় কোম্পানি কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য দেশের বাইরে তাদের তহবিল জমা রাখে, এভাবে তারা প্রতিবছর কর ফাঁকি দিচ্ছে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি। এ রকম ফন্দি-ফিকির রয়েছে আরও ১৪ রকম।
বস্তুত, আমেরিকা ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশের গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে দেশগুলোর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর বল্গাহীন লোভ। গৃহসংস্থান ঋণব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আসল কারণই হলো আরও বেশি মুনাফার লোভে যেমন খুশি তেমন শর্তে ঋণ বিতরণ। এর সঙ্গে যুক্ত করুন ব্যাংকগুলোর প্রথামাফিক ব্যাংকিং ছেড়ে অর্থবাজারে পুরো মাত্রায় নেমে পড়া। সে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলায় কোনো ব্যাংকের চার আনাও ক্ষতি হয়নি। আমেরিকায় কেন্দ্রীয় সরকার এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে জনগণের করের টাকা দুই হাত ভরে তুলে দিয়েছে। সরকারগুলো বড়লোকের তেলা মাথায় তেল দিতে আপত্তি করেনি, কিন্তু গ্রিস বলুন, স্পেন বলুন—সর্বত্রই বাজেট-সংকটের কথা বলে বরং উল্টো জনকল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা যথাসম্ভব কাটছাঁট করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত নেমে এসেছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ওপর।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট এই অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। আয়ের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের মধ্যে যে বৈষম্য, এই আন্দোলনের ফলেই আমাদের চোখে তা এখন স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। এক সাম্প্রতিক জনমত জরিপ থেকে দেখেছি, আমেরিকার ৫৪ শতাংশ মানুষ অকুপাই আন্দোলনের পক্ষে। ২৩ শতাংশ বলেছে, তারা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে, তবে এই আন্দোলন ভ্রান্ত সে জন্য নয়। আমেরিকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন দুর্নীতিগ্রস্ত যে তা সংস্কারের বাইরে। সে কারণেই তারা এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায় না। অন্য কথায়, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই মনে করে, চলতি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা একদম ঢেলে না সাজালে পরিস্থিতি বদলাবে না। যেসব রিপাবলিকান একসময় অকুপাই আন্দোলনকে ‘অর্থহীন বাগাড়ম্বর’ বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন, এখন তাঁদেরও কেউ কেউ সুর বদলাতে শুরু করেছেন। যেমন: প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জন বেইনার মন্তব্য করেছেন, বিক্ষোভকারীরা কী চায় তা তিনি বুঝতে পারেন, তাদের দাবির প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল। প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করলেও এখন এই আন্দোলনের পক্ষে কিছুটা নিম্নকণ্ঠ হয়ে তাঁর সমর্থন উচ্চারণ করেছেন।
কিন্তু এই ৯৯ শতাংশের দাবি বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? জুকোটি পার্ক দুই মাস কেন, দুই বছর ‘অকুপাই’ করে রাখলেও আমেরিকায় করপোরেট সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক অসদাচারে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগবে না। কিন্তু ধরা যাক, এই আন্দোলনের প্রভাব এসে লাগল আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস নির্বাচনে। শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপের তিন প্রধান অর্থনীতি জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সেই আন্দোলনের প্রভাব থেকেও রক্ষা পেল না। আগামী বছরের মাঝামাঝি ও শেষ নাগাদ এসব দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। অকুপাই আন্দোলন যদি তত দিন জিইয়ে থাকে, নির্বাচনী রাজনীতির ওপর এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এই আশাবাদ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে শিল্পোন্নত দেশসমূহের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে যে পরিবর্তন আসবে, তার ধুলোঝড়ে রাজনৈতিক মানচিত্র বদলাতেও বাধ্য।
দেশের মানুষ যদি পরিবর্তন চায় এবং সে জন্য তাদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়, তাহলে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশেও সেই পরিবর্তনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত মিলেছে গত সপ্তাহের নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন থাকে। বড় দল, বড় বড় নেতা-নেত্রীর সুমধুর বচন সাধারণ মানুষ অনন্তকাল বিনা বাক্যে হজম করে যাবে, সেদিন এখন গত। কিছু লোককে কিছু সময়ের জন্য হয়তো ঠকানো যায়, অধিকাংশ মানুষ অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চোখে ঠুলি পরে বসে থাকবে, তা আর বিশ্বাস হয় না।
দিন বদলের আওয়াজ শুনছি, কায়রো থেকে জুকোটি পার্ক পর্যন্ত। প্রিয় ঢাকা, তুমি এখনো ঘুমিয়ে কেন? দেশের ঘুণে ধরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর হাতুড়ির বাড়ি দেওয়ার এখনই সময়। ‘অকুপাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ’ হতে পারে সে রকম একটি বাড়ি।

২ নভেম্বর, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.