পরান সখা বন্ধু হে আমার by মুকুল দাস
রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাখাল ছেলে ওয়াহিদুল হক ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যখন বারডেমের বেডে কোমায় আচ্ছন্ন থেকে জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ার অবস্থায় ছিলেন, তখন ভেবেছিলাম একবার প্রণাম করে আসি। আর হয়নি। ২৭ তারিখে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন তিনি।
সম্ভবত সাতাত্তর সালের কথা। ঢাকায় থাকাকালীন ময়মনসিংহ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ নুরুল আনোয়ার এসেছেন বাসায়। যাকে আমি নুরুদা বলে ডাকি। নুরুদাই প্রথম আমাকে নিয়ে যান পরীবাগে। যেখানে ওয়াহিদুল ভাইয়ের 'একটুকু বাসা'। প্রথম দর্শনেই তাকে দেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠি_ 'এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর/ পুণ্য হল অঙ্গ মম ধন্য হ অন্তর'।
এভাবে ধীরে ধীরে ওয়াহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। ঢাকা ছেড়ে যখন আবার আপন ঠিকানা বরিশালে ফিরে আসি, তখন ওয়াহিদুল ভাইয়ের স্মৃতি ঝাপসা হতে থাকে। বরিশাল এসে উদীচীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ওয়াহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সময় বরিশাল উদীচীর সভাপতি বদিউর রহমান ওয়াহিদুল ভাইকে বরিশাল নিয়ে আসেন। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের বরিশাল শাখা গঠন করা হয়। উদীচীর দোতলায় পাটিতে বসে ওয়াহিদুল ভাই রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং একটি গানও আমাদের শিখিয়ে দেন।
নব্বইতে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনের পরদিন বিডিএস মিলনায়তনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের ওয়াহিদুল ভাই শেখালেন, আমার নাইবা হল পারে যাওয়া। ওয়াহিদুল ভাইকে নেমতন্ন করি বাসায় খাওয়ার জন্য। আমি বলি, বাসাটি ছোট। তখন ওয়াহিদুল ভাই বলেন, এরপর বলবে আমার একটাই খাট, একটাই চেয়ার, একটাই টেবিল, একটাই বউ। পরদিন সকালবেলা প্রায় দশ থেকে পনের জনের এক কিশোরী বাহিনী নিয়ে ওয়াদিুল ভাই উপস্থিত। আমার স্ত্রী হিমশিম খেয়ে যায়। তখন ওয়াহিদুল ভাই কিশোরীদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা কেমন মেয়ে হে! দেখছ না নতুন সংসার পাতানো মেয়েটির কী হাল। তোমরা সবাই মিলে মেয়েটির কাজে হাত লাগাও। এ কথা বলার পর কিন্নরীর নেতৃত্বে মেয়েরা যে যার পেল্গট হাতে তুলে খেতে শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কারণ বসার জায়গার অভাব।
একবার পটুয়াখালীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে যাবেন বলে বরিশালে এসে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন ওয়াহিদুল ভাই। আমার বাসায় গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি তাকে বললাম, পটুয়াখালীতে খবর পাঠিয়ে দেই আপনি অসুস্থ। এ কথা শোনার পর ওয়াহিদুল ভাই তড়াক করে উঠে বসলেন। ওয়াহিদুল ভাই বললেন, ওরা আমার জন্য বসে থাকবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে যাও তাহলে আমার জ্বর বাপ বাপ করে পালাবে। সেই অবস্থাতেই আমাকে ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মোরশেদা লিপিকে নিয়ে পটুয়াখালী গিয়েছিলেন। আমাদের জায়গা হলো সার্কিট হাউসে। রাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের পটুয়াখালী সভাপতি নির্মল দাশগুপ্ত মন্টুদার বাসায় রাতের খাওয়া সারলাম। পটুয়াখালীতে আবদুল করিম মৃধা কলেজে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে শুরু করেছেন ওয়াহিদুল ভাই।
সবে শিক্ষার্থীদের শেখাতে গেছেন_ 'তোমার সুরের ধারা ঝরে/যেথায় তারি পারে' এবং 'মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে'। দ্বিতীয় গানটি শেখানোর সময় পটুয়াখালী প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকরা এসে হাজির। ওখানে যেতে হবে। দেড় ঘণ্টা পরে ওয়াহিদুল ভাই এসে আবার গান ধরলেন।
বরিশাল জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে অশ্বিনী কুমার হল মঞ্চে ওয়াহিদুল ভাই বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মতো কম্বুকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন, মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান। হলে পিনপতন স্তব্ধতা। শ্রোতা-দর্শক যেন মরণের সঙ্গে অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন করার জন্য ব্যাকুল। সেই আবৃত্তি এখনও শ্রুতিতে মধুবর্ষণ করে।
ওয়াহিদুল ভাই আমাকে মুকুন্দ দাসের গানের ভাণ্ডারি বলে ডাকতেন আবার কখনোবা সর্ববিদ্যাধর ওয়াহিদুল ভাই আমার আচরণে বিরক্ত হতেন কিন্তু কখনোই ভর্ৎসনা করতেন না।
সে রাতের কথা ভুলতে পারি না, চিটাগাংয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মুকুন্দ দাসের গা হয়ে হোটেল রাজে এসে শুয়ে পড়েছি। এমন সময় দরজায় করাঘাত। দরজা খুলতেই দেখি ওয়াহিদুল ভাই দাঁড়িয়ে। এসেই বললেন, আজি ঘুম নহে নিশি জাগরণ। লাগাতার গল্পগাথায় রাত কাবার।
শেষ দেখা কুমিল্লায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে। আমার স্ত্রী পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই বলেন, তাপু তুমি এসেছো? তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারলাম না, নাও এই কলাটা খাও। আমার স্ত্রী ওয়াহিদুল ভাইয়ের দেওয়া কলা প্রসাদ মনে করে ভক্তি ভরে খেয়েছে। কুমিল্লায় দেখলাম, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ওয়াহিদুল ভাইয়ের সিডি করেছে। শিরোনাম 'সকল কাঁটা ধন্য করে'। কুমিল্লার রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধক পরিমল দত্ত স্মারক গ্রন্থ ওয়াহিদুল ভাই আমাকে উপহার দিলেন। আমি কিছু লিখে দিতে বলায় ওয়াহিদুল ভাই বলেন, অটোগ্রাফ বিজনেস আমি করি না। অথচ ২২ বছর আগে ওয়াহিদুল ভাই আমাকে দ্বিপঞ্চাশতম খণ্ড স্বরবিতান উপহার দিয়ে লিখেছিলেন, অশেষ প্রত্যাশায়, চিরসবুজ মুকুলকে_ ওয়াহিদুল ভাই।
মুকুল দাস : বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এভাবে ধীরে ধীরে ওয়াহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। ঢাকা ছেড়ে যখন আবার আপন ঠিকানা বরিশালে ফিরে আসি, তখন ওয়াহিদুল ভাইয়ের স্মৃতি ঝাপসা হতে থাকে। বরিশাল এসে উদীচীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ওয়াহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সময় বরিশাল উদীচীর সভাপতি বদিউর রহমান ওয়াহিদুল ভাইকে বরিশাল নিয়ে আসেন। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের বরিশাল শাখা গঠন করা হয়। উদীচীর দোতলায় পাটিতে বসে ওয়াহিদুল ভাই রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং একটি গানও আমাদের শিখিয়ে দেন।
নব্বইতে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলনের পরদিন বিডিএস মিলনায়তনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের ওয়াহিদুল ভাই শেখালেন, আমার নাইবা হল পারে যাওয়া। ওয়াহিদুল ভাইকে নেমতন্ন করি বাসায় খাওয়ার জন্য। আমি বলি, বাসাটি ছোট। তখন ওয়াহিদুল ভাই বলেন, এরপর বলবে আমার একটাই খাট, একটাই চেয়ার, একটাই টেবিল, একটাই বউ। পরদিন সকালবেলা প্রায় দশ থেকে পনের জনের এক কিশোরী বাহিনী নিয়ে ওয়াদিুল ভাই উপস্থিত। আমার স্ত্রী হিমশিম খেয়ে যায়। তখন ওয়াহিদুল ভাই কিশোরীদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা কেমন মেয়ে হে! দেখছ না নতুন সংসার পাতানো মেয়েটির কী হাল। তোমরা সবাই মিলে মেয়েটির কাজে হাত লাগাও। এ কথা বলার পর কিন্নরীর নেতৃত্বে মেয়েরা যে যার পেল্গট হাতে তুলে খেতে শুরু করল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কারণ বসার জায়গার অভাব।
একবার পটুয়াখালীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে যাবেন বলে বরিশালে এসে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন ওয়াহিদুল ভাই। আমার বাসায় গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি তাকে বললাম, পটুয়াখালীতে খবর পাঠিয়ে দেই আপনি অসুস্থ। এ কথা শোনার পর ওয়াহিদুল ভাই তড়াক করে উঠে বসলেন। ওয়াহিদুল ভাই বললেন, ওরা আমার জন্য বসে থাকবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে যাও তাহলে আমার জ্বর বাপ বাপ করে পালাবে। সেই অবস্থাতেই আমাকে ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মোরশেদা লিপিকে নিয়ে পটুয়াখালী গিয়েছিলেন। আমাদের জায়গা হলো সার্কিট হাউসে। রাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের পটুয়াখালী সভাপতি নির্মল দাশগুপ্ত মন্টুদার বাসায় রাতের খাওয়া সারলাম। পটুয়াখালীতে আবদুল করিম মৃধা কলেজে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে শুরু করেছেন ওয়াহিদুল ভাই।
সবে শিক্ষার্থীদের শেখাতে গেছেন_ 'তোমার সুরের ধারা ঝরে/যেথায় তারি পারে' এবং 'মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে'। দ্বিতীয় গানটি শেখানোর সময় পটুয়াখালী প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকরা এসে হাজির। ওখানে যেতে হবে। দেড় ঘণ্টা পরে ওয়াহিদুল ভাই এসে আবার গান ধরলেন।
বরিশাল জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে অশ্বিনী কুমার হল মঞ্চে ওয়াহিদুল ভাই বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মতো কম্বুকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন, মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান। হলে পিনপতন স্তব্ধতা। শ্রোতা-দর্শক যেন মরণের সঙ্গে অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন করার জন্য ব্যাকুল। সেই আবৃত্তি এখনও শ্রুতিতে মধুবর্ষণ করে।
ওয়াহিদুল ভাই আমাকে মুকুন্দ দাসের গানের ভাণ্ডারি বলে ডাকতেন আবার কখনোবা সর্ববিদ্যাধর ওয়াহিদুল ভাই আমার আচরণে বিরক্ত হতেন কিন্তু কখনোই ভর্ৎসনা করতেন না।
সে রাতের কথা ভুলতে পারি না, চিটাগাংয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মুকুন্দ দাসের গা হয়ে হোটেল রাজে এসে শুয়ে পড়েছি। এমন সময় দরজায় করাঘাত। দরজা খুলতেই দেখি ওয়াহিদুল ভাই দাঁড়িয়ে। এসেই বললেন, আজি ঘুম নহে নিশি জাগরণ। লাগাতার গল্পগাথায় রাত কাবার।
শেষ দেখা কুমিল্লায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে। আমার স্ত্রী পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই বলেন, তাপু তুমি এসেছো? তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারলাম না, নাও এই কলাটা খাও। আমার স্ত্রী ওয়াহিদুল ভাইয়ের দেওয়া কলা প্রসাদ মনে করে ভক্তি ভরে খেয়েছে। কুমিল্লায় দেখলাম, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ওয়াহিদুল ভাইয়ের সিডি করেছে। শিরোনাম 'সকল কাঁটা ধন্য করে'। কুমিল্লার রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধক পরিমল দত্ত স্মারক গ্রন্থ ওয়াহিদুল ভাই আমাকে উপহার দিলেন। আমি কিছু লিখে দিতে বলায় ওয়াহিদুল ভাই বলেন, অটোগ্রাফ বিজনেস আমি করি না। অথচ ২২ বছর আগে ওয়াহিদুল ভাই আমাকে দ্বিপঞ্চাশতম খণ্ড স্বরবিতান উপহার দিয়ে লিখেছিলেন, অশেষ প্রত্যাশায়, চিরসবুজ মুকুলকে_ ওয়াহিদুল ভাই।
মুকুল দাস : বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments