কোপেনহেগেন সম্মেলন নিয়ে কিছু কথা by ড. তারেক শামসুর রেহমান
কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের শেষ দিনে একটি সমঝোতার কথা ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি জানিয়েছেন ভারত, চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে কোনো চুক্তি হয়নি। চুক্তি হবে আগামী ২০১০ সালের নভেম্বরে মেক্সিকো সম্মেলনে।
এ সমঝোতায় কার্বনডাই-অক্সাইড হ্রাসের ব্যাপারে কোনো আইনগত বাধ্য-বাধকতা থাকছে না। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো যাতে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে, সে জন্য তাদের অর্থের জোগান দেয়া হবে। মাত্র ৪টি দেশের সঙ্গে এই যে ‘সমঝোতা’, তা বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাস করতে কতটুকু সাহায্য করবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থাকবেই। এরই মধ্যে এ সমঝোতাকে ‘ব্যর্থ চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এ ‘সমঝোতা’ গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে গেল। এমনকি বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক থেকে দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার য়ে দাবি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো করেছিল, সে ব্যাপারেও কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চীনের কার্বন নিঃসরণ বাইরে থেকে আদৌ মনিটর করা হবে কিনা, সে ব্যাপারেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। কোপেনহেগেন সম্মেলন শেষ হলেও বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে স্পষ্টতই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেক প্রশ্নের জবাবও মেলেনি। ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য, তা রয়েই গেল।
বিশ্বের জলবায়ু সম্মেলন এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলন, যা কপ-১৫ (15th conference of the Parties) নামে পরিচিত স্থানীয় মিডিয়াসহ বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ১৮ ডিসেম্বরে শেষ হওয়া ওই সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে, তা হচ্ছে প্রতিবাদ ও জনসচেতনতা। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের বেলা সেন্টারের সম্মুখে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের হাতকড়া পরিয়ে বসিয়ে রাখার ছবিও ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। সম্ভবত ২০০৯ সালে কোথাও এতবড় সম্মেলন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের ১৯৩টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রায় ৪৫ হাজার প্রতিনিধি (সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে) এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশ, যেখানে ঘূর্ণিঝড়-আইলার আঘাতের ছয় মাস পর হাজার হাজার মানুষ এখনও বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী ৯২ জন প্রতিনিধি নিয়ে এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আর বেসরকারি পর্যায়ে কোপেনহেগেন গিয়েছিলেন বাংলাদেশের আরও প্রায় তিনশ’ প্রতিনিধি। এমনকি বেশ ক’টি সংবাদপত্রও তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিদের সেখানে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ এ সম্মেলনকে যে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছিল, ওটা তার বড় প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রী গত ২২ অক্টোবর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন (ইউরোপিয়ান ডেভেলপমেন্ট ডে, কমনওয়েলথ ও কপ ১৫)। প্রতিবারই তার সঙ্গে যে প্রতিনিধি দল গেছে, তার সংখ্যা অনেক, প্রায় শ’-এর কাছাকাছি। অথচ মনমোহন সিং কোপেনহেগেন গেলেন মাত্র ৮ জন কর্মকর্তা নিয়ে (আনন্দবাজার, ১৮ ডিসেম্বর)।
বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। যারা জন ভাইডালের সচিত্র প্রতিবেদনটি পড়েছেন ও দেখেছেন (গার্ডিয়ান, ৭ ডিসেম্বর ’০৯), তারা দেখেছেন কীভাবে হিমালয়ের গ্লেসিয়ারগুলো গলে যাচ্ছে। ভাইডাল তিনটি দেশ (নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ) সফর করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। বিশ্বের উষ্ণতা যদি কমানো না যায়, তাহলে হিমালয়ের থুলাগি গ্লেসিয়ারের মতো অনেক গ্লেসিয়ার গলে যাবে এবং এক সময় বিলিয়ন বিলিয়ন লিটার পানি নিচের দিকে নেমে এসে বন্যায় ভাসিয়ে দেবে ভারতের এক অংশ ও পুরো বাংলাদেশকে। এ মন্তব্য ভাইডালের। তাই সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ শঙ্কিত থাকবে। এ শঙ্কা বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে কোপেনহেগেনে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ক্ষতির সম্মুখীন বাংলাদেশ হবে, তা মোকাবিলার কোনো আর্থিক সঙ্গতি বাংলাদেশের নেই। নেই গরিব দেশগুলোরও। কিন্তু কোপেনহেগেনে যে অর্থের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এ নিয়ে সম্মেলনে বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। উপরন্তু গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোর যে প্রযুক্তি দরকার, গরিব দেশগুলোর কাছে সেই প্রযুক্তি নেই। এমনকি উন্নত বিশ্ব এ প্রযুক্তি যে উন্নয়নশীল বিশ্বে হস্তান্তর করবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না। অথচ কার্বনডাই-অক্সাইড হ্রাসের জন্য এ প্রযুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি বা গ্রিন এনার্জির কথা কেউ কেউ বলছেন বটে। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রক্রিয়াকে যদি গ্রিন এনার্জির আওতাভুক্ত করা হয়, তাহলে সেখানেও সমস্যা রয়েছে। শক্তিধর দেশগুলো কখনও চাইবে না উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হোক। একেকটি পারমাণবিক চুল্লির দাম বিলিয়ন ডলারের ওপরে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে ইউরেনিয়াম সরবরাহের প্রশ্নটি। ইরানের ‘অভিজ্ঞতা’ সবার জানা। সুতরাং পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সৌরবিদ্যুতের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। বায়ুবিদ্যুতের একটি সম্ভাবনা থাকলেও এটি ব্যয়বহুল, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সদ্যসমাপ্ত কোপেনহেগেন শীর্ষ সম্মেলনে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় একটি আলাদা ফান্ড গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো প্রস্তাব। কিন্তু সেই ফান্ড কবে গঠিত হবে কিংবা ফান্ড পরিচালনায় কিভাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে—এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং গেল ১৮ ডিসেম্বর কোপেনহেগেনে বিশ্বের উষ্ণতা কমানোর জন্য কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করার ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না হলেও আমাদের জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো সংবাদ কোপেনহেগেনে পাওয়া যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এবার আমাদের বাজেটে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর আগের বছরের অব্যবহৃত ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে মোট অর্থের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা। গেল বছরের ১০ সেপ্টেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘ইউকে-বাংলাদেশ ক্লাইমেট কনফারেন্স’-এ বাংলাদেশকে আগামী ৫ বছরের জন্য ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। গ্লোবাল এডাপটেশন ফান্ড নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ তার সদস্য। ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম সিস্টেমের শতকরা ২ ভাগ দিয়ে একটি ফান্ডও হবে। সব মিলিয়ে কিছু অর্থ পাওয়া গেছে বা যাবে; কিন্তু তারপরও যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে আইলার আঘাতের ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও কেন বেড়িবাঁধের ফাটল বন্ধ করা হলো না? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? জনগণের প্রতিনিধি হয়ে এ অঞ্চল থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদে, তারা কি সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন কখনও? আমার তা মনে হয় না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও সংসদের কাছে এর জবাব চাওয়া হয়নি। পার্শেমারি গ্রামের জনৈক নবীন সরদারের বক্তব্য, যখন একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয় (আমার দেশ, ২৭ নভেম্বর), তখন এর জবাব আমার কাছেও জানা নেই। গাবুরা, শ্যামনগর কিংবা পার্শেমারি গ্রামের মানুষরা জানে না কোপেনহেগেন সম্মেলনের কথা। জানে না মিটিগেশন বা গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোর কথা। জানে না অভিযোজন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার কথা। তারা বোঝে তাদের সরকার বাঁধ মেরামত করে দেবে, যাতে করে লবণ পানি আর ঢুকতে না পারে। ক’দিন আগে কুয়াকাটায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি মানববন্ধনের আয়োজন করেছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত ক্লাব ‘মেম্বার্স ফোরাম অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’। ১০ মিনিট স্থায়ী ওই মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন মাত্র ৮ জন সংসদ সদস্য! যেখানে মালদ্বীপের মন্ত্রিপরিষদ সাগরের নিচে ক্যাবিনেট মিটিং করেছে, যেখানে নেপাল হিমালয়ের পাদদেশে মন্ত্রিপরিষদের সভা করেছে, সেখানে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের এ উদ্যোগ খুব বেশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে ভালো হতো যদি মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাও এতে অংশ নিতেন। দুঃখ লাগে যখন দেখি একজন মন্ত্রীও সেখানে গেলেন না। প্রধানমন্ত্রী গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—জনসচেতনতা সৃষ্টি করা; কিন্তু এ জনসচেতনতা আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। সংবাদপত্রে খবর হয়েছে শত শত একরের গাছ কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। অর্থাত্ এখানে সচেতনতার অভাব রয়েছে। গণমাধ্যমগুলোকে আরও ব্যবহার করতে হবে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য।
কোপেনহেগেনে জলবায়ু সম্মেলন যখন চলছে তখন বিবিসির বাংলা বিভাগ গত ১২ ডিসেম্বর রাতে একটি সংবাদ প্রচার করেছে। এতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। ১৯৯০-২০০৯ সালের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি মেপে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। গবেষকদের ধারণা, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা আরও বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। এরই মধ্যে আরও যে দু’একটি গবেষণার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো আশার কথা বলে না। যেখানে বিশ্বে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তু হবেন। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আমাদের জানাচ্ছে, প্রতিদিনই মানুষ নদীভাঙন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে ঢাকায় এসে বস্তি গড়ছে। ঢাকায় মানুষ এখন ১ কোটি ৩০ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে বাস করেন ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ। একটি জাতীয় দৈনিক এ খবর পরিবেশন করে সম্ভাব্য একটি ‘ভয়াবহতা’র কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। নদীতে নিজের চাষ করা জমি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে নিজের বসতিটুকুও। সচ্ছল কৃষক পরিণত হয়েছেন বেকারে। কাজ নেই। খাদ্য কেনার পয়সা নেই। কোথাও কোথাও নোনা পানির কারণে চাষাবাদ করা যায় না। মত্স্যজীবীদের কেউ কেউ এখন পেশা ছেড়ে ঢাকায় রিকশা চালায়। এরা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে এদের টহরাবত্ংধষ ঘধঃঁত্ধষ চবত্ংড়হং হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে। বলেছে অন্যত্র, দেশের বাইরে এসব লোককে অভিবাসনের সুযোগ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে এবং ৪ কোটি লোক তাদের জীবিকা হারাবে। বিবিসির বাংলা বিভাগে সাক্ষাত্কার প্রচার হয়েছিল এমন সব ব্যক্তির, যারা জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকার বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন এই ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’দের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। কেননা এত বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুকে ঢাকা শহরে আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়। এরই মধ্যে ঢাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন ইউরোপিয়ান ডে সম্মেলনে (সুইডেন) যান, যখন কমনওয়েলথ ও কপ-১৫ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা তুলে ধরেন, তখন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ—ঝিনাইদহের ৮০টি ইটভাটার মধ্যে ৭০টিরই কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। প্রতিটি ভাটাতে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ কাঠ পুড়ছে। ইটভাটাগুলোয় স্তূপ করে রাখা কাঠের ছবিও ছাপা হয়েছে (আমার দেশ, ১৫ ডিসেম্বর)। অথচ প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ দিবসে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক কিংবা পুলিশ সুপারকে কেউ কি প্রশ্ন করবে তাদের দায়িত্বটি আসলে কী? আমার মতো যারা নিত্যদিন আমিনবাজার হয়ে সাভার রুটে যাতায়াত করেন, তাদের চোখে পড়বে ইটের ভাটা থেকে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এই কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। এটি দেখার দায়িত্ব কার? পরিবেশ অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিরা যদি ‘বিদেশ সম্মেলনে’ অংশ নেয়ার জন্য ব্যস্ত থাকেন তাহলে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে দেশটিকে রক্ষা করবে কে? প্রধানমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী মহোদয় কিংবা সচিব মহোদয় বার বার আমাদের দুরবস্থার কথা বিশ্ববাসীকে জানাবেন, অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করবেন। তাতে করে কি বাংলাদেশকে বাঁচানো যাবে? লোকবল নেই—এ কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। আমরা পরিবেশগত ‘ওয়াচ-লিস্টে’ আছি। কোপেনহেগেন সম্মেলনে বান কি মুন ও পদত্যাগকারী কপ-১৫ প্রধান কনি হেডেগার্ডের বক্তব্যে বাংলাদেশের নাম এসেছে। বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আছে; কিন্তু আমরা যদি আমিনবাজারের ইটের ভাটার কালো ধোঁয়া বন্ধ করতে না পারি, যদি বৃক্ষ কর্তনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারি, তাহলে বিশ্ববাসী এক সময় আমাদের বলবে—আমাদের দেশে সুশাসন নেই। টাকা দিলেও সে টাকা দিয়ে পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। আমাদের জন্য তা হবে লজ্জার। আমি খুব আশ্চর্য হইনি যখন বিবিসির বাংলা বিভাগ কোপেনহেগেন সম্মেলন প্রাক্কালে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত রায়েনদা, দাকোপ, আর মংলার মানুষদের অনুভূতি তুলে ধরেছিল এবং তারা বলছিলেন সরকারের নির্লিপ্ততার কথা। উপস্থাপক প্রশ্নই করেছিলেন এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও, গত ছয় মাসে একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য এর জবাবে যা বলেছেন (‘কাজ শুরু হবে। টেন্ডার ডাকা হয়েছে’), আমার মনে হয় না তাতে ওই অঞ্চলের মানুষ খুশি হয়েছে। গত ছয় মাসে কোনো মন্ত্রী কি আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দেখতে গিয়েছিলেন? তাদের তো এবার ঈদ হয়নি। সেখানে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ পিপিটি। ধান চাষ বোধকরি কোনো দিনই হবে না। বিডি নিউজ আমাদের জানাচ্ছে, আন্দারমানিক নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। এক ভয়াবহ দিনের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, যখন আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ অঞ্চল বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে গবেষণা হচ্ছে; কিন্তু নেই কোনো উদ্যোগ। সরকার শুধু অর্থ সংগ্রহের আশায় তত্পর। এর প্রয়োজন আছে; কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে যদি সরকার শক্তিশালী না হয়, তাহলে আগামীতে আমরা ‘জলবায়ু ন্যায়বিচার’ কিংবা ক্ষতিপূরণ পেলেও বড় ধরনের বিপর্যয়ের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো যাবে না। সংবাদপত্রে দেখলাম কোপেনহেগেন সম্মেলন উপলক্ষে এত বিপুলসংখ্যক লোকের (সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ) কোপেনহেগেনে উপস্থিতির ফলে ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরিত হয়েছে (টাইমস)। শুধু বেলা সেন্টারকে (যেখানে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে) সুসজ্জিত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যয় হয়েছে ১২২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাত্ বাংলাদেশী টাকায় ৮৪ হাজার ১৪০ লাখ টাকা। ভিভিআইপিদের থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা। এ টাকা দিয়ে বাংলাদেশে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করা সম্ভব ছিল। কিংবা মালিতে মরুকরণ প্রবণতা রোধ করার ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব ছিল। কোপেনহেগেন সম্মেলন শেষ হয়েছে। এখন আমরা অপেক্ষা করব ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত মেক্সিকো সম্মেলনের জন্য। যে টাকা পাওয়া গেছে বা আগ?
No comments