আমার দেশ সম্পাদককে দেখে নেয়ার হুমকিঃ ফ্যাসিবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী
আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রথমসারির তিন নেতা ‘নতুন ইতিহাস’ সৃষ্টি করেছেন বলে যারা ভাবছেন, তারা হয়তো জানেন না যে ‘নব আবিষ্কার’ হলেও এটাই আওয়ামী লীগের ‘অতি পুরাতন ভাব'।
দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের জন্য স্টেজে নির্ধারিত চেয়ার সরিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে যার অঙ্কুরোদগম, তত্কালীন ন্যাপ নেতা সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে মুকুল সিনেমা হলের সম্মেলনে যার পুষ্টিসাধন, বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ, সেই ‘ভাব’-এর ঘোর এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলেই বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ মাহমুদুর রহমানকে কদর্য ভাষায় হুমকি দিয়েও স্বাভাবিক থাকতে পেরেছেন। মাহমুদুর রহমানের অপরাধ, তিনি আমার দেশ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং এ পত্রিকায় ১৭ ডিসেম্বর কোনোরকম মন্তব্য অথবা বিশ্লেষণ ছাড়া হার্ড নিউজ হিসেবে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। ‘তৌফিক এলাহী ও জয়ের বিরুদ্ধে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নেয়ার অভিযোগ’ শিরোনামে পরিবেশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জনৈক আবু সিদ্দিকী পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে পেট্রোবাংলার প্যাডে সই করে একটি অভিযোগপত্র সরাসরি প্রধানমন্ত্রী বরাবর পেশ করেন। ওই অভিযোগপত্রে মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৫ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে ৩৭০ কোটি টাকার কাজ দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। অভিযোগটি গুরুতর। কারণ এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার (অব.) এনামুল হক, এ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোহসিন এবং পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোক্তাদির আলীর নাম জড়িত আছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে অভিযোগপত্রে উত্থাপিত অভিযোগের বর্ণনা এবং অভিযোগপত্রটিকে কেন্দ্র করে মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার মধ্যে চিঠি চালাচালির বিবরণ ছাড়া আর কিছুই নেই। এ ধরনের অভিযোগপত্রের অস্তিত্ব না থাকলে এবং চিঠি চালাচালির কোনো ঘটনা না ঘটলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অথবা পেট্রোবাংলা খবরটি প্রত্যাখ্যান করে একটি শক্ত প্রতিবাদলিপি দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের একনম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ এবং প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক যে ঢংয়ে মাহমুদুর রহমানকে দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন, তাতে তাদের জাত চেনাতে সুবিধা হলেও সেটি গণতন্ত্রের পরিচিত ভঙ্গি ছিল না।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় অবশ্য এ ব্যাপারে একটি প্রতিবাদলিপি দিয়েছে এবং আমার দেশ-এর ১৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় তা হুবহু ছাপা হয়েছে। তাতে প্রতিবেদনের মূল অংশের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হচ্ছে, ‘...পত্রিকার প্রতিবেদনে যে অভিযোগপত্রের উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে মন্ত্রণালয় থেকে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে যে, পত্রটি বেনামি এবং আবু সিদ্দিকী কথিত অভিযোগটি উত্থাপন করেননি।’ বেশ কথা। মন্ত্রণালয় একটি অভিযোগপত্রের অস্তিত্ব কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছে। এ নিয়ে চিঠি চালাচালি সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদলিপিতে একটা শব্দও নেই। এই প্রেক্ষাপটে আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের কোন অংশটি ‘মিথ্যা, বানোয়াট, ষড়যন্ত্রমূলক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ তা আমরা বুঝতে অক্ষম।
এ পটভূমিতে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, আমার দেশ সততার সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও আমরা সত্ সাংবাদিকতা থেকে একচুলও বিচ্যুত হইনি। যে কোনো ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হলে আমরা সেটা প্রকাশ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এতে কে খুশি হলো অথবা কে লগি-বৈঠা নিয়ে তেড়ে আসল তার দ্বারা প্রভাবিত হলে সত্ সাংবাদিকতা অসম্ভব। সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের যে কোনো চেষ্টা ফ্যাসিবাদী চরিত্রের লক্ষণ। ফ্যাসিবাদ যুগে যুগে বহুমতের সহাবস্থানকে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ফ্যাসিবাদকে মেনে নিতে হয়েছে চরম পরাজয়। তাই আমার দেশ-এর কলমের কালিকে লগি-বৈঠা অথবা বোমা-বুলেটের চেয়ে কমজোরি ভেবে আজ যারা পেশি-আস্ফাালন করছেন, তারা যদি চরিত্র পাল্টাতে সক্ষম না হন তবে তাদের পরিণতিও শুভ হবে বলে মনে হয় না।
No comments