চরাচর-ট্রেনের কামরায় বাউল সুর by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
ট্রেনের কামরায় হঠাৎই একটি বাউলকণ্ঠ ভেসে আসতে থাকে। এ যেন বাউল সুরের মধুর গান! কোলাহল আর ব্যস্ততার মাঝে যাত্রীদের কেউ তাঁর গান শোনেন, কেউ বা শোনেন না। কেউ কেউ আবার কাছে ডেকে গান শুনে সাধ্যমতো নোট গুঁজে দেন তাঁর হাতে। কেউ কেউ আবার বিরক্তও হন। ট্রেনের কামরার ব্যস্ত কোলাহলের মধ্যে হঠাৎ বাউল সুরের মধুর গান আকাশ-সংস্কৃতির চাপে মার খাওয়া আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি অংশ যেন এভাবেই অবহেলায় এগিয়ে যায়।
বছরের পর বছর ধরে এভাবেই ঢাকা বা চট্টগ্রামগামী আন্তনগর ট্রেনগুলোর কামরায় গান শুনিয়ে যাওয়া এই গানওয়ালা মানুষটির নাম আবদুর নুর। ডাকনাম নুর মিয়া। গান নিয়ে বিরামহীন প্রতিদিনের ছুটে চলা তাঁর। হবিগঞ্জের লাখাই থানার করাব ইউনিয়নের নুনিপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। তিনি ৩০-৩৫ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তাঁর পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। স্ত্রীও পছন্দ করেন এ বিষয়টি। সিলেট-ঢাকা বা সিলেট-চট্টগ্রাম রেলরুটের হবিগঞ্জ জেলার যে কয়েকটি স্টেশন পড়ে, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে নুর মিয়ার বাউল গান। নুর মিয়ার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বয়স বেড়ে গেলেও এখনো গান গাইতে ক্লান্ত হন না। বাবা আবু তালিবের কাছ থেকেই শিখেছেন গান গাওয়া। পাঁচ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই শুধু গান করেন। দিনব্যাপী বিভিন্ন আন্তনগর ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের গান শুনিয়ে আনন্দ দেন_নিজেও তৃপ্তি লাভ করেন। নুর মিয়া বলেন, 'সকাল ৬টায় বের হই। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। ঢাকা-সিলেটগামী জয়ন্তিকা ও পারাবত ট্রেনেই গান করি। দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। কখনো কখনো দিনরাতও গান করতে হয়।' তিনি আরো বলেন, "যাত্রীদের অনুরোধে রাধারমণ, আবদুল করিম, আমির উদ্দিন, দুরবি্বন শাহের গান শুনাইতে হয়। বাউল গান গাইতেই আমার ভালা লাগে। 'গ্রামের নওজোয়ান', 'মায়া লাগাইছে', 'কী অবলা নারী', 'বসন্ত বাতাসে', 'আবার যে দেখা হবে'_এই গানগুলান বারবার গাইতে হয়।" তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জয়ন্তিকা ট্রেনের যাত্রী তনুশ্রী তনু বলেন, 'নুর মিয়ার গান খুব ভালো লেগেছে। অবহেলায় পড়ে থাকে, এমন নুর মিয়াদের খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করা দরকার। তাঁরাই আমাদের সংস্কৃতির একটি ধারাকে হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখছেন।' ট্রেনের কামরার কোলাহলের মাঝে হঠাৎই নুর মিয়ার সঙ্গে আলাপ। বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না_এ অনুভূতিগুলোর সাঁকো প্রতিদিন পেরোতে হয় তাঁকে। ঘরে চাল-ডালের হাহাকার বুকে চেপে শুধুই মাটির টানে বাংলার পথে-প্রান্তরে নুর মিয়ার মতো গানওয়ালাদের এই জয়যাত্রা। সংস্কৃতির এমন দারিদ্র্যপীড়িত একনিষ্ঠ কর্মীদের নাম কয়জনই বা মনে রাখেন? এই নুর মিয়ারা এভাবেই উঠে আসেন ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহারে একসময় হয়তো কেউ আর নুর মিয়াদের গান শুনতে আগ্রহী হবেন না। তার পরও নুর মিয়ারা বাদ্যযন্ত্র হাতে প্রতিদিনের মতো আসবেন ঠিকই। ধরবেন গান প্রাণখুলে_'ভাইরে রাধারমণ বলে...'।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
No comments