শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য-রাজনীতির অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হোক
এ দেশে শিক্ষার মান যে কতটা নিচে নেমে গেছে, তা সমাজ-সচেতন কারোই অজানা নয়। শিক্ষাকে পণ্য করার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাপনা আজ দুর্নীতিতে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে যে সেখান থেকে একে টেনে তোলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি আরো খারাপ করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাজনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্তি।
গত বুধবার শিক্ষাসংক্রান্ত বেসরকারি সংগঠনগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত 'ভর্তি বাণিজ্য : জনতার সংলাপ' শীর্ষক আলোচনায় এর সামান্য চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখা এবং ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি নিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছে, তারই কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে গতকাল বৃহস্পতিবারের কালের কণ্ঠে প্রকাশিত 'অবৈধভাবে এমপিওভুক্ত ২৯১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান' শীর্ষক খবর থেকে। কয়েক বছর আগে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের ২২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের সহায়তায় জালিয়াতি করে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে না জানিয়েই এসব প্রতিষ্ঠানের স্তর (কোড) পরিবর্তন করে মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত করা হয়। একইভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকা ৭১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জালিয়াতির মাধ্যমে ডিগ্রি পর্যন্ত এমপিওভুক্ত করা হয়। এসব দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হয় দুই কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার ৭০০ টাকা। অবৈধ এমপিওভুক্তির পাশাপাশি আবার এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা এমপিওভুক্তির বৈধ দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কারণে বছরের পর বছর তা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত এই মাউশিকে নিয়ে এর আগে পত্রপত্রিকায় বহু খবর প্রকাশিত হয়েছে। সারা দেশ থেকে আসা শিক্ষকদের এখানে কী ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়, তাও আজ আর অজানা নয়। এর আগে বহুবার ঘোষণা দেওয়া হলেও মাউশির দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি; বরং বলা যায়, উত্তরোত্তর তা বেড়েই চলেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি দুষ্ট ক্ষত হচ্ছে শিক্ষাকে পণ্য করা ফেলা। স্বাভাবিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতোই এখানে স্কুল গড়ে উঠছে। ব্যবসায়ীরা যেমন সুযোগ পেলেই যেকোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, ক্রেতাদের পকেট কাটে, ঠিক একই অবস্থা চলছে বেসরকারি স্কুল নামক ব্যবসায়িক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এমপিওভুক্ত এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থ পাওয়ার পরও ভর্তি-বাণিজ্যের মাধ্যমে অভিভাবকদের পকেট কাটছে, লাখ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে। এসব স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা। সাধারণ অভিভাবকরা তাই এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিবাদও করতে পারেন না। যাঁদের সক্ষমতা কম, তাঁরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিযোগ আছে, শুধু ভর্তি-বাণিজ্য নয়, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে এসব প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটি বড় অংশই চলে যায় ওইসব প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের পকেটে। বিনিময়ে তাঁরা স্কুলের সব অন্যায় আচরণকে 'প্রটেকশন' দিয়ে যান।
বর্তমান সরকারের যে কয়জন মন্ত্রী নিজ নিজ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের অন্যতম। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নষ্ট রাজনীতি ও দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপনার কাছে তিনিও একপ্রকার অসহায়। এমপিওভুক্তির বিষয়টি নিয়ে গতকাল তিনি মাউশি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৈধ দাবিদারদের এমপিও প্রদানে বিলম্বের বিষয়টিও তারা খতিয়ে দেখবে। যা হোক, আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজিত এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবিলম্বে অবসান চাই।
No comments