আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬০)-স্বাধিকার অর্জনই ছিল লক্ষ্য by আলী যাকের
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলি চলছে। বাঙালি অবলীলায় প্রাণ দিচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। সংলাপের নামে পাকিস্তানিরা এক প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করলেন যে পাকিস্তানিরা সহজে কোনো বোঝাপড়ায় আসবে না। ওদিকে ছাত্রজনতার রুদ্ররোষ বেড়েই চলেছে।
আমরা ক্রমেই উত্তেজিত হচ্ছি। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ ভাষা শহীদ মিনারে প্রতি সন্ধ্যায় সংগীত, নৃত্য ও নাটকের অনুষ্ঠান চালিয়ে গেছে। এসব সাংস্কৃতিক সমাবেশে নানা রকম দেশাত্মবোধক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। আমরা পাঁচ-ছয় বন্ধু তখন শহীদ মিনারের ঠিক উল্টো দিকে আমাদের পুরনো আড্ডাস্থল বেনুর ঘরে সমবেত হতাম, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজিত কথাবার্তা হতো। মাঝেমধ্যে শহীদ মিনারে এসে অনুষ্ঠান দেখতাম। সারা বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতার দাবিতে এক চরম উত্তেজনা বিদ্যমান, লোকের মুখে মুখে যখন নানা ধরনের জাতীয় স্লোগান চলছে, তখন ১৯৭১-এর ৭ মার্চ অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে কয়েক লাখ মানুষের সামনে হাজির হলেন। আমরা ১০-১১ জন বন্ধু হৈহৈ করতে করতে রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। আমাদের মধ্যে অনেক বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী তরুণের ধারণা ছিল যে শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপসরফা করবেন এবং স্বাধীনতার কথা বলবেন না। তাদের এই শঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে বঙ্গবন্ধু বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে আমার জানামতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ওই বক্তৃতা একটি শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবে। অল্প কয়েকটি বাক্যে তখনকার গোটা পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি তাঁর চরম সিদ্ধান্তের কথা দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন।
আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাক্যহীন হয়ে পড়লাম। কয়েক মুহূর্তমাত্র...। রেসকোর্সের সব মানুষ ফেটে পড়ল স্লোগানে স্লোগানে। আমরা বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ পেলাম যেন।
ঠিক একই অনুভূতি আরো আগে ১৯৭০ সালেও আমাকে উদ্বেলিত করেছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর সারা রাত ধরে ফল ঘোষণা করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে একটির পর একটি আসনে যখন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করতে থাকে, তখন আমরা, তরুণরা উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠেছিলাম_যেন দেশ স্বাধীন হয়েই গেছে। সেই রাত শেষে ভোরের আলো যখন ফুটল, আমরা সবাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের রাত কেটেছিল আমাদের এক বড় ভাইয়ের বাড়িতে, ধানমণ্ডি এলাকায়। ধানমণ্ডির ২ নম্বর সড়ক দিয়ে মিরপুর সড়কের দিকে হাঁটছি আর সমস্বরে গান ধরেছি_'একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী।' কোথা থেকে যেন একটা বাতাস এসে আমাদের গানের বাণীগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে, 'স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়।' আবার ওই বাতাসেই শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি যেন নেমে গিয়েছিল সেই ভোরে। হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এত সহজে কি বাঙালি পাবে তাদের স্বাধীনতা?
যা হোক, ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে দিল_কোন পথে এগোতে হবে এবং কী করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তো স্পষ্টতই বলে দিলেন, 'তোমাদের যার যা আছে, তা-ই নিয়ে, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো।' তিনি বলেছিলেন, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।' এ সবই সম্মুখ সমরের আহ্বান ছাড়া আর কী? আমার এক দুলাভাই ১৯৭০-এর নির্বাচনে গোপালগঞ্জ থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর কাছে যেতাম নানা খবরের আশায়। কিন্তু তখনো বঙ্গবন্ধু হাল ছেড়ে দেননি। গণতান্ত্রিক এক নেতা তিনি। গণতান্ত্রিক পন্থায় সব সমস্যার সমাধান করাকেই সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে চিন্তা করতেন। তিনি ভেবেছিলেন, যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ছয় দফার ভিত্তিতে একটা সমঝোতায় পেঁৗছানো যায়, তাহলে হয়তো রক্তক্ষরণ ঠেকানো যাবে। তিনি জানতেন যে পাকিস্তানি যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জন বড় সহজ হবে না।
এতে আমাদের বিস্তর মানুষ মারা পড়বে, তাদের নারীদের সম্মানহানি হবে এবং সম্পত্তি বিনষ্ট হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। এবং সেই কারণেই অতি সাবধানে তিনি সামনে এগোতে চেয়েছিলেন। এ কথা ভুললে চলবে না যে মাও সে তুং কিংবা লেনিনের মতো তিনি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে জানতেন না। তাঁর আদর্শ ছিল বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক নেতাদের। তিনি সম্মান করতেন মহাত্মা গান্ধীকে, টমাস জেফারসনকে। অতএব শান্তির পথে স্বাধিকার অর্জনই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
মার্চের ওই উত্তাল দিনগুলোতে আমি লক্ষ করেছি, আমাদের দু-চারজন চৌকস বাঙালি সামরিক অফিসার নিত্যই আমার দুলাভাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য যোগাযোগ করতেন। এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে যাঁর নাম মনে আসছে তিনি মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আর্মির একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। তিনি পাকিস্তানিদের মানসিকতা বুঝতেন। এবং সেই সময় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন বাঙালিদের ওপরে পাকিস্তানিদের অবধারিতভাবে নির্মম আক্রমণের উৎকণ্ঠায়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে সঠিকভাবে বলা সম্ভব ছিল না, আসলেই কী হতে যাচ্ছে।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাক্যহীন হয়ে পড়লাম। কয়েক মুহূর্তমাত্র...। রেসকোর্সের সব মানুষ ফেটে পড়ল স্লোগানে স্লোগানে। আমরা বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ পেলাম যেন।
ঠিক একই অনুভূতি আরো আগে ১৯৭০ সালেও আমাকে উদ্বেলিত করেছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর সারা রাত ধরে ফল ঘোষণা করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে একটির পর একটি আসনে যখন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করতে থাকে, তখন আমরা, তরুণরা উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠেছিলাম_যেন দেশ স্বাধীন হয়েই গেছে। সেই রাত শেষে ভোরের আলো যখন ফুটল, আমরা সবাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের রাত কেটেছিল আমাদের এক বড় ভাইয়ের বাড়িতে, ধানমণ্ডি এলাকায়। ধানমণ্ডির ২ নম্বর সড়ক দিয়ে মিরপুর সড়কের দিকে হাঁটছি আর সমস্বরে গান ধরেছি_'একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী।' কোথা থেকে যেন একটা বাতাস এসে আমাদের গানের বাণীগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে, 'স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়।' আবার ওই বাতাসেই শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি যেন নেমে গিয়েছিল সেই ভোরে। হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এত সহজে কি বাঙালি পাবে তাদের স্বাধীনতা?
যা হোক, ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে দিল_কোন পথে এগোতে হবে এবং কী করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তো স্পষ্টতই বলে দিলেন, 'তোমাদের যার যা আছে, তা-ই নিয়ে, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো।' তিনি বলেছিলেন, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।' এ সবই সম্মুখ সমরের আহ্বান ছাড়া আর কী? আমার এক দুলাভাই ১৯৭০-এর নির্বাচনে গোপালগঞ্জ থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর কাছে যেতাম নানা খবরের আশায়। কিন্তু তখনো বঙ্গবন্ধু হাল ছেড়ে দেননি। গণতান্ত্রিক এক নেতা তিনি। গণতান্ত্রিক পন্থায় সব সমস্যার সমাধান করাকেই সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে চিন্তা করতেন। তিনি ভেবেছিলেন, যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ছয় দফার ভিত্তিতে একটা সমঝোতায় পেঁৗছানো যায়, তাহলে হয়তো রক্তক্ষরণ ঠেকানো যাবে। তিনি জানতেন যে পাকিস্তানি যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জন বড় সহজ হবে না।
এতে আমাদের বিস্তর মানুষ মারা পড়বে, তাদের নারীদের সম্মানহানি হবে এবং সম্পত্তি বিনষ্ট হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। এবং সেই কারণেই অতি সাবধানে তিনি সামনে এগোতে চেয়েছিলেন। এ কথা ভুললে চলবে না যে মাও সে তুং কিংবা লেনিনের মতো তিনি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে জানতেন না। তাঁর আদর্শ ছিল বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক নেতাদের। তিনি সম্মান করতেন মহাত্মা গান্ধীকে, টমাস জেফারসনকে। অতএব শান্তির পথে স্বাধিকার অর্জনই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
মার্চের ওই উত্তাল দিনগুলোতে আমি লক্ষ করেছি, আমাদের দু-চারজন চৌকস বাঙালি সামরিক অফিসার নিত্যই আমার দুলাভাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য যোগাযোগ করতেন। এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে যাঁর নাম মনে আসছে তিনি মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আর্মির একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। তিনি পাকিস্তানিদের মানসিকতা বুঝতেন। এবং সেই সময় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন বাঙালিদের ওপরে পাকিস্তানিদের অবধারিতভাবে নির্মম আক্রমণের উৎকণ্ঠায়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে সঠিকভাবে বলা সম্ভব ছিল না, আসলেই কী হতে যাচ্ছে।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments