আইভীর জয়-রাজনীতিবিদেরা যখন ব্যর্থ হন by ফারুক ওয়াসিফ

নারায়ণগঞ্জে রাজনীতিক আইভী বিজয়ী হননি, বিজয়ী হয়েছে সমাজ। আর ব্যর্থ হয়েছে বাইরে থেকে দুর্বৃত্ত ও লুটেরা রাজনৈতিক শক্তি। বললে হয়তো অতিশয়োক্তি শোনাবে, লক্ষণের দিক থেকে এ ঘটনা আমাদের মিনি আরব-জাগরণ।
রাজনীতিবিদেরা নিজেদের তৈরি সমস্যার সমাধানে যখন ব্যর্থ, তখন সাধারণ মানুষই এগিয়ে এসে তা মিটিয়ে দিয়ে নিজেরা বেঁচেছেন, রাজনীতিবিদদেরও কিছুটা বাঁচিয়েছেন।


নির্বাচন কমিশনের সমস্যা ছিল সেনা প্রহরায় সুষ্ঠু নির্বাচন করানো, সরকারের সমস্যা ছিল নির্বাচনকে সুষ্ঠুও দেখানো আবার জয়ের ঝোল নিজেদের দিকে টানানো। বিএনপির চাওয়া ছিল নির্বাচন কমিশন এবং সরকার-সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান উভয়কেই ব্যর্থ দেখানো। কিন্তু রাজনীতির এক্স ফ্যাক্টর জনগণ সবার হিসাবকেই কিছুটা নিকাশ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ডাকে সরকার সাড়া দেয়নি, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী জেতেননি আবার নির্বাচনও আস্থা হারায়নি। মাঝখান দিয়ে জিতে গেলেন জনসমর্থিত আইভী। তাই বলা, নির্বাচনে যিনি জিতেছেন তিনি জনতার মনের মানুষ। এই মানুষ এখন জনতার মনেই থাকবেন, না দলের অলংকার হবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এই নির্বাচনের আসল অর্জন হলো তৃণমূলীয় গণতন্ত্রের, অর্থাৎ আমজনতার গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রকাশের। সেই তৃণমূল গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো গণসমাজ। গত এক মাসের ঘটনাবলি এই গণসমাজের আড়মোড়া ভেঙে জাগার আঞ্চলিক ইতিহাস। আঞ্চলিক হলেও এর তাৎপর্য যে জাতীয়, তা বিভিন্ন ঘটন-অঘটনের পর এখন সবার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এর আন্তর্জাতিক তাৎপর্যটাও আমলে নেওয়া দরকার।
নারায়ণগঞ্জে দেখলাম এক সামাজিক প্রতিবাদ, ক্ষমতার সামনে হক কথা বলার সাহস। এর রাজনৈতিক তাৎপর্যকে প্রচলিত ডান-বাম লাইনে ফেলা যায় না। একে দেখতে হয় দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সরকারি উপেক্ষার বিপরীতে সমাজের আলোড়ন হিসেবে। নারায়ণগঞ্জের পথঘাট ও লোকালয় হয়ে উঠেছিল আমাদের তাহরির স্কয়ার। কানসাট-শনির আখড়া-ফুলবাড়ী-আড়িয়ল বিলের মতো করেই সমাজশক্তি নিজের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এই আইনি পথ যদি বন্ধ হতো, অর্থাৎ গণরায় প্রকাশের মুখে কোনো না কোনোভাবে ছিপি লাগানো হতো, তাহলে আমরা হয়তো নারায়ণগঞ্জবাসীর সামাজিক প্রতিরোধের পুরো চেহারাটা দেখতে পেতাম। যেদিন সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে না বলে জানা গেল, যেদিন শামীম ওসমানের হালুম-হুলুমের আলামতও দেখা গেল, সেদিন নারায়ণগঞ্জে গুজব রটেছিল, নির্বাচন বানচাল হলে অবরোধ শুরু হয়ে যাবে। অর্থাৎ, মানুষ তৈরি ছিল। এই জাগ্রত সমাজশক্তিকে বাতিল করা সহজ হতো না কারও জন্য। বড়জোর এ থেকে বিভিন্ন পক্ষ ফায়দাই তুলতে পারেন। যাঁরা বড় ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন চান, তাঁদের এখান থেকে শেখার আছে।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই সমাজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমাজ—এ-ই ছিল আমাদের রাজনীতির ব্যাকরণ। প্রতিরোধ-বিদ্রোহ-আন্দোলনগুলো পেশা বা শ্রেণীর আকারের থেকে সামাজিক আকারে প্রকাশিত হয়েছে বেশি। এ ধরনের আন্দোলনই বারবার বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছে। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ আহমেদ কামালের স্টেট অ্যাগেইনস্ট দ্য নেশন নামের বইটিতে ইতিহাসের এ শিক্ষাটা ধরা আছে। বইটির নামের মধ্যেই কমিউনিটি সমাজের সঙ্গে ওপর থেকে জেঁকে বসা রাষ্ট্রের বিরোধের ইঙ্গিত। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের মূল বৈশিষ্ট্যটাও ছিল সমাজের সর্বাত্মক অসহযোগ থেকে প্রতিরোধ। এই শিক্ষা এখনো আমাদের মনে রাখা দরকার। যেখানে বড় দলগুলো ব্যর্থ, সেখানে তারা এগিয়ে আসতে প্রস্তুত।
পশ্চিমা দুনিয়ার মতো আমাদের দেশের মানুষ এখনো অতটা ব্যক্তিবাদী ও বিচ্ছিন্ন নয়। অনেক জায়গাতেই মানুষ যা-ই করে, এলাকা ও পাড়াপড়শির সঙ্গে মিলে করার চেষ্টা করে। সড়ক ও সাঁকো বানানো থেকে শুরু করে বংশে বংশে বা গ্রামে গ্রামে মারামারি পর্যন্ত এতটা সামাজিক এ দেশে। এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে এখনো গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষের সমাজ ধুকপুক করছে। বস্তির সম্পর্ক বলেন, এলাকার প্রতিবেশিতা বলেন, সমাজের এজমালি স্বার্থ বলেন—মানুষ মিলবার মঞ্চ খুঁজে নেবেই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারা গুটিয়ে যায় সত্য, অপশক্তির দাপটে সমাজশক্তি কখনো কিছুটা অবশ হয় বটে, আবার মোক্ষম মুহূর্তে তারা তাদের অস্তিত্ব জানানও দেয়। কানসাট-ফুলবাড়ী-শনির আখড়া-আড়িয়ল বিলের ঘটনাগুলো ছিল দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে উঠে দাঁড়ানোর নজির। নারায়ণগঞ্জের সামাজিক আলোড়ন সেই অস্তিত্বেরই নিয়মতান্ত্রিক প্রকাশ। তারা দেয়ালটাকে ভাঙতে যায়নি; কিন্তু সেটিকে কমজোরি করার, দূরে সরানোর চেষ্টা করেছে।
এই সফলতা তৃণমূল থেকে গণতন্ত্র বিকাশের রাস্তাও দেখাল। দেখাল, বড় রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সমাজকে কোণঠাসা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, সমাজের মানুষ তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আগ্রহী। যে দল ও নেতা সমাজকে ভিত্তি করবেন, মানুষ তাদের পাশে লড়তে রাজি। তাই দলীয় মনোনয়ন এবং সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা-ছায়া চেয়ে না পেয়েও আইভী বলতে পারেন, ‘জনতাই আমার সেনাবাহিনী।’
অন্যদিকে, একই দলের মধ্যে আমরা পেলাম দুই ধরনের নেতার মডেল। একজন ধনী, দাপুটে ক্ষমতা-সমর্থিত; অন্যজন মধ্যবিত্ত বিনয়ী, কৌশলী ও সমাজ-সমর্থিত। অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশের মানুষ শক্তের ভক্ত, দুর্নীতি থেকে সুবিধা নেওয়ার প্রয়াসী, তাই খারাপ লোকেরাই ভোটে জেতেন আর ভালো লোকেরা হারেন। কথাটা পুরো মিছা নয়। যখন যেভাবে বাঁচা যায়, মানুষ তা-ই করবে। কিন্তু নিজের বুদ্ধি-বিবেকমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁরা হারান না। তার বরাতেই নারায়ণগঞ্জের সাধারণ ভোটাররা যে আইভী আওয়ামী লীগের তাঁকে নয়, যে আইভী জনতার, তাঁকেই জয়ী করেছেন। আইভী এটা বুঝলে তাঁরও মঙ্গল, জনগণেরও মঙ্গল।
পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের নাগরিক মহল, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের প্রয়োজন সন্ত্রাস-দখলদারি ও মাফিয়াবৃত্তির বিরুদ্ধে তাঁদের জোটবন্ধনকে আলগা হতে না দেওয়া। পুকুরখেকো কচুরিপানা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণনজরদারিকেও তাই শিথিল হলে চলে না। ছাত্র-তরুণেরা এখনো এক মজুদ শুভশক্তি, তাদের নিয়ে দুর্নীতি-অপশাসন-লুটেরাবাজির পাহাড় ডিঙানো সম্ভব। এই তরুণেরা সেই নদী, যা ভবিষ্যতের দিকে দেশকে বয়ে নেবে। আর প্রবীণদের হতে হবে সেই নদীর শক্ত পাড়। আশা করি, আইভী নারায়ণগঞ্জের তরুণসমাজের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন এবং মেয়রের ক্ষমতা শুধু নয়, তাঁর জনসমর্থনের বলে এলাকার শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে জনমুখী করবেন। জনমানুষের এ অর্জনটি যেন ক্ষমতার বেদিতে বলি না দেন।
আবারও বলি, রাজনীতিবিদেরা যদি ব্যর্থ হন, জনগণকে, জনসমাজকে সুযোগ দিন। নইলে এই দুর্বল গণতন্ত্র অক্সিজেনবিহীন হয়ে পড়তে পারে!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.