নিবিষ্ট পাঠকের সঙ্গে রবীন্দ্র-পরিক্রমা by আবুল মোমেন
বাঙালিজীবনের অনেকটাজুড়েই আবেগ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়েই আছে। ফলে মননচর্চায় পিছিয়ে পড়ছি আমরা। কোনো বিষয় তলিয়ে দেখা, গভীরভাবে বিচার করা, প্রয়োজনে তত্ত্বের সহযোগিতা নিয়ে মূল্যায়ন করা—এসবে অনাগ্রহ, দুর্বলতা চোখে পড়ে। পঠনপাঠনেও গভীরতা ও ব্যাপ্তি উভয়ই কমছে।
অধীত বিদ্যার ভান্ডার থেকে নানা মণিমুক্তার সদ্ব্যবহার করে প্রবন্ধের ধার ও দর বাড়ানোর ক্ষমতার প্রকাশ তেমন চোখে পড়ছে কই। সবাই যেন রেফারেন্সবিহীন—তাৎক্ষণিক বিচ্ছিন্ন নিরাবলম্ব। এ কোন সংস্কৃতির ফসল বলা মুশকিল।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়ে ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের মনে হয়েছিল, এ এক শীর্ষ সংস্কৃতির ফসল। সার্ধশত বর্ষে বাঙালি স্বভাবতই সেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছে এবং নানা অনুষ্ঠানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রকাশনাও একটি কাজ, ফলে লেখালেখিও কিছু কম হচ্ছে না।
রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে বাঙালি বিদগ্ধজন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লে দোষ ধরা যাবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথকে পেতে, নিজের ও জাতীয় জীবনে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে, এ দেশে রীতিমতো একটি জঙ্গি রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়তে হয়েছে—যেমন পাকিস্তান আমলে তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও, পঁচাত্তরের পরে। সনৎকুমার সাহা বাঙালির এই সংগ্রামটার প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী এবং লড়াকু কলমসৈনিক। তিনি অনেক দিন ধরেই লিখছেন, সমাজবিজ্ঞান থেকে সাহিত্যের নন্দন পর্যন্ত অনায়াসে তাঁর বিচরণ। সনৎ সাহা মুক্তচিন্তার মানুষ বটে, তবে তাঁর লেখার শক্তির জায়গাটা যুক্তিবিচারের ক্ষমতা।
সম্প্রতি প্রকাশিত কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে তাঁর এই শক্তি যেন মাহাত্ম্যে ও সৌন্দর্যে পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
গ্রন্থভুক্ত ১৪টি প্রবন্ধেই আমরা রবীন্দ্রনাথের এমন এক জিজ্ঞাসু পাঠকের মুখোমুখি হই যিনি খোলামনে প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। প্রশ্ন সবই যে নিজের তা নয়, অন্যদের প্রশ্নেও তাঁর ধী ও মনন উজ্জীবিত হয়। সব কটি প্রবন্ধেই এক সজীব প্রাণবন্ত মনের সাহচর্য মেলে। তাতে আলোচনা, কখনো তর্ক, হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। আর এভাবে লেখক তাঁর নিজের অনেক জটিল ভাবনা, কঠিন তর্কের সহযাত্রী করে নেন পাঠককে।
বইয়ের প্রথম প্রবন্ধে আমরা রবীন্দ্রসংগীতের এক অনুরাগী শ্রোতার সাক্ষাৎ পাই, যিনি এই গানের সম্পদের পূর্ণতা ও সৌন্দর্যের মহিমায় মনের অনেকটা খোরাক পেয়েও অনুযোগ করেন, প্রবল সুখ বা প্রচণ্ড দুঃখের কোনো অভিজ্ঞতা বা অভিঘাত সরাসরি দেয় না এ গান। এ তো প্রশ্ন নয়, যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়া। এবার আমরা পেতে থাকি রবীন্দ্রগানের আরেক অনুরাগী শ্রোতার নিবিষ্ট অনুসন্ধান। ধীরে ধীরে আলোচনার পাপড়ি মেলতে মেলতে তিনি বোঝান কীভাবে ‘গান তাৎক্ষণিকতার মায়া উত্তীর্ণ হয়ে অনন্তের পথে উধাও হতে পাখা মেলে’।
প্রবল সুখ বা প্রচণ্ড দুঃখ তো আসলে ব্যক্তির টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা, অনুভব। তাকে রবীন্দ্রনাথ, ‘বৃহৎ অনুভবে’ মেশান। ‘আমাদের অব্যক্ত অনুভব তাঁর গানে রূপ পায়। পাখা মেলে। সে গান কথা ও সুরে মিলে এক, অবিভাজ্য ও সম্পূর্ণ।’
গীতাঞ্জলি নিয়ে আধুনিকদের যে সমালোচনা, এ ‘ভক্ত-ভগবানের লীলাকথা’, ‘কাব্যপ্রতিভা এখানে গৌণ, এবং পরিণামে কবির রচনা পুনরাবৃত্তিমুখর ও তাৎপর্যহীন’—তার সত্যতা তলিয়ে দেখেন তিনি। নিজেই নেমে পড়েন নিবিষ্ট কাব্য-অভিযাত্রায়। আমাদের জানান গীতাঞ্জলির বিশিষ্টতা, ‘যাকে চেনাজানা কোন ছকে বা ছাঁচেই ঠিক ফেলা যায় না।’ এ গীতিকবিতাগুলোর ‘ক্ল্যাসিকাল সারল্যের’ দিকে তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এখানে তিনি এমন এক রোমান্টিকতারও সন্ধান পান যা ব্যক্তির এষণাকে অতিক্রম করে ‘নৈর্ব্যক্তিক অখণ্ডতায় মিশে যেতে চায়।’ আরও জানান, ‘ধ্রুপদী ভাবসম্পদ ও ভাবকাঠামোর সঙ্গে ব্যক্তিপ্রাণের অকুণ্ঠ আবেদন...চিত্রময়তার অপূর্ণ আয়োজনে...সংযত বিন্যাসে’ কী চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। ইংরেজি সং অফারিংস-এর বিন্যাস, এ বই নিয়ে পাশ্চাত্যের সারস্বত সমাজের উচ্ছ্বাসের কারণ ও ধরন তাঁর আলোচনায় স্থান পায়।
রবীন্দ্রনাথই বিশ্বের একমাত্র কবি যাঁর রচিত দুটি গান দুই স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত। অথচ পরাধীন দেশের নাগরিক রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের যে রূপ দেখেছেন তাকে কখনো ভালোভাবে নিতে পারেননি। আর জাপানে ও পশ্চিমা বিশ্বে ক্রমেই জাতীয়তাবাদের যে উগ্র ধ্বংসাত্মক রূপটি প্রকট হতে দেখেছেন ততই রাষ্ট্র ও নেশন নিয়ে তাঁর বিরূপতা শাণিত হয়েছে। স্বদেশেও অনবদ্য সব স্বদেশি গানের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপের মধ্যে মানবের অকল্যাণ দেখতে পেয়ে শঙ্কিত হয়েছেন। দেশে ও বিদেশে অসহিষ্ণু সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছেন। আর আমরা তো জানি, রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রে নয়, সমাজের শক্তিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। আবার আমরা বাংলাদেশের নাগরিকেরা অন্তত জানি, তিনিই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রধান প্রেরণা, আবার সেই তিনিই তো ভারততীর্থের স্বপ্নদ্রষ্টা। ফলে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা, জাতীয়তাবাদী চেতনা তলিয়ে বুঝে নেওয়া খুবই জরুরি। সনৎ সাহা সেই কাজটিই করেছেন আমাদের জন্য।
‘কবিতা-অকবিতা’ প্রবন্ধটি প্রায় চার দশক আগে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা নিয়ে দুই মনীষী শঙ্খ ঘোষ ও আবু সায়ীদ আইয়ুবের মধ্যে যে মনন-ঋদ্ধ বিতর্ক হয়েছিল তারই সূত্র ধরে লেখা। কবিতা যখন বক্তব্যের ভার বহন করতে বাধ্য হয়, যখন কোনো বিষয় বোঝাতে যায় তখন সেটি কি কবিতার প্রাণিত করার মূল ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়? শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের অনেক কবিতার সরাসরি বিবরণধর্মিতায় কাব্যগুণ ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। আমরা লক্ষ করি, মূলত অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও সনৎ সাহা কতটা সাবলীল কবিতার আলোচনায়। যুক্তি বিস্তার করে তিনি বুদ্ধদেব বসু ও শঙ্খ ঘোষের মতো প্রতিষ্ঠিত কবি-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দ্বিমত করেন, তাঁদের যুক্তি খণ্ডান। কবিতায় ভারী বা তৎসম শব্দের প্রতি অনীহা দেখিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। তা থেকেই কি ক্রমে বাংলা কবিতায় এমন সব চলতি শব্দের ব্যবহার বাড়ছে যাতে ‘আগে থেকেই অনেক শব্দ কবিতায় অচল, এমন একটা ধারণা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে’ দেখে লেখক তাঁর উৎকণ্ঠা গোপন করতে পারেন না। পাশাপাশি তাঁর মনে হয়েছে, শঙ্খ ঘোষের ঝোঁকটা শুদ্ধ কবিতার দিকে, যা তাঁর ‘অসম্ভবই মনে হয়’। শঙ্খ ঘোষ অবশ্য অত স্পষ্টভাবে গদ্যাক্রান্তিকে, বক্তব্যভারকে অকবিতার দায়ে বিদ্ধ করেন কি না সে ভাবনাটা থেকে যায়।
রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য তাঁকে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ব্যক্তি, ব্যক্তির দেশানুগত্য, নারীর অবস্থান ইত্যাদি নানা ভাবনায় টেনে নেয়। আর সেই সুবাদে আমরা রবীন্দ্রনাথের, বিশেষভাবে তাঁর নারী চরিত্রগুলো সম্পর্কে সনৎ সাহার বিশ্লেষণ ও বক্তব্য জানতে পারি।
এই জানাটা বিশেষভাবে জরুরি হয়ে পড়ে, কারণ নারীর বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিতান্তই সনাতন মানুষ, এমন একটা সমালোচনা অনেক দিন ধরে চলছে। তিনি ঠিকই বলেন, প্রতিষ্ঠিত প্রাজ্ঞজনদের সমালোচনার জোরে এ যেন বিশ্বাসেই পরিণত হয়েছে। ফলে প্রসঙ্গটা তাঁকে তলিয়ে বিচার করে দেখতে হয়। কুমু, বিনোদ, বিমলা, লাবণ্য, ললিতা, মঞ্জুলিকা হয়ে তাঁকে আসতে হয় আনন্দময়ী পর্যন্ত। আনন্দময়ী নারীত্বের সর্বংসহা প্রতিমা বটে, কিন্তু সনৎ সাহা যুক্তির জাল পেতেই ধরতে পারেন, সে প্রতিমা ‘কিন্তু পরিপূর্ণ বাস্তব’। আমাদের অভিজ্ঞতার সুফিয়া কামালের দৃষ্টান্ত টানেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের গোরা আর কিপলিং-এর কিম নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করেন একটি প্রবন্ধেরই পরিসরে। চুম্বকে দুটি উপন্যাসের কাহিনি তুলে ধরে একদিকে ব্যক্তি কীভাবে দেশের হয়, দেশাতীতও হয় তা আলোচনা করেন আর অন্যদিকে ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকের ব্যক্তি ও দেশ-বিচারের ভিন্নতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ বইয়ের সব কটি প্রবন্ধই আমাদের ভাবনাকে উশকে তোলে, দেখার ও বোঝার নতুন মাত্রিকতার সন্ধান দেয়, বিচার ও বিশ্লেষণের নতুনতর আয়ুধের সম্ভার দেয়।
আগে বলেছি, এ বইয়ে এক মননশীল লেখককে আমরা পাই। পড়া এগোতে এগোতে বুঝি তিনিই প্রকৃত মননশীল লেখক যাঁর চিন্তা মৌলিক, আর তাই তাঁর যুক্তিবিচার ও বিশ্লেষণ নির্মিত হয় চমৎকার সৃজনশীল গদ্যে। ছোট্ট দৃষ্টান্ত দিই, ‘নীচু গলায় গল্প বলায় আমরা শুধু কারুণ্যের হালকা অনুভবের ছোঁয়া পেয়েই তার পাঠ সাঙ্গ করতে পারি; কিন্তু গভীরভাবে তাকে আত্মস্থ করলে বুঝতে পারি, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়ালেও আছে বিদ্যুৎ। আছে ঘর্ষণে ঘর্ষণে বজ্রপাতের আশংকা’ (নারীর কথা: গল্পে-উপন্যাসে, পৃ. ১৫)। মাঝেমধ্যে চমৎকার কিছু শব্দও তৈরি করেছেন তিনি।
শুধু বলব, এমন চমৎকার বইটির কোনো পৃষ্ঠাই মুদ্রণপ্রমাদ থেকে মুক্ত নয়। আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তি বড়ই চঞ্চলা, শুদ্ধ কিছু প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪১৭
সৃজনশীল শাখা
সনৎকুমার সাহার কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ
শংসাবচন
‘দুঃখসুখের লক্ষ ধারায়, পাত্র ভরিয়ে দিয়েছি তোমায়’। রবীন্দ্রসৃষ্টিকর্মে এই লক্ষ ধারার রূপ বিচিত্র। তিনি আজীবন খুঁজেছেন ‘ক্ষণকালের লীলাস্রোতে’ চিরকালীন সত্যের আভাস। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম এশীয় কবি তিনি যিনি গীতাঞ্জলির বাণীপ্রতিমায় খণ্ডবিখণ্ড বিপন্ন মানুষকে সমগ্রতায় ফিরিয়ে আনেন। যিনি প্রথম নারীকে দেখেছেন মানুষী ব্যক্তিত্বে। বহুমাত্রিক অনুভবের পাপড়িগুলো মেলে ধরেন ছন্দে-মিলে, ভাবের প্রতিমা দিয়ে গড়েন রূপ।
কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ বইটিতে সময়-সমাজ-শাসিত মানবজীবন ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথকে পথের সাথি করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার কথাই বলেন সনৎকুমার সাহা। তিনি সন্ধান করেন আত্মোপলব্ধির অবলম্বন, আত্মরক্ষার হাতিয়ার। রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটকের সৃষ্টিশীলতায় এবং বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতনের কর্মযজ্ঞের মধ্যে খুঁজে নেন আজকের একুশ শতকে বেঁচে থাকার তাৎপর্য, মানুষের চলার পথ।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা; জাতীয় সংস্কৃতি ও মননের প্রতীকও বটে। সনৎকুমার সাহা এই জাতীয় সংগীতে দেখতে পান বাঙালির হূদয়তন্ত্রীকে স্পর্শ করার সুরময়তা, যেখানে বাংলাই এ গানের প্রাণপ্রতিমা—আতিশয্যহীন, আড়ম্বরহীন প্রকৃতি-কেন্দ্রিকতার রূপপ্রতিমা—‘মা’। গ্রন্থকারের মতে, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি এই কারণে যে, তিনি শুধু ব্যক্তির মধ্যে চিরমানবকেই প্রতিষ্ঠা দেননি, দিয়েছেন মানবের কসমিক সত্তাকেও।
সনৎকুমার সাহার কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি আমাদের নতুন করে ভাবায়, চেনায় চিরচেনা অথচ অচেনায় ঢাকা রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষে রচিত অসংখ্য গ্রন্থের মোট সংখ্যা এখনো নির্ণয় করা হয়নি। তবে এই গ্রন্থটি যে কয়েকটি প্রণিধানযোগ্য রচনার মধ্যে স্থান পাবে—এই প্রত্যাশা করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়ে ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের মনে হয়েছিল, এ এক শীর্ষ সংস্কৃতির ফসল। সার্ধশত বর্ষে বাঙালি স্বভাবতই সেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছে এবং নানা অনুষ্ঠানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রকাশনাও একটি কাজ, ফলে লেখালেখিও কিছু কম হচ্ছে না।
রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে বাঙালি বিদগ্ধজন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লে দোষ ধরা যাবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথকে পেতে, নিজের ও জাতীয় জীবনে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে, এ দেশে রীতিমতো একটি জঙ্গি রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়তে হয়েছে—যেমন পাকিস্তান আমলে তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও, পঁচাত্তরের পরে। সনৎকুমার সাহা বাঙালির এই সংগ্রামটার প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী এবং লড়াকু কলমসৈনিক। তিনি অনেক দিন ধরেই লিখছেন, সমাজবিজ্ঞান থেকে সাহিত্যের নন্দন পর্যন্ত অনায়াসে তাঁর বিচরণ। সনৎ সাহা মুক্তচিন্তার মানুষ বটে, তবে তাঁর লেখার শক্তির জায়গাটা যুক্তিবিচারের ক্ষমতা।
সম্প্রতি প্রকাশিত কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে তাঁর এই শক্তি যেন মাহাত্ম্যে ও সৌন্দর্যে পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
গ্রন্থভুক্ত ১৪টি প্রবন্ধেই আমরা রবীন্দ্রনাথের এমন এক জিজ্ঞাসু পাঠকের মুখোমুখি হই যিনি খোলামনে প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। প্রশ্ন সবই যে নিজের তা নয়, অন্যদের প্রশ্নেও তাঁর ধী ও মনন উজ্জীবিত হয়। সব কটি প্রবন্ধেই এক সজীব প্রাণবন্ত মনের সাহচর্য মেলে। তাতে আলোচনা, কখনো তর্ক, হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। আর এভাবে লেখক তাঁর নিজের অনেক জটিল ভাবনা, কঠিন তর্কের সহযাত্রী করে নেন পাঠককে।
বইয়ের প্রথম প্রবন্ধে আমরা রবীন্দ্রসংগীতের এক অনুরাগী শ্রোতার সাক্ষাৎ পাই, যিনি এই গানের সম্পদের পূর্ণতা ও সৌন্দর্যের মহিমায় মনের অনেকটা খোরাক পেয়েও অনুযোগ করেন, প্রবল সুখ বা প্রচণ্ড দুঃখের কোনো অভিজ্ঞতা বা অভিঘাত সরাসরি দেয় না এ গান। এ তো প্রশ্ন নয়, যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়া। এবার আমরা পেতে থাকি রবীন্দ্রগানের আরেক অনুরাগী শ্রোতার নিবিষ্ট অনুসন্ধান। ধীরে ধীরে আলোচনার পাপড়ি মেলতে মেলতে তিনি বোঝান কীভাবে ‘গান তাৎক্ষণিকতার মায়া উত্তীর্ণ হয়ে অনন্তের পথে উধাও হতে পাখা মেলে’।
প্রবল সুখ বা প্রচণ্ড দুঃখ তো আসলে ব্যক্তির টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা, অনুভব। তাকে রবীন্দ্রনাথ, ‘বৃহৎ অনুভবে’ মেশান। ‘আমাদের অব্যক্ত অনুভব তাঁর গানে রূপ পায়। পাখা মেলে। সে গান কথা ও সুরে মিলে এক, অবিভাজ্য ও সম্পূর্ণ।’
গীতাঞ্জলি নিয়ে আধুনিকদের যে সমালোচনা, এ ‘ভক্ত-ভগবানের লীলাকথা’, ‘কাব্যপ্রতিভা এখানে গৌণ, এবং পরিণামে কবির রচনা পুনরাবৃত্তিমুখর ও তাৎপর্যহীন’—তার সত্যতা তলিয়ে দেখেন তিনি। নিজেই নেমে পড়েন নিবিষ্ট কাব্য-অভিযাত্রায়। আমাদের জানান গীতাঞ্জলির বিশিষ্টতা, ‘যাকে চেনাজানা কোন ছকে বা ছাঁচেই ঠিক ফেলা যায় না।’ এ গীতিকবিতাগুলোর ‘ক্ল্যাসিকাল সারল্যের’ দিকে তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এখানে তিনি এমন এক রোমান্টিকতারও সন্ধান পান যা ব্যক্তির এষণাকে অতিক্রম করে ‘নৈর্ব্যক্তিক অখণ্ডতায় মিশে যেতে চায়।’ আরও জানান, ‘ধ্রুপদী ভাবসম্পদ ও ভাবকাঠামোর সঙ্গে ব্যক্তিপ্রাণের অকুণ্ঠ আবেদন...চিত্রময়তার অপূর্ণ আয়োজনে...সংযত বিন্যাসে’ কী চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। ইংরেজি সং অফারিংস-এর বিন্যাস, এ বই নিয়ে পাশ্চাত্যের সারস্বত সমাজের উচ্ছ্বাসের কারণ ও ধরন তাঁর আলোচনায় স্থান পায়।
রবীন্দ্রনাথই বিশ্বের একমাত্র কবি যাঁর রচিত দুটি গান দুই স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত। অথচ পরাধীন দেশের নাগরিক রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের যে রূপ দেখেছেন তাকে কখনো ভালোভাবে নিতে পারেননি। আর জাপানে ও পশ্চিমা বিশ্বে ক্রমেই জাতীয়তাবাদের যে উগ্র ধ্বংসাত্মক রূপটি প্রকট হতে দেখেছেন ততই রাষ্ট্র ও নেশন নিয়ে তাঁর বিরূপতা শাণিত হয়েছে। স্বদেশেও অনবদ্য সব স্বদেশি গানের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের উগ্র রূপের মধ্যে মানবের অকল্যাণ দেখতে পেয়ে শঙ্কিত হয়েছেন। দেশে ও বিদেশে অসহিষ্ণু সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছেন। আর আমরা তো জানি, রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রে নয়, সমাজের শক্তিতেই বিশ্বাসী ছিলেন। আবার আমরা বাংলাদেশের নাগরিকেরা অন্তত জানি, তিনিই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রধান প্রেরণা, আবার সেই তিনিই তো ভারততীর্থের স্বপ্নদ্রষ্টা। ফলে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা, জাতীয়তাবাদী চেতনা তলিয়ে বুঝে নেওয়া খুবই জরুরি। সনৎ সাহা সেই কাজটিই করেছেন আমাদের জন্য।
‘কবিতা-অকবিতা’ প্রবন্ধটি প্রায় চার দশক আগে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা নিয়ে দুই মনীষী শঙ্খ ঘোষ ও আবু সায়ীদ আইয়ুবের মধ্যে যে মনন-ঋদ্ধ বিতর্ক হয়েছিল তারই সূত্র ধরে লেখা। কবিতা যখন বক্তব্যের ভার বহন করতে বাধ্য হয়, যখন কোনো বিষয় বোঝাতে যায় তখন সেটি কি কবিতার প্রাণিত করার মূল ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়? শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের অনেক কবিতার সরাসরি বিবরণধর্মিতায় কাব্যগুণ ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। আমরা লক্ষ করি, মূলত অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও সনৎ সাহা কতটা সাবলীল কবিতার আলোচনায়। যুক্তি বিস্তার করে তিনি বুদ্ধদেব বসু ও শঙ্খ ঘোষের মতো প্রতিষ্ঠিত কবি-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দ্বিমত করেন, তাঁদের যুক্তি খণ্ডান। কবিতায় ভারী বা তৎসম শব্দের প্রতি অনীহা দেখিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। তা থেকেই কি ক্রমে বাংলা কবিতায় এমন সব চলতি শব্দের ব্যবহার বাড়ছে যাতে ‘আগে থেকেই অনেক শব্দ কবিতায় অচল, এমন একটা ধারণা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে’ দেখে লেখক তাঁর উৎকণ্ঠা গোপন করতে পারেন না। পাশাপাশি তাঁর মনে হয়েছে, শঙ্খ ঘোষের ঝোঁকটা শুদ্ধ কবিতার দিকে, যা তাঁর ‘অসম্ভবই মনে হয়’। শঙ্খ ঘোষ অবশ্য অত স্পষ্টভাবে গদ্যাক্রান্তিকে, বক্তব্যভারকে অকবিতার দায়ে বিদ্ধ করেন কি না সে ভাবনাটা থেকে যায়।
রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য তাঁকে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ব্যক্তি, ব্যক্তির দেশানুগত্য, নারীর অবস্থান ইত্যাদি নানা ভাবনায় টেনে নেয়। আর সেই সুবাদে আমরা রবীন্দ্রনাথের, বিশেষভাবে তাঁর নারী চরিত্রগুলো সম্পর্কে সনৎ সাহার বিশ্লেষণ ও বক্তব্য জানতে পারি।
এই জানাটা বিশেষভাবে জরুরি হয়ে পড়ে, কারণ নারীর বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিতান্তই সনাতন মানুষ, এমন একটা সমালোচনা অনেক দিন ধরে চলছে। তিনি ঠিকই বলেন, প্রতিষ্ঠিত প্রাজ্ঞজনদের সমালোচনার জোরে এ যেন বিশ্বাসেই পরিণত হয়েছে। ফলে প্রসঙ্গটা তাঁকে তলিয়ে বিচার করে দেখতে হয়। কুমু, বিনোদ, বিমলা, লাবণ্য, ললিতা, মঞ্জুলিকা হয়ে তাঁকে আসতে হয় আনন্দময়ী পর্যন্ত। আনন্দময়ী নারীত্বের সর্বংসহা প্রতিমা বটে, কিন্তু সনৎ সাহা যুক্তির জাল পেতেই ধরতে পারেন, সে প্রতিমা ‘কিন্তু পরিপূর্ণ বাস্তব’। আমাদের অভিজ্ঞতার সুফিয়া কামালের দৃষ্টান্ত টানেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের গোরা আর কিপলিং-এর কিম নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করেন একটি প্রবন্ধেরই পরিসরে। চুম্বকে দুটি উপন্যাসের কাহিনি তুলে ধরে একদিকে ব্যক্তি কীভাবে দেশের হয়, দেশাতীতও হয় তা আলোচনা করেন আর অন্যদিকে ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকের ব্যক্তি ও দেশ-বিচারের ভিন্নতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ বইয়ের সব কটি প্রবন্ধই আমাদের ভাবনাকে উশকে তোলে, দেখার ও বোঝার নতুন মাত্রিকতার সন্ধান দেয়, বিচার ও বিশ্লেষণের নতুনতর আয়ুধের সম্ভার দেয়।
আগে বলেছি, এ বইয়ে এক মননশীল লেখককে আমরা পাই। পড়া এগোতে এগোতে বুঝি তিনিই প্রকৃত মননশীল লেখক যাঁর চিন্তা মৌলিক, আর তাই তাঁর যুক্তিবিচার ও বিশ্লেষণ নির্মিত হয় চমৎকার সৃজনশীল গদ্যে। ছোট্ট দৃষ্টান্ত দিই, ‘নীচু গলায় গল্প বলায় আমরা শুধু কারুণ্যের হালকা অনুভবের ছোঁয়া পেয়েই তার পাঠ সাঙ্গ করতে পারি; কিন্তু গভীরভাবে তাকে আত্মস্থ করলে বুঝতে পারি, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়ালেও আছে বিদ্যুৎ। আছে ঘর্ষণে ঘর্ষণে বজ্রপাতের আশংকা’ (নারীর কথা: গল্পে-উপন্যাসে, পৃ. ১৫)। মাঝেমধ্যে চমৎকার কিছু শব্দও তৈরি করেছেন তিনি।
শুধু বলব, এমন চমৎকার বইটির কোনো পৃষ্ঠাই মুদ্রণপ্রমাদ থেকে মুক্ত নয়। আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তি বড়ই চঞ্চলা, শুদ্ধ কিছু প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪১৭
সৃজনশীল শাখা
সনৎকুমার সাহার কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ
শংসাবচন
‘দুঃখসুখের লক্ষ ধারায়, পাত্র ভরিয়ে দিয়েছি তোমায়’। রবীন্দ্রসৃষ্টিকর্মে এই লক্ষ ধারার রূপ বিচিত্র। তিনি আজীবন খুঁজেছেন ‘ক্ষণকালের লীলাস্রোতে’ চিরকালীন সত্যের আভাস। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম এশীয় কবি তিনি যিনি গীতাঞ্জলির বাণীপ্রতিমায় খণ্ডবিখণ্ড বিপন্ন মানুষকে সমগ্রতায় ফিরিয়ে আনেন। যিনি প্রথম নারীকে দেখেছেন মানুষী ব্যক্তিত্বে। বহুমাত্রিক অনুভবের পাপড়িগুলো মেলে ধরেন ছন্দে-মিলে, ভাবের প্রতিমা দিয়ে গড়েন রূপ।
কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ বইটিতে সময়-সমাজ-শাসিত মানবজীবন ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথকে পথের সাথি করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার কথাই বলেন সনৎকুমার সাহা। তিনি সন্ধান করেন আত্মোপলব্ধির অবলম্বন, আত্মরক্ষার হাতিয়ার। রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটকের সৃষ্টিশীলতায় এবং বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতনের কর্মযজ্ঞের মধ্যে খুঁজে নেন আজকের একুশ শতকে বেঁচে থাকার তাৎপর্য, মানুষের চলার পথ।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা; জাতীয় সংস্কৃতি ও মননের প্রতীকও বটে। সনৎকুমার সাহা এই জাতীয় সংগীতে দেখতে পান বাঙালির হূদয়তন্ত্রীকে স্পর্শ করার সুরময়তা, যেখানে বাংলাই এ গানের প্রাণপ্রতিমা—আতিশয্যহীন, আড়ম্বরহীন প্রকৃতি-কেন্দ্রিকতার রূপপ্রতিমা—‘মা’। গ্রন্থকারের মতে, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি এই কারণে যে, তিনি শুধু ব্যক্তির মধ্যে চিরমানবকেই প্রতিষ্ঠা দেননি, দিয়েছেন মানবের কসমিক সত্তাকেও।
সনৎকুমার সাহার কবিতা-অকবিতা রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি আমাদের নতুন করে ভাবায়, চেনায় চিরচেনা অথচ অচেনায় ঢাকা রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষে রচিত অসংখ্য গ্রন্থের মোট সংখ্যা এখনো নির্ণয় করা হয়নি। তবে এই গ্রন্থটি যে কয়েকটি প্রণিধানযোগ্য রচনার মধ্যে স্থান পাবে—এই প্রত্যাশা করা যায়।
No comments