ঈদুল আজহা-মনের পশুকে জবাই কোরবানির সার্থকতা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলিম জাতির অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। প্রতিবছর চান্দ্রমাসের ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে কোরবানির অফুরন্ত আনন্দের সওগাত ও ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা নিয়ে আসে। আরবি ‘কুরব’ শব্দমূল থেকে কোরবানির উৎপত্তি, যার অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, নৈকট্য লাভ ইত্যাদি। এককথায় আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আত্মোৎসর্গ করাই হচ্ছে কোরবানি।


ইসলামের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিশেষ কিছু পশু জবাইকে কোরবানি বলা হয়। কোরবানি দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় বলে এমন নামকরণ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির নিয়ম করেছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি, সেগুলো জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত-৩৪)
ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালনের সঙ্গে একটি অনন্য পরীক্ষার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের স্মৃতি বিজড়িত। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের মাধ্যমে এ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুরু হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জানমাল ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিবেদিত। তিনি সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কোরবানি করার জন্য আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হন। এটি ছিল তাঁর জীবনের কঠোরতম অগ্নিপরীক্ষা। তিনি নতশিরে এ নির্দেশ মেনে নিয়ে প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন। আল্লাহ পাক হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানি কবুল করলেন। হজরত ইসমাইল (আ.) জবেহ হলেন না, তদস্থলে বেহেশত থেকে আনীত দুম্বা জবেহ হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা এ নির্দেশের মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর খোদাপ্রেমের নিষ্ঠা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.), বিবি হাজেরা ও হজরত ইসমাইল (আ.) স্রষ্টাপ্রেম ও আত্মত্যাগের চরম পরীক্ষায় পূর্ণাঙ্গভাবে কামিয়াব হয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ—সবকিছুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, যিনি নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত-১৬২)
সেই আশ্চর্যপূর্ণ কোরবানির ঘটনা স্মরণ করে প্রতিবছর মুসলমানরা ঈদুল আজহার পর্ব উদ্যাপন করে থাকেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রাণাধিক শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে আত্মসমর্পণের বিরল নজির স্থাপন করেন, এ জন্য মুসলমানদের উচিত তাঁর অতুলনীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং সুমহান আত্মত্যাগের শিক্ষায় স্রষ্টার নির্দেশ ও বিধানগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ পালনে এক মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাই স্রষ্টার প্রতিটি আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালকের জন্য নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।’ (সূরা আল-কাউসার, আয়াত-২) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করেন, ‘এ কোরবানিগুলো কী?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের সুন্নাত।’ (ইবনে মাজা)
জিলহজ চাঁদের দশম তারিখে ঈদুল আজহার নামাজ জামাতে সমাপনের পর সংগতিসম্পন্ন মুসলমানরা গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট, মহিষ প্রভৃতি পশু কোরবানি করেন। ঈদুল আজহা শুধু কোরবানির গোশত ভক্ষণের উৎসব নয়, মানবিক কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার এক মোক্ষম সময়। সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষ এ সময় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলতে পারে এবং অপরের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করতে পারে—এটিই কোরবানির শিক্ষা। মূলত, মানুষ কোরবানির মাধ্যমে নেক কাজে কতটুকু আত্মত্যাগ ও খোদাভীতির পরিচয় দিচ্ছে এবং সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ কতটুকু পালন করছে, তা আল্লাহ তাআলা প্রত্যক্ষ করেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির জীবের রক্ত-মাংস কোনোটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের খোদাভীতি ও আন্তরিকতা।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত-৩৭) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্ল মন হও।’ (ইবনে মাজা, তিরমিজি)
মানবজীবনে সব জিনিসের চেয়ে আল্লাহর নির্দেশকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার শিক্ষা রয়েছে কোরবানিতে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনের প্রিয়তম বস্তুকে হারাতে হলেও তা থেকে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। এ মহান আত্মত্যাগের উদ্দেশ্য সামনে রেখেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে কোরবানির প্রচলন হয়। কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা প্রভৃতি খোদাপ্রেম-বিরোধী রিপুগুলোকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ ও দমন করার শিক্ষা রয়েছে এ কোরবানিতে। প্রতিবছর ঈদুল আজহা মুসলিম জাহানে এসে মুসলমান জাতির ঈমানি দুর্বলতা, চারিত্রিক কলুষতা দূর করে ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় তাদের ঈমানি শক্তিকে বলীয়ান, নিখুঁত ও মজবুত করে। মুসলমানরা এ কোরবানির মাধ্যমে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দীক্ষা নেন, সমাজের বুক থেকে অসত্য, অন্যায়, দুর্নীতি ও অশান্তি দূর করার জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা লাভ করেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘কোরবানি হত্যা নয়, সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ সুতরাং, মানুষের মনের মধ্যে যে পশুশক্তি সুপ্ত বা জাগ্রত অবস্থায় বিরাজমান, তা অবশ্যই কোরবান করতে হবে। কেননা, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা, পশু কোরবানি হচ্ছে আত্মকোরবানির প্রতীক। তাই কোরবানি করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঈদুল আজহায় কোরবানি নিখুঁতভাবে আদায় করতে যত্নবান হওয়া উচিত।
 ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.