বাস্তবায়নের ধারায় ফিরছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি by অরুণ কর্মকার
সই হওয়ার ১৪ বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ধারায় ফিরছে। চুক্তির অন্যতম মৌলিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধ নিরসন। এ সংক্রান্ত ২০০১ সালের আইনটি চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি।
গতকাল রোববার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির এক সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী, আইন সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি প্রশাসন, ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অর্পিত হবে। এগুলো ভূমি মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমন্বয়ে সমস্যা হচ্ছিল।
বৈঠক সূত্র জানায়, ভূমি কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা রদ করা হবে। কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হবে সর্বসম্মত, তা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতই হবে সিদ্ধান্ত। ভূমি কমিশন আইন বাস্তবায়নের জন্য যে বিধিমালা করা হবে, তা জেলা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ও আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে করা হবে।
ভূমি কমিশন ভারত প্রত্যাগত পার্বত্য শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি ছাড়াও ভূমিসংক্রান্ত অন্যান্য বিরোধও নিষ্পত্তি করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জলে ভাসা জমি (ফ্রিঞ্জল্যান্ড) ব্যবহারের বিষয়েও ভূমি কমিশনের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে উপরিউক্ত বিষয়াবলিতে ভূমি কমিশন আইনের অসামঞ্জস্যের কারণে এত দিন চুক্তির মৌলিক বিষয়ের বাস্তবায়নে অগ্রগতি সম্ভব হয়নি।
সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন কমিটি চুক্তির অন্যান্য বিষয় বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণেও সক্রিয় হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চায়। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতিও সমন্বিতভাবে কাজ করছে।’
চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকালের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। জানতে চাইলে কমিটির অন্যতম সদস্য ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এযাবৎকালের মধ্যে এই প্রথম সরকারের একটি ইতিবাচক উদ্যোগ দেখলাম। সভায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অগ্রসর হতে পারে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জেএসএস আন্দোলনেই আছে। আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে আন্দোলন জোরদার করা হবে।
তিন সদস্যের চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির অন্য সদস্য হচ্ছেন ভারত-প্রত্যাগত পার্বত্য শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান, খাগড়াছড়ির সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা। গতকালের সভায় এ ছাড়াও কমিটির আহ্বায়কের বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে এর আগে গওহর রিজভী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাঙামাটি গিয়ে সন্তু লারমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৬ জানুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সন্তু লারমার বৈঠক হয়েছে। এরপর গতকাল অনুষ্ঠিত হলো চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভা।
মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত অনেক ছোট ছোট বিষয় বাস্তবায়নেও মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ওই চুক্তি স্বায়ত্তশাসনকামী পাহাড়িদের সঙ্গে মধ্য সত্তরের দশক থেকে চলা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল।
সরকারের বর্তমান উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিবিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা। চুক্তিরও মৌলিক বিষয়। এ সমস্যা সমাধানের সরকারি উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। পার্বত্য জনগণ সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তবে এ বিষয়ে অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তাই কোনো কিছু না হওয়া পর্যন্ত আশ্বস্ত হওয়া যায় না।
No comments