সাদাকালো-গাদ্দাফি : একক ক্ষমতার ভারে অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন by আহমদ রফিক
কর্নেল গাদ্দাফিকে পরিপক্ব চিন্তার মানুষ বলে মনে করা হতো, সেই সঙ্গে সাহসীও। তবে বেদুইন সন্তান হওয়ার কারণে কি কিছুটা বেপরোয়া? তাঁর জনসম্পর্কের ভিত একসময় শক্ত থাকার কারণে এবং তেলসম্পদের আনুকূল্যে দেশের কোষাগারে অর্থের স্রোত বহমান থাকায় যুক্তরাষ্ট্রকেও তোয়াক্কা করেননি গাদ্দাফি। ৪০ বছর নির্বিবাদে নয়, বিবাদ-বিতর্কসহ শাসনদণ্ড পরিচালনা করেছেন শক্ত হাতে।
কিন্তু একক ক্ষমতার ভার অনেককেই অন্ধ করে দেয়। গাদ্দাফিকেও করেছিল। প্রাথমিক পর্বের বেদুইন-সারল্য আর তাঁর মধ্যে ছিল না। ক্ষমতার দম্ভ প্রকট হয়ে ওঠে। একচ্ছত্র ক্ষমতা সন্ত্রাসবাদী মানসিকতার জন্ম দেয়। পায়ের নিচে জনসমর্থনের মাটি সরে যেতে থাকলেও চোখের অন্ধ তামসে তা দৃষ্টিতে পড়ে না। পড়েনি গাদ্দাফির। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার এমনই মহা-আপদ।
গাদ্দাফি কি সেই বয়সে পেঁৗছেছিলেন, যখন দূরেরটা তো বটেই, 'কাছেরটাও বিলক্ষণ ঝাপসা দেখায়?' তিনি দেখতে পাননি কী ঘটছে তাঁর চিরবিশ্বস্ত তাঁবুর ভেতরে এবং বাইরে। বাইরেরটা অবশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু পাত্তা দেননি। নিজের শক্তি ও সমর্থন সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। এবং এতটাই ছিলেন যে পতন অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতামদে আচ্ছন্ন থাকায় হুঙ্কার দিয়ে বলতে পেরেছেন, 'জভ্ জারি রহেগা'। যেমনটা একাত্তরের (১৯৭১) ডিসেম্বরে আমরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মুখে শুনেছি ঢাকা পতনের লগ্নে, যখন জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শেষ।
আসলে এ আপ্তবাক্যের পঙ্ক্তি গাদ্দাফির জানা ছিল না, থাকার কথাও নয় যে 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?' তাই প্রলয় ঝড় তাঁবুতে ঢোকার দুদিন আগেও বিদ্রোহীদের ইঁদুর আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবারও বলি, ইঁদুরের দাঁতে যে কত শক্তি তা গাদ্দাফির ধারণায় ছিল না। দম্ভ মানুষকে অন্ধ করে, তাই বিদ্রোহীদের পেছনে বড় ইঁদুরের উপস্থিতি শক্তি হিসেবে গ্রাহ্যে আনেননি গাদ্দাফি। এমনকি বছর কয় আগেকার ঘটনায় সাদ্দাম হোসেনের পরিণতি দেখে শিক্ষা নেননি।
অবশ্য ইরাকের ঘটনা ভিন্ন হলেও পরাশক্তির কুটিল ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনাও তাঁকে সহিষ্ণু-বিচক্ষণতার শিক্ষা দেয়নি। তাঁর পরিণতি যদি সাদ্দামের মতো হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
প্রচলিত প্রবাদ, জাহাজ যখন ডুবতে শুরু করে তখন ইঁদুরই প্রথম পালাতে থাকে। গাদ্দাফির আত্মবিশ্বাস এমনই অন্ধ ছিল যে তাঁর তাঁবু থেকে ইঁদুর পালানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও কার্যকারণ হিসেবে মেলাতে চেষ্টা করেননি সর্বাধিনায়ক গাদ্দাফি। দুর্বল ঘরের শত্রু ও পরাক্রান্ত বাইরের শত্রুর সর্বাত্মক সমর্থন পেলে সে শক্তিকে হেলাফেলা করা চলে না। কিন্তু করেছেন কর্নেল গাদ্দাফি। কোনো প্রকার কূটনৈতিক বিচক্ষণতা তিনি আমলে আনেননি।
তাই এক এক করে ঘণ্টা বেজেছে। অনেক আরব রাষ্ট্রকে শত্রু বানিয়েছিলেন তিনি, কখনো শক্তির দম্ভে, কখনো আদর্শিক কারণে অর্থাৎ রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে যা ছিল সাদ্দামের ইরাক, আসাদের সিরিয়া এবং ইরানেরও লক্ষ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন বিরোধিতার বিষয়টি ছিল তাঁদের জন্য নেতিবাচক। তাই তাঁরা ওই লক্ষ্যে এক পা-ও এগোতে পারেননি। কূটনীতির কথা বলছি এ জন্য যে বিদ্রোহের শুরুতে ভিন্ন মেরুর হওয়া সত্ত্বেও আরব লিগ সরাসরি গাদ্দাফির লিবিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। বরং ঘটনার সমঝোতামূলক সমাধানই তারা চেয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি গাদ্দাফি। ইউরো-মার্কিন কূটনীতি ও সামরিক শক্তির (ন্যাটো) অবমূল্যায়ন করেছেন এই একনায়ক।
পরিণামে অভাবিত কিছুই ঘটেছে।
অভাবিত বলছি এ জন্য যে শুরুতে অনেকেরই ধারণা ছিল_গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না, বিদ্রোহ ব্যর্থ হবে। ইউরো-মার্কিন জোটের সামরিক, অর্থনৈতিক সাহায্যের পরও এমন ভাবনার বাস্তব কারণ ছিল বলে মনে হয় না। গাদ্দাফির সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ফরিদ জাকারিয়া, যাঁর সাংবাদিকতার খ্যাতি বিখ্যাত 'টাইম' ম্যাগাজিন ও 'সিএনএন' টিভির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ঘিরে_বলেছিলেন, গাদ্দাফি আত্মসমর্পণ করবেন না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন।'
কিন্তু সে ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি। বিদ্রোহীরা ঠিকই মুয়াম্মার গাদ্দাফির দুর্ভেদ্য ভবনে ঢুকে পড়েছে এবং গাদ্দাফির গোপন ট্যানেল, যে ট্যানেলের অস্তিত্ব অনেকেরই জানা। সন্দেহ নেই, গাদ্দাফি আফ্রিকা ও আরববিশ্বের একনায়কদের তুলনায় ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যে একেবারেই আলাদা। তবু তিনি পতন আসন্ন জেনে চিলির আলেন্দের মতো অস্ত্র হাতে শহীদ হওয়ার বদলে ইঁদুরের মতোই গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছেন বা পালিয়ে গেছেন, মুখোমুখি যুদ্ধের সম্মুখীন না হয়ে। তাতে কি সাদ্দামের অনুরূপ পরিণতি ঠেকানো যাবে?
যাবে না। কারণ সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি যাদের শত্রু তাদের স্বার্থবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের শেষ করতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে জানে। একের পর এক ফাঁদ পাতে, তারপর ক্লান্তিহীন অপেক্ষা_কখন সুযোগ আসবে বা উপলক্ষ তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে উপলক্ষ তৈরি হয় মিসরীয় স্বৈরশাসকের পতনের পর গত ফেব্রুয়ারিতে ওই ধারাবাহিকতায় যখন লিবিয়ায় প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়। আর কথিত গণতন্ত্রের দাবিতে অনুষ্ঠিত সে শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে অদূরদর্শী মোকাবিলায় গাদ্দাফি বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ অশান্তির দিকে ঠেলে দেয়। ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট_এই দীর্ঘ সময়ে সমঝোতার অনেক পথ খোলা ছিল। কিন্তু গাদ্দাফির সাফ কথা_'হয় ক্ষমতায় থাকব, না হয় শহীদ হব।' মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। তবু প্রশ্ন : এ সমাবেশ কি একেবারে নিরীহ ঘটনা, নাকি এতে বাইরের ইন্ধন ছিল? মানবাধিকার কর্মীর উপস্থিতি তেমনই ইঙ্গিত দেয়।
কর্নেল গাদ্দাফি ১৯৬৯ সালে লিবিয়ায় রাজতন্ত্র উৎখাত করে ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি যেমন বেদুইন সন্তান, তেমনি তাঁর সহযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাদের সবাই দরিদ্র গোত্র থেকে উঠে আসা মানুষ। তাঁদের বরাবরের স্বপ্ন_আরব বিশ্ব থেকে রজতন্ত্রের বিলোপ। কিন্তু যাদের খুঁটি ইউরো-মার্কিন পরাশক্তি, তাদের ভূখণ্ডে সামাজিক শক্তির উত্থান না ঘটলে রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব হয় না। আশ্চর্য যে তিউনিসিয়া ও মিসরের গণবিদ্রোহের আঁচ সৌদি আরব, কুয়েত, জর্ডান প্রভৃতি আরব দেশকে কার্যকরভাবে স্পর্শ করেনি। কিন্তু করেছে সেই সব একনায়কী শাসনের দেশকে, যেগুলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যেমন_লিবিয়া ও সিরিয়া। এর কূট ব্যাখ্যা কী? তা একটাই। ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো চলবে না। দাঁড়ালে কূটকৌশলের অন্তর্ঘাত, গণতন্ত্রের জন্য বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। তারপর পেছন থেকে সমর্থন। লক্ষ্য অবশ্য গণতন্ত্রের বিনিময়ে অবাধ তেলসম্পদের অধিকার। আর সে কূটযুদ্ধে জয়ী হতে হলে দরকার শাসনযন্ত্রে ভাঙন ধরানো। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উপপ্লব আর সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস। গাদ্দাফির শাসনব্যবস্থা যদি এ দিক থেকে নিশ্ছিদ্রই হবে, তাহলে তাঁর তেলমন্ত্রী পালিয়ে গিয়ে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের আহ্বান জানান কিভাবে (১ জুন, ২০১১)। অর্থাৎ ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এরপর পরাশক্তিদের তৎপরতা আরো বাড়ে। বাড়ে বেনগাজিতে স্থাপিত কেন্দ্রটি ঘিরে। অর্থ আর অস্ত্র কী না করতে পারে? এরপর নৈতিক সমর্থন জানানো হয় বিদ্রোহীদের এত দ্রুত দেশের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে (জুনের প্রথম সপ্তাহে)। বিদ্রোহীদের ওই সামান্য শক্তি কিভাবে গাদ্দাফির এত বড় সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে ত্রিপোলির দুর্গে প্রবেশ করতে পারল, সে রহস্য আন্দাজ করা চলে। আমাদের প্রশ্ন_এসব কি লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরাশক্তির অবৈধ হস্তক্ষেপ নয়?
গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের গলা কেটে পরিচালিত স্বৈরশাসনই যদি বিশ্ব মোড়লদের আপত্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে স্পেনে ফ্যাসিস্টদের বসানো ফ্রাংকোর স্বৈরশাসন গণতন্ত্রী ইউরোপ-আমেরিকা সহ্য করেছিল কিভাবে? চিলি বা ইন্দোনেশিয়ায় একনায়কী সামরিক শাসন দশকের পর দশক তাদের আশীর্বাদ নিয়েই তো চলেছে। দক্ষিণ আমেরিকায় এমন উদাহরণ অনেক, যা চে গুয়েভারার মতো বিশ্ববিপ্লবীর জন্ম দিয়েছিল। এখনো তো আরব বিশ্বে রাজতান্ত্রিক অনাচার পরাশক্তির মদদেই চলছে। তাহলে সে নিরিখে গাদাফির স্বৈরশাসনে আপত্তির সুযোগ কোথায়? এর কারণ একটাই। গাদ্দাফি ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তিবিরোধী। 'ইনডিপেনডেন্ট' পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন : 'খেলা শেষ হতে কত বাকি'? খেলা তো শেষ। এবার ট্রফি জেতার পালা। এভাবেই এরপর দামেস্ক হয়ে একের পর এক ট্রফি জেতা শেষ করতে পারলে পশ্চিমা নাগরিকের কী আনন্দ। আলজেরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে ভিসাবিহীন ভ্রমণ শেষে ইউরোপে প্রবেশ! তাঁর এ বক্তব্য অবশ্য কিছুটা ব্যঙ্গ-জারিত। এ সাংবাদিক একদা ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তির ইরাক আক্রমণের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু এখন প্রশ্ন_এরপর কী হবে? সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোবিহীন বহু মতের বহু চিন্তার বিদ্রোহী বাহিনী কি আদৌ কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পত্তন করতে পারবে? যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কিছুসংখ্যক লিবীয় নাগরিকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ, ক্রমে যেখানে অস্থানিক শক্তির ভৌতিক অনুপ্রবেশ এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, সে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কি আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে? নাকি ইরাকের মালিকির মতো পুতুল সরকার তৈরি হবে লিবিয়ায়? তখন তেলভাণ্ডারের মুক্ত অধিকার চলে যাবে পরাশক্তির হাতে।
কর্নেল গাদ্দাফি, রাজতন্ত্রবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শাসক হিসেবে তাঁর কাছে কিছুটা বিচক্ষণতা প্রত্যাশা করেছিল তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিমনস্ক মানুষ, কিন্তু তিনি তাদের হতাশ করেছেন। গত ৪০ বছরের শাসনে কোনো ইতিবাচক ভূমিকার ভুক্তি নেই তাঁর কর্মপঞ্জিতে। নাসেরের গণতান্ত্রিক আরব জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন কিংবা ইরাকের করিম কাসেমদের সমাজবাদের স্বপ্ন_কোনোটাই তো অঙ্কুরিত হয়নি আরব ভূমিতে_এ দিক থেকে তার বেদুইন সারল্যও ব্যর্থ। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা হয়ে উঠেছে এক অকার্যকর রাজনীতি। জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাম দিয়ে লিবিয়ায় গড়ে তোলা হয় একনায়কী শাসন। তা সত্ত্বেও এ কথা তো ঠিক, কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, তা ঠিক করবে সে দেশের জনগণ। লিবিয়ায় সংঘটিত বিদ্রোহ মূলত ব্যক্তি গাদ্দাফির একনায়কী শাসনের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহীদের হিসাব-নিকাশে রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ধরে নেওয়া যায়, একটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তাদের কাম্য। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যদি গৃহযুদ্ধই ধরা যায়, তাতে বিদেশি শক্তি নাক গলাবে কেন। ন্যাটোই বা লাগাতার বোমাবর্ষণ করে যাবে কোন অধিকারে?
এ প্রশ্নগুলো বড় একটা উঠছে না, পশ্চিমারা তো তুলবে না। কিন্তু তোলা উচিত তো তৃতীয় বিশ্বের পরাশক্তি-নিরপেক্ষ রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের। কারণ পরাশক্তির বশংবদ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গণহত্যার জন্য গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যে যুক্তিতে পরোয়ানা জারি করেছে, একই যুক্তিতে বিনা প্ররোচনায় অন্যের ভূখণ্ডে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মারার জন্য ন্যাটো-প্রধানের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া উচিত। উচিত অনুরূপ একাধিক ঘটনায় একই ব্যবস্থা গ্রহণ। আর একাত্তরে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া-নিয়াজি-টিক্কাদের বিরুদ্ধে অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল জাতিসংঘের। কিন্তু তারা তা করেনি এবং করে না। যেখানে ইউরোপ-মার্কিন স্বার্থ জড়িত, সেখানেই তারা সক্রিয়। সাম্রাজ্যবাদী এ অন্যায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে, চলবে_যত দিন তৃতীয় বিশ্ব একাট্টা হতে না পারবে, মাথা তুলে স্বাধীন সত্তা জানান দিতে না পারবে।
সর্বশেষ কথা, যেখানে তেলের ভাণ্ডার সেখানেই নানা উপলক্ষে পরাশক্তির সামরিক অভিযান এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিবিয়ায় বিজয়ী পক্ষ যখন শাসন-আসন নিয়ে ব্যস্ত, তখন নেপথ্যে পরাশক্তির জন্য প্রধান হয়ে উঠবে তেলের হিসাব-নিকাশ। আর্থিক মন্দার দিনে অভিযানের খরচ মিটিয়ে কত ঘরে উঠবে সে হিসাব।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
গাদ্দাফি কি সেই বয়সে পেঁৗছেছিলেন, যখন দূরেরটা তো বটেই, 'কাছেরটাও বিলক্ষণ ঝাপসা দেখায়?' তিনি দেখতে পাননি কী ঘটছে তাঁর চিরবিশ্বস্ত তাঁবুর ভেতরে এবং বাইরে। বাইরেরটা অবশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু পাত্তা দেননি। নিজের শক্তি ও সমর্থন সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। এবং এতটাই ছিলেন যে পতন অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতামদে আচ্ছন্ন থাকায় হুঙ্কার দিয়ে বলতে পেরেছেন, 'জভ্ জারি রহেগা'। যেমনটা একাত্তরের (১৯৭১) ডিসেম্বরে আমরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মুখে শুনেছি ঢাকা পতনের লগ্নে, যখন জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি শেষ।
আসলে এ আপ্তবাক্যের পঙ্ক্তি গাদ্দাফির জানা ছিল না, থাকার কথাও নয় যে 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?' তাই প্রলয় ঝড় তাঁবুতে ঢোকার দুদিন আগেও বিদ্রোহীদের ইঁদুর আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবারও বলি, ইঁদুরের দাঁতে যে কত শক্তি তা গাদ্দাফির ধারণায় ছিল না। দম্ভ মানুষকে অন্ধ করে, তাই বিদ্রোহীদের পেছনে বড় ইঁদুরের উপস্থিতি শক্তি হিসেবে গ্রাহ্যে আনেননি গাদ্দাফি। এমনকি বছর কয় আগেকার ঘটনায় সাদ্দাম হোসেনের পরিণতি দেখে শিক্ষা নেননি।
অবশ্য ইরাকের ঘটনা ভিন্ন হলেও পরাশক্তির কুটিল ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনাও তাঁকে সহিষ্ণু-বিচক্ষণতার শিক্ষা দেয়নি। তাঁর পরিণতি যদি সাদ্দামের মতো হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
প্রচলিত প্রবাদ, জাহাজ যখন ডুবতে শুরু করে তখন ইঁদুরই প্রথম পালাতে থাকে। গাদ্দাফির আত্মবিশ্বাস এমনই অন্ধ ছিল যে তাঁর তাঁবু থেকে ইঁদুর পালানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও কার্যকারণ হিসেবে মেলাতে চেষ্টা করেননি সর্বাধিনায়ক গাদ্দাফি। দুর্বল ঘরের শত্রু ও পরাক্রান্ত বাইরের শত্রুর সর্বাত্মক সমর্থন পেলে সে শক্তিকে হেলাফেলা করা চলে না। কিন্তু করেছেন কর্নেল গাদ্দাফি। কোনো প্রকার কূটনৈতিক বিচক্ষণতা তিনি আমলে আনেননি।
তাই এক এক করে ঘণ্টা বেজেছে। অনেক আরব রাষ্ট্রকে শত্রু বানিয়েছিলেন তিনি, কখনো শক্তির দম্ভে, কখনো আদর্শিক কারণে অর্থাৎ রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে যা ছিল সাদ্দামের ইরাক, আসাদের সিরিয়া এবং ইরানেরও লক্ষ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন বিরোধিতার বিষয়টি ছিল তাঁদের জন্য নেতিবাচক। তাই তাঁরা ওই লক্ষ্যে এক পা-ও এগোতে পারেননি। কূটনীতির কথা বলছি এ জন্য যে বিদ্রোহের শুরুতে ভিন্ন মেরুর হওয়া সত্ত্বেও আরব লিগ সরাসরি গাদ্দাফির লিবিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। বরং ঘটনার সমঝোতামূলক সমাধানই তারা চেয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি গাদ্দাফি। ইউরো-মার্কিন কূটনীতি ও সামরিক শক্তির (ন্যাটো) অবমূল্যায়ন করেছেন এই একনায়ক।
পরিণামে অভাবিত কিছুই ঘটেছে।
অভাবিত বলছি এ জন্য যে শুরুতে অনেকেরই ধারণা ছিল_গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না, বিদ্রোহ ব্যর্থ হবে। ইউরো-মার্কিন জোটের সামরিক, অর্থনৈতিক সাহায্যের পরও এমন ভাবনার বাস্তব কারণ ছিল বলে মনে হয় না। গাদ্দাফির সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ফরিদ জাকারিয়া, যাঁর সাংবাদিকতার খ্যাতি বিখ্যাত 'টাইম' ম্যাগাজিন ও 'সিএনএন' টিভির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ঘিরে_বলেছিলেন, গাদ্দাফি আত্মসমর্পণ করবেন না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন।'
কিন্তু সে ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি। বিদ্রোহীরা ঠিকই মুয়াম্মার গাদ্দাফির দুর্ভেদ্য ভবনে ঢুকে পড়েছে এবং গাদ্দাফির গোপন ট্যানেল, যে ট্যানেলের অস্তিত্ব অনেকেরই জানা। সন্দেহ নেই, গাদ্দাফি আফ্রিকা ও আরববিশ্বের একনায়কদের তুলনায় ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যে একেবারেই আলাদা। তবু তিনি পতন আসন্ন জেনে চিলির আলেন্দের মতো অস্ত্র হাতে শহীদ হওয়ার বদলে ইঁদুরের মতোই গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছেন বা পালিয়ে গেছেন, মুখোমুখি যুদ্ধের সম্মুখীন না হয়ে। তাতে কি সাদ্দামের অনুরূপ পরিণতি ঠেকানো যাবে?
যাবে না। কারণ সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি যাদের শত্রু তাদের স্বার্থবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের শেষ করতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে জানে। একের পর এক ফাঁদ পাতে, তারপর ক্লান্তিহীন অপেক্ষা_কখন সুযোগ আসবে বা উপলক্ষ তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে উপলক্ষ তৈরি হয় মিসরীয় স্বৈরশাসকের পতনের পর গত ফেব্রুয়ারিতে ওই ধারাবাহিকতায় যখন লিবিয়ায় প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়। আর কথিত গণতন্ত্রের দাবিতে অনুষ্ঠিত সে শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে অদূরদর্শী মোকাবিলায় গাদ্দাফি বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ অশান্তির দিকে ঠেলে দেয়। ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট_এই দীর্ঘ সময়ে সমঝোতার অনেক পথ খোলা ছিল। কিন্তু গাদ্দাফির সাফ কথা_'হয় ক্ষমতায় থাকব, না হয় শহীদ হব।' মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। তবু প্রশ্ন : এ সমাবেশ কি একেবারে নিরীহ ঘটনা, নাকি এতে বাইরের ইন্ধন ছিল? মানবাধিকার কর্মীর উপস্থিতি তেমনই ইঙ্গিত দেয়।
কর্নেল গাদ্দাফি ১৯৬৯ সালে লিবিয়ায় রাজতন্ত্র উৎখাত করে ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি যেমন বেদুইন সন্তান, তেমনি তাঁর সহযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাদের সবাই দরিদ্র গোত্র থেকে উঠে আসা মানুষ। তাঁদের বরাবরের স্বপ্ন_আরব বিশ্ব থেকে রজতন্ত্রের বিলোপ। কিন্তু যাদের খুঁটি ইউরো-মার্কিন পরাশক্তি, তাদের ভূখণ্ডে সামাজিক শক্তির উত্থান না ঘটলে রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব হয় না। আশ্চর্য যে তিউনিসিয়া ও মিসরের গণবিদ্রোহের আঁচ সৌদি আরব, কুয়েত, জর্ডান প্রভৃতি আরব দেশকে কার্যকরভাবে স্পর্শ করেনি। কিন্তু করেছে সেই সব একনায়কী শাসনের দেশকে, যেগুলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যেমন_লিবিয়া ও সিরিয়া। এর কূট ব্যাখ্যা কী? তা একটাই। ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো চলবে না। দাঁড়ালে কূটকৌশলের অন্তর্ঘাত, গণতন্ত্রের জন্য বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। তারপর পেছন থেকে সমর্থন। লক্ষ্য অবশ্য গণতন্ত্রের বিনিময়ে অবাধ তেলসম্পদের অধিকার। আর সে কূটযুদ্ধে জয়ী হতে হলে দরকার শাসনযন্ত্রে ভাঙন ধরানো। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উপপ্লব আর সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস। গাদ্দাফির শাসনব্যবস্থা যদি এ দিক থেকে নিশ্ছিদ্রই হবে, তাহলে তাঁর তেলমন্ত্রী পালিয়ে গিয়ে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের আহ্বান জানান কিভাবে (১ জুন, ২০১১)। অর্থাৎ ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এরপর পরাশক্তিদের তৎপরতা আরো বাড়ে। বাড়ে বেনগাজিতে স্থাপিত কেন্দ্রটি ঘিরে। অর্থ আর অস্ত্র কী না করতে পারে? এরপর নৈতিক সমর্থন জানানো হয় বিদ্রোহীদের এত দ্রুত দেশের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে (জুনের প্রথম সপ্তাহে)। বিদ্রোহীদের ওই সামান্য শক্তি কিভাবে গাদ্দাফির এত বড় সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে ত্রিপোলির দুর্গে প্রবেশ করতে পারল, সে রহস্য আন্দাজ করা চলে। আমাদের প্রশ্ন_এসব কি লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরাশক্তির অবৈধ হস্তক্ষেপ নয়?
গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের গলা কেটে পরিচালিত স্বৈরশাসনই যদি বিশ্ব মোড়লদের আপত্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে স্পেনে ফ্যাসিস্টদের বসানো ফ্রাংকোর স্বৈরশাসন গণতন্ত্রী ইউরোপ-আমেরিকা সহ্য করেছিল কিভাবে? চিলি বা ইন্দোনেশিয়ায় একনায়কী সামরিক শাসন দশকের পর দশক তাদের আশীর্বাদ নিয়েই তো চলেছে। দক্ষিণ আমেরিকায় এমন উদাহরণ অনেক, যা চে গুয়েভারার মতো বিশ্ববিপ্লবীর জন্ম দিয়েছিল। এখনো তো আরব বিশ্বে রাজতান্ত্রিক অনাচার পরাশক্তির মদদেই চলছে। তাহলে সে নিরিখে গাদাফির স্বৈরশাসনে আপত্তির সুযোগ কোথায়? এর কারণ একটাই। গাদ্দাফি ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তিবিরোধী। 'ইনডিপেনডেন্ট' পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন : 'খেলা শেষ হতে কত বাকি'? খেলা তো শেষ। এবার ট্রফি জেতার পালা। এভাবেই এরপর দামেস্ক হয়ে একের পর এক ট্রফি জেতা শেষ করতে পারলে পশ্চিমা নাগরিকের কী আনন্দ। আলজেরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে ভিসাবিহীন ভ্রমণ শেষে ইউরোপে প্রবেশ! তাঁর এ বক্তব্য অবশ্য কিছুটা ব্যঙ্গ-জারিত। এ সাংবাদিক একদা ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তির ইরাক আক্রমণের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু এখন প্রশ্ন_এরপর কী হবে? সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোবিহীন বহু মতের বহু চিন্তার বিদ্রোহী বাহিনী কি আদৌ কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পত্তন করতে পারবে? যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কিছুসংখ্যক লিবীয় নাগরিকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ, ক্রমে যেখানে অস্থানিক শক্তির ভৌতিক অনুপ্রবেশ এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, সে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কি আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে? নাকি ইরাকের মালিকির মতো পুতুল সরকার তৈরি হবে লিবিয়ায়? তখন তেলভাণ্ডারের মুক্ত অধিকার চলে যাবে পরাশক্তির হাতে।
কর্নেল গাদ্দাফি, রাজতন্ত্রবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শাসক হিসেবে তাঁর কাছে কিছুটা বিচক্ষণতা প্রত্যাশা করেছিল তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিমনস্ক মানুষ, কিন্তু তিনি তাদের হতাশ করেছেন। গত ৪০ বছরের শাসনে কোনো ইতিবাচক ভূমিকার ভুক্তি নেই তাঁর কর্মপঞ্জিতে। নাসেরের গণতান্ত্রিক আরব জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন কিংবা ইরাকের করিম কাসেমদের সমাজবাদের স্বপ্ন_কোনোটাই তো অঙ্কুরিত হয়নি আরব ভূমিতে_এ দিক থেকে তার বেদুইন সারল্যও ব্যর্থ। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা হয়ে উঠেছে এক অকার্যকর রাজনীতি। জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাম দিয়ে লিবিয়ায় গড়ে তোলা হয় একনায়কী শাসন। তা সত্ত্বেও এ কথা তো ঠিক, কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, তা ঠিক করবে সে দেশের জনগণ। লিবিয়ায় সংঘটিত বিদ্রোহ মূলত ব্যক্তি গাদ্দাফির একনায়কী শাসনের বিরুদ্ধে, বিদ্রোহীদের হিসাব-নিকাশে রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ধরে নেওয়া যায়, একটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তাদের কাম্য। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যদি গৃহযুদ্ধই ধরা যায়, তাতে বিদেশি শক্তি নাক গলাবে কেন। ন্যাটোই বা লাগাতার বোমাবর্ষণ করে যাবে কোন অধিকারে?
এ প্রশ্নগুলো বড় একটা উঠছে না, পশ্চিমারা তো তুলবে না। কিন্তু তোলা উচিত তো তৃতীয় বিশ্বের পরাশক্তি-নিরপেক্ষ রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের। কারণ পরাশক্তির বশংবদ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গণহত্যার জন্য গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যে যুক্তিতে পরোয়ানা জারি করেছে, একই যুক্তিতে বিনা প্ররোচনায় অন্যের ভূখণ্ডে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মারার জন্য ন্যাটো-প্রধানের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া উচিত। উচিত অনুরূপ একাধিক ঘটনায় একই ব্যবস্থা গ্রহণ। আর একাত্তরে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া-নিয়াজি-টিক্কাদের বিরুদ্ধে অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল জাতিসংঘের। কিন্তু তারা তা করেনি এবং করে না। যেখানে ইউরোপ-মার্কিন স্বার্থ জড়িত, সেখানেই তারা সক্রিয়। সাম্রাজ্যবাদী এ অন্যায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে, চলবে_যত দিন তৃতীয় বিশ্ব একাট্টা হতে না পারবে, মাথা তুলে স্বাধীন সত্তা জানান দিতে না পারবে।
সর্বশেষ কথা, যেখানে তেলের ভাণ্ডার সেখানেই নানা উপলক্ষে পরাশক্তির সামরিক অভিযান এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিবিয়ায় বিজয়ী পক্ষ যখন শাসন-আসন নিয়ে ব্যস্ত, তখন নেপথ্যে পরাশক্তির জন্য প্রধান হয়ে উঠবে তেলের হিসাব-নিকাশ। আর্থিক মন্দার দিনে অভিযানের খরচ মিটিয়ে কত ঘরে উঠবে সে হিসাব।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
No comments