বিশ্ব মানবাধিকার দিবস-বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি-আজকের পর্যালোচনা

০১১ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি ঘটে থাকলেও সার্বিক অবস্থা ছিল উদ্বেগজনক। যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া চলছে, জাতীয় নারীনীতি ২০১১ অনুমোদিত হয়েছে, মামলার জট কমাতে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনি সহায়তা প্রদানের করার জন্য ‘আইন সহায়তা (সংশোধিত) প্রদান বিল ২০১১’ জাতীয় সংসদে পাস হয়।


নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)-এর আওতায় সরকারের পক্ষ থেকে রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। অন্যদিকে নেতিবাচক পদক্ষেপগুলোর তালিকায় রয়েছে—বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও সংশোধিত হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন, দেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও পাস হয় ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১। পাস হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করা বিতর্কিত ‘ডিসিসি আইন ২০১১’।
অন্যদিকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে (ট্রুথ কমিশন) অবৈধ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। এ ছাড়া উচ্চ আদালত কর্তৃক ফতোয়াকে আইনবহির্ভূত ঘোষণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়। এ ধরনের কিছু ভালো সিদ্ধান্ত এসেছে যা ইতিবাচক। অথচ এসব উদ্যোগের ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তথা ক্রসফায়ার নেই—সরকার বারবার এ কথা বলে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর ফলে মৃত্যু ঘটে—এ ধরনের যুক্তি দেখিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমর্থন এ বছরও করে গেছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৮৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হেফাজতে থাকা অবস্থায় বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। পাশাপাশি কারা-হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত কারা-হেফাজতে মৃত্যু হয় ৯৪ জনের। তা ছাড়া নতুন প্রবণতা হিসেবে নিখোঁজ বা ‘গুপ্তহত্যা’র ঘটনা ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অনেক ক্ষেত্রে নিখোঁজ অথবা গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, তাদেরকে র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পূর্বেই তুলে নিয়ে গেছে।
চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। যেমন—নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে ১৬ বছরের শামছুদ্দিন মিলনকে পুলিশ জনতার হাতে তুলে দিয়ে তথাকথিত গণপিটুনির নামে হত্যা করে। শবেবরাতের রাতে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামে (বালুর মাঠ) গেলে স্থানীয় গ্রামবাসী পুলিশের উপস্থিতিতে সাত ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দেয় এবং এতে ছয়জন মারা যায়। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত ১১৭ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছে। তা ছাড়া ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবদুল কাদেরকে খিলগাঁও থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁর পায়ে কুপিয়ে চালিয়েছেন বর্বর নির্যাতন। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন এবং গঠিত তদন্ত কমিটি কাদেরকে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেয়। এ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদার মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন—জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই) দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন তিন ডিবি কর্মকতা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা এবং তার ফলে গণপিটুনির শিকার হয়ে অনেকগুলো মৃত্যুর ঘটনা নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদাহরণ।
ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর (বিএসএফ) পক্ষ থেকে সীমান্তে নিরীহ ব্যক্তির উপর ওপর আর গুলি চালানো হবে না বলে বারবার আশ্বাস প্রদান সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ৭ জানুয়ারি ২০১১ কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে ভোররাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি নাগরিক ফেলানি নিহত হয়।
২০১১ সালে বখাটেদের দ্বারা নারী উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে যদিও, সরকার ও প্রশাসনের তরফ থেকে নানামুখী প্রতিরোধমূলক উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। এমনকি প্রতিবাদকারীরাও বখাটেদের রোষানলে পড়ছেন। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০ জন পুরুষ ও তিন জন নারী খুন হন। ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্ত করার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩ জন নারী। ফতোয়া ও সালিসের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের ঘটনা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত সালিস ও ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৯ জন নারী। পাশাপাশি এ বছর তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ওপর যৌন হয়রানির প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বছর বিরোধী দল অক্টোবর পর্যন্ত নয়টি হরতাল পালন করে। হরতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা বা হরতালের আগে গণগ্রেপ্তারের ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি হরতালের আগে ও পরে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
লক্ষ্মীপুরের বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগের নেতা তাহেরের ছেলে বিপ্লবের শাস্তি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মওকুফের ঘটনা ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকেরা সরকার ও বিরোধী দলের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব ও অঙ্গীকারকে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও মূল সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে তেমন অগ্রগতি নেই। আর এই ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে তিনজন মারা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি উত্তরণে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এপ্রিল ২০০৯ থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্যপদ শূন্য ছিল। দীর্ঘদিন পর ২২ জুন ২০১০ সরকার চেয়ারম্যান ও অন্য ছয়জন কমিশনার নিয়োগদানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু কমিশন ৬৮ জন জনবলের প্রয়োজনীয়তা জানালেও সরকার এখন পর্যন্ত ২৮ জন স্টাফ নিয়োগ দিয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশ সাপোর্ট স্টাফ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) একটি মানবাধিকার ও আইন সহায়তা সংগঠন।

No comments

Powered by Blogger.