শ্রদ্ধাঞ্জলি-সাদা শাড়ি পরার শখ মিটল না তাঁর by তাসনিম সিদ্দিকী
সুতির সাদা শাড়ি আমার ভারি পছন্দ। কিন্তু সাদা শাড়িতে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখলে ঠোঁটে হাসি নিয়ে ভুরু কুচকে মৃদু তিরস্কার করে রাজিয়া আপা বলতেন, ‘তাসনিম, সাদা শাড়ি কেন পরেছ? কত দিন পড়ে আছে সাদা শাড়ি পরার জন্য, এখন শুধু রঙিন শাড়ি পরবে। তোমার স্যার আমাকে কখনো সাদা শাড়ি পরতে দেন না।
বলেন, আমি কি মরে গেছি নাকি?’ সাদা শাড়ি পরার শখটা মেটাতে পারলেন না আমার শিক্ষিকা, আমার অগ্রজ, আমার দীর্ঘ ২৬ বছরের সহকর্মী ড. ইউ এ বি রাজিয়া আক্তার বানু।
রাজিয়া আপার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। মন চলে গিয়েছিল ২৯ বছর পেছনে, বিদেশফেরত সদ্য যোগ দেওয়া শিক্ষিকা রাজিয়া আক্তার বানুর টিউটোরিয়াল ক্লাসে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী। অপরিচিত এই শিক্ষিকার টিউটোরিয়াল ক্লাস করতে হবে ভেবে খুব একটা খুশি ছিলাম না। কারণ, সে সময়ের পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক মূল্যবোধ একজন পুরুষ শিক্ষকের স্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে যোগদানকে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করত না। আমিও সেই মন নিয়েই ঢুকেছিলাম তাঁর ক্লাসে। তাঁর কাছ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানচর্চার আনন্দ খুব বেশি পাব বলে আশা করিনি। ক্লাস শেষে যখন বের হলাম, হাতে আমার লরেন্স লিফশুলজ অথবা অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সদ্য প্রকাশিত বই। বইগুলো কি অনায়াসে তিনি আমাকে বাসায় নিতে দিলেন। সারা রাত জেগে পড়লাম সেগুলো। জানার সে কী উত্তেজনা! তাঁর টিউটোরিয়াল ক্লাস আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠল। এতকালের পড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো তখনকার বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাখ্যায় প্রয়োগ আমাদের দারুণ উত্তেজক এক খেলায় পরিণত হলো। রাজিয়া আপা ভালো শিক্ষক হিসেবে জায়গা করে নিলেন আমার মনে। আজ হঠাৎ বুঝতে পারছি, আমার ভেতর তত্ত্বের আলোকে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যার চোখ তৈরিতে তাঁর একটা অবদান ছিল!
রাজিয়া আপার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল তাঁর স্বামী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জার্মানির ই-জেবরিল থেকে বের হয় তাঁর থিসিসটা। বইয়ের নাম Islam in Bangladesh। ডিপার্টমেন্টে ‘এথনিসিটি, রিলিজিয়ন এবং পলিটিক্স’-এর ওপর কোর্স চালু করেছিলেন তিনি। তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডের সোয়াশে থেকে পিএইচডি করেছিলেন। স্যার ছিলেন দেশে, তবু অনেক তথাকথিত আলোকিত ব্যক্তিও ভাবতে চাইতেন না, স্বনামধন্য স্বামীর স্ত্রীরাও নিজ যোগ্যতায় তাঁদের জ্ঞানের জগৎ প্রসারিত করতে পারেন। আশির দশকে আমি এবং আমার সহধর্মী প্রফেসর আবরার একই সঙ্গে পিএইচডি করি। তখন আমাকেও অনেকে বলেছেন, আমার স্বামী নিশ্চয়ই অনেকখানি কাজ এগিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন বহু শিক্ষক আছেন, যাঁরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। আজকে এমন কথা তাঁদের আর শুনতে হয় না। বলতেই হবে, আমাদের সমাজ কিছুটা হলেও এগিয়েছে।
১৯৮৪ সালে বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। দীর্ঘ ২৬ বছর তাঁকে পেয়েছি সহকর্মী হিসেবে। বসেছি কত একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে, কত পরীক্ষা কমিটিতে। আমাদের বিভাগের পরীক্ষার ফল নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি হয়, গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ তো ওঠেনি, বরং তাঁকে দেখেছি যারা পড়াশোনা করতে চায়, তাদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি সম্ভাবনাময় ছাত্র দীর্ঘদিন ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। রাজিয়া আপা একদিন রাস্তায় তাকে দেখেন। তাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে আসেন নিজের কক্ষে। অনেক বুঝিয়ে তাকে ফেরত আনেন পড়াশোনার জগতে এবং আজ সে প্রতিষ্ঠিত। কোনোরকম বিতর্ক ছাড়াই এর সঙ্গে তিনি পালন করেছিলেন শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব। কয়েক বছর ধরে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির মিটিংগুলোতে কোনো কোনো শিক্ষকের ভিন্ন মত প্রকাশের ধরনগুলো ভীষণভাবে বদলে গেছে। বাক্য উচ্চারণে একের প্রতি অন্যের অশ্রদ্ধা বড় প্রকট হয়ে উঠেছে। রাজিয়া আপার ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মধ্যস্থতাকারীর।
বাংলাদেশের সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রফেসর তালুকদার মনিরুজ্জামানের নাম সবার আগে। তাঁর কাছ থেকে দেশ পেয়েছে বহু গবেষণা গ্রন্থ। স্যারের এই বিশাল অর্জনে রাজিয়া আপার ভূমিকা বোধ হয় কেউ জানে না। স্বামীর প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও ভালোবাসার মধ্যে মিশে ছিল গুরুভক্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারের প্রশস্ত বারান্দাগুলোতে সিগারেট মুখে পায়চারি করতে করতে ডিক্টেশন দিতেন স্যার, আর রাজিয়া আপা তা লিখতেন, টাইপ করতেন। তারপর স্যার এর ওপর কাজ করতেন। এই আপনভোলা কর্মপাগল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সবটুকু কাজ সহজ করে দিয়েছিলেন রাজিয়া আপা।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কাউকে কোনো কষ্ট না দিয়ে মাত্র ২৫ দিনের মাথায় চলে গেলেন তিনি। রাজিয়া আপা একাধারে একজন গবেষক, জ্ঞানপিপাসু স্বামীর সহযোদ্ধা, সংবেদনশীল সহকর্মী, সার্থক মা এবং শাশুড়ি। কিন্তু সব ছাপিয়ে তাঁর পরিচয় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নতুন প্রভাষকদের জন্য তিনি একজন স্বচ্ছ, সৎ ও সাদা মানুষের উদাহরণ।
তাসনিম সিদ্দিকী: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, রামরু।
রাজিয়া আপার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। মন চলে গিয়েছিল ২৯ বছর পেছনে, বিদেশফেরত সদ্য যোগ দেওয়া শিক্ষিকা রাজিয়া আক্তার বানুর টিউটোরিয়াল ক্লাসে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী। অপরিচিত এই শিক্ষিকার টিউটোরিয়াল ক্লাস করতে হবে ভেবে খুব একটা খুশি ছিলাম না। কারণ, সে সময়ের পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক মূল্যবোধ একজন পুরুষ শিক্ষকের স্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে যোগদানকে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করত না। আমিও সেই মন নিয়েই ঢুকেছিলাম তাঁর ক্লাসে। তাঁর কাছ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানচর্চার আনন্দ খুব বেশি পাব বলে আশা করিনি। ক্লাস শেষে যখন বের হলাম, হাতে আমার লরেন্স লিফশুলজ অথবা অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সদ্য প্রকাশিত বই। বইগুলো কি অনায়াসে তিনি আমাকে বাসায় নিতে দিলেন। সারা রাত জেগে পড়লাম সেগুলো। জানার সে কী উত্তেজনা! তাঁর টিউটোরিয়াল ক্লাস আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠল। এতকালের পড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো তখনকার বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাখ্যায় প্রয়োগ আমাদের দারুণ উত্তেজক এক খেলায় পরিণত হলো। রাজিয়া আপা ভালো শিক্ষক হিসেবে জায়গা করে নিলেন আমার মনে। আজ হঠাৎ বুঝতে পারছি, আমার ভেতর তত্ত্বের আলোকে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যার চোখ তৈরিতে তাঁর একটা অবদান ছিল!
রাজিয়া আপার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল তাঁর স্বামী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জার্মানির ই-জেবরিল থেকে বের হয় তাঁর থিসিসটা। বইয়ের নাম Islam in Bangladesh। ডিপার্টমেন্টে ‘এথনিসিটি, রিলিজিয়ন এবং পলিটিক্স’-এর ওপর কোর্স চালু করেছিলেন তিনি। তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডের সোয়াশে থেকে পিএইচডি করেছিলেন। স্যার ছিলেন দেশে, তবু অনেক তথাকথিত আলোকিত ব্যক্তিও ভাবতে চাইতেন না, স্বনামধন্য স্বামীর স্ত্রীরাও নিজ যোগ্যতায় তাঁদের জ্ঞানের জগৎ প্রসারিত করতে পারেন। আশির দশকে আমি এবং আমার সহধর্মী প্রফেসর আবরার একই সঙ্গে পিএইচডি করি। তখন আমাকেও অনেকে বলেছেন, আমার স্বামী নিশ্চয়ই অনেকখানি কাজ এগিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন বহু শিক্ষক আছেন, যাঁরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। আজকে এমন কথা তাঁদের আর শুনতে হয় না। বলতেই হবে, আমাদের সমাজ কিছুটা হলেও এগিয়েছে।
১৯৮৪ সালে বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। দীর্ঘ ২৬ বছর তাঁকে পেয়েছি সহকর্মী হিসেবে। বসেছি কত একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে, কত পরীক্ষা কমিটিতে। আমাদের বিভাগের পরীক্ষার ফল নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি হয়, গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ তো ওঠেনি, বরং তাঁকে দেখেছি যারা পড়াশোনা করতে চায়, তাদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি সম্ভাবনাময় ছাত্র দীর্ঘদিন ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। রাজিয়া আপা একদিন রাস্তায় তাকে দেখেন। তাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে আসেন নিজের কক্ষে। অনেক বুঝিয়ে তাকে ফেরত আনেন পড়াশোনার জগতে এবং আজ সে প্রতিষ্ঠিত। কোনোরকম বিতর্ক ছাড়াই এর সঙ্গে তিনি পালন করেছিলেন শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব। কয়েক বছর ধরে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির মিটিংগুলোতে কোনো কোনো শিক্ষকের ভিন্ন মত প্রকাশের ধরনগুলো ভীষণভাবে বদলে গেছে। বাক্য উচ্চারণে একের প্রতি অন্যের অশ্রদ্ধা বড় প্রকট হয়ে উঠেছে। রাজিয়া আপার ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মধ্যস্থতাকারীর।
বাংলাদেশের সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রফেসর তালুকদার মনিরুজ্জামানের নাম সবার আগে। তাঁর কাছ থেকে দেশ পেয়েছে বহু গবেষণা গ্রন্থ। স্যারের এই বিশাল অর্জনে রাজিয়া আপার ভূমিকা বোধ হয় কেউ জানে না। স্বামীর প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও ভালোবাসার মধ্যে মিশে ছিল গুরুভক্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারের প্রশস্ত বারান্দাগুলোতে সিগারেট মুখে পায়চারি করতে করতে ডিক্টেশন দিতেন স্যার, আর রাজিয়া আপা তা লিখতেন, টাইপ করতেন। তারপর স্যার এর ওপর কাজ করতেন। এই আপনভোলা কর্মপাগল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সবটুকু কাজ সহজ করে দিয়েছিলেন রাজিয়া আপা।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কাউকে কোনো কষ্ট না দিয়ে মাত্র ২৫ দিনের মাথায় চলে গেলেন তিনি। রাজিয়া আপা একাধারে একজন গবেষক, জ্ঞানপিপাসু স্বামীর সহযোদ্ধা, সংবেদনশীল সহকর্মী, সার্থক মা এবং শাশুড়ি। কিন্তু সব ছাপিয়ে তাঁর পরিচয় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নতুন প্রভাষকদের জন্য তিনি একজন স্বচ্ছ, সৎ ও সাদা মানুষের উদাহরণ।
তাসনিম সিদ্দিকী: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, রামরু।
No comments