শেয়ারবাজার-সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে
গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ধসের পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বাজার স্বাভাবিক করায় সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন বা এসইসি এবং বাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। কেন বিপর্যয়, তা তদন্ত করার জন্য সরকার কমিটি গঠন করেছিল এবং তাদের প্রতিবেদনও তৈরি হয় এপ্রিল মাসে। অর্থমন্ত্রী সে সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিপর্যয়ের জন্য দায়ীদের বিচার করা হবে।
এসইসি পুনর্গঠন, তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা এবং কিছু নতুন বিধিবিধান প্রণয়ন ছিল এরই ধারাবাহিকতা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নতুন করে বিনিয়োগ, বিশেষ তহবিল গঠন এবং বিনিয়োগকারীদের সহজশর্তে ঋণ প্রদান করবে বলেও ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস্তবে এসব পদক্ষেপ বাজার স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ। যার প্রতিফলন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে মতিঝিল-দিলকুশার পথে পথে। মিছিল-সমাবেশ, ভাংচুর এমনকি অনশনের ঘটনা নিত্যদিনের হয়ে পড়েছে। এ ধরনের কর্মসূচিতে শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে এবং বিনিয়োগকারীদের লোকসানের ধারা উল্টোমুখী করবে_ এমন ধারণা আদৌ ঠিক নয়। শেয়ারবাজার সার্বিক অর্থনীতিরই অংশ। অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ পূরণ করে চললে সেকেন্ডারি মার্কেটের প্রতি আস্থা বাড়বেই। কোনো কোম্পানি যেন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা এসইসির মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব। স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও দায়িত্ব লেনদেনের স্বচ্ছতা বজায় রাখা। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান যেন সংকীর্ণ স্বার্থে বাজার বিকৃত করতে না পারে তার ওপর সম্মিলিত নজরদারি থাকতে হবে। ১৯৯৬ সালের শেষদিকে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধসের অভিজ্ঞতাও মনে রাখা চাই। তখনও তদন্ত কমিটি গঠন এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে স্টক এক্সচেঞ্জের অটোমেশনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিপর্যয় থেকে স্পষ্ট যে, লেনদেনে আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা চালু হলেই বাজারে কারসাজি বন্ধ করা যায় না। অসৎ লোকেরা বাজারে সক্রিয় থাকে এবং সুযোগ পেলেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে। অটোমেশনের মতো পদক্ষেপের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে এবং নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতেই হবে। তবে সরকার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মূল জোর দিতে হবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ওপর। কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যে বিনিয়োগের পথে যে কোনো বাধা সহজে যেন দূর করা যায়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে লাভজনক কোম্পানিগুলো ক্রমাগত তালিকাভুক্ত হতে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লাভের সুফল পেতে থাকলে সেকেন্ডারি মার্কেটে ইতিবাচক প্রভাব পড়বেই। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং আইনের শাসন কায়েমও অপরিহার্য শর্ত। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা যখন ভঙ্গুর তখন দ্ব্যর্থবোধক কিংবা বিভ্রান্তিকর সংকেত যেন প্রদান করা না হয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা বেসামাল অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তার ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতা লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলে তাতে অর্থনীতির মঙ্গলই হবে। অস্থির বাজারের সুযোগ নিয়ে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, তাদের নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে।
No comments