স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃত সমান by ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
মানুষ যা ভাবে তার কোনো কোনোটি মস্তিষ্কে বিশেষ রেখাপাত করে। এর একটি ছায়ারূপ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখে। আবার মানুষ কল্পনায়ও স্বপ্ন দেখে। সুন্দর কল্পনাগুলো তার সুখস্বপ্ন। স্বপ্ন থাকে বলেই একজন উদ্যমী কর্মবীর লক্ষ্যে পেঁৗছতে চেষ্টা করে। অন্যদিকে নানা ব্যর্থতায় হতাশা নেমে এলে এগিয়ে চলার পথ তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
বাস্তবে তার চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হওয়ার নয় ভেবে স্বপ্ন বুনে মনের ইচ্ছেগুলো পূরণ করে নিতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনন্যোপায় হয়ে কল্পনায় ইচ্ছে পূরণের সুখস্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন-১ : জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন আর মুখে মুখে শুধু হুঙ্কার নয়, বাস্তবায়ন করা হবে। তাই প্রথমে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ওপর কঠিন সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করেছে। চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি আর সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-যুবলীগ নেতাদের দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এসব চাঁদার ভাগ কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যাঁরা যাঁরা গ্রহণ করতেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে তাঁদেরও। যেসব দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের তত্ত্বাবধানে দখলবাণিজ্য ও মাস্তানি চলছে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করাসহ নানা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ঘোষণা করা হয়েছে, অভিযুক্ত সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরবর্তী সময়ে আর দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের এই কঠোর নীতিকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধুবাদ জানাচ্ছে। এই বাস্তবতা দেখে বিমর্ষ বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতা-নেত্রীরা জরুরি বৈঠকে বসেছেন। দলের অস্তিত্ব রক্ষায় ইতিবাচক প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে তাঁদেরও। আওয়ামী লীগের আদলে তাঁরাও নিজ দলে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা এবং নতুন নীতি নির্ধারণে ঐকমত্যে পেঁৗছেছেন।
স্বপ্ন-২ : আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলই কোনো অন্ধকার পথে নয়, প্রকৃত জনসমর্থন আদায়ের মধ্য দিয়ে জননন্দিত দলে পরিণত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এসব দলের নেতা-নেত্রীরা অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন, দল পরিচালনা ও নির্বাচনে বেশুমার টাকার ব্যবহার করতে গিয়ে উভয় দলের নেতা-নেত্রীদের আপস করতে হয়েছে দুর্নীতির সঙ্গে। দলীয় ফাণ্ড বৃদ্ধি করতে তাদের নির্ভর করতে হয়েছে অসৎ ব্যবসায়ী আর ঘুষখোর আমলাদের ওপর। এ কারণে এসব ব্যবসায়ী ও আমলাদের অনেক অনৈতিক আবদার দলগুলোকে মেটাতে হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রকৃত রাজনীতিকদের কোণঠাসা করে এসব ভুঁইফোঁড় ব্যবসায়ী আর আমলাদের অনেককে সংসদ সদস্য বানিয়ে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী বানিয়ে পার্টি ফাণ্ডে দেয় চাঁদার শতগুণ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এত দিনে আ@ে@@@াপলব্ধি হয়েছে দলগুলোর। নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে এই অসুস্থতা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে না। তাই দুই বড় দলই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতেই রাজনীতি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অর্থ শক্তিতে নয়, জনকল্যাণের শক্তিতেই মানুষের মনোরঞ্জন করবে দলগুলো। অতএব পার্টি-ফাণ্ড অনৈতিকভাবে প্রকাণ্ড করার প্রয়োজন নেই।
স্বপ্ন-৩ : আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় অপচয় রোধে গেজেট প্রকাশ করেছে। ঘোষণা হয়েছে সরকারি বা বিরোধী দল, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাষিত বা সামরিক অঞ্চল কোথাও ঘটা করে অমুক-তমুকের সম্মানে বিপুল আয়োজন ও খরচে ইফতার পার্টি এখন থেকে নিষিদ্ধ। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা গত রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজক সব সরকারি, বেসরকারি ও রাজনৈতিক দলের খরচের বাজেট সংগ্রহ করবে এবং পরবর্তী রমজানে কমপক্ষে সেই পরিমাণ অর্থ ইফতার আয়োজনের বদলে রাষ্ট্রীয় ফান্ডে জমা করবে। প্রতিবছর সেই টাকায় এক এক অঞ্চলের হতদরিদ্র জনগণের মধ্যে ঈদের পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হবে। সরকার বিশ্বাস করে, ইফতারের নামে এই অপচয়ের বদলে জনকল্যাণমুখী এ ধারার পদক্ষেপে সবারই সমর্থন থাকবে। সামাজিক এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যও তাতে পূরণ হবে। পরবর্তী সরকারগুলোর সময়ও তা অব্যাহত রাখা রেওয়াজে পরিণত হবে। একই সঙ্গে গেজেটের অন্য ধারায় বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আগমন উপলক্ষে অপ্রয়োজনীয় তোরণ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হবে। কারণ সরকার লক্ষ করেছে, এসব তোরণ নির্মাণের আড়ালে চাঁদাবাজি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যায় এবং দরিদ্র দেশের অর্থের অহেতুক অপচয় করা হয়।
স্বপ্ন-৪ : সব সরকারই আইন-আদালতের ওপর অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আসছে। এতে করে ক্রমে বিচারব্যবস্থার ওপর থেকে উঠে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের আস্থা। এই অবস্থা একটি অরাজক পরিবেশের সৃষ্টি করছে। দেশের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতার তিন বছরের মাথায় এসে মহাজোট সরকারের বোধোদয় হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছেন আদালতকে পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলার কলঙ্ক থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। এই সরকারের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আদালতকে দলীয়করণ মুক্ত রাখা হবে। যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সরকারি দল রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের মতো সুবিধাবাদী বন্য অবস্থার স্থায়ী অবসানের জন্য সংসদে আইন পাস করার ব্যবস্থা নেবে। স্বাধীন আদালতের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হবে বিচারের ভার।
স্বপ্ন-৫ : এ দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পাঠ আবশ্যিক করা হবে। যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন সেই আদিকাল থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতির উজ্জ্বল বিভায় বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল বাঙালি। এমন দেশের রাজনীতির অঙ্গন হবে অনেক বেশি পরিশীলিত। নানা দেশের জন্য অনুকরণীয়। প্রতিপক্ষ নেতা-নেত্রীরা স্থূল রাজনৈতিক ঝগড়া না করে বিতার্কিকের শিল্পমানে পরিশীলিত শব্দে চৌকস বাক্য বর্ষণ করবেন। এই নব চৈতন্যে অবগাহন করে বিএনপি নেত্রী যেমন 'এনারা' 'তেনারা' শব্দে এখন থেকে প্রতিদিন আর ভাঙা রেকর্ড বাজাবেন না, তেমনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর অবস্থানের প্রতি সুবিচার করে দু-কথা শুনিয়ে দেওয়ার মতো আত্মতৃপ্তি থেকে বেরিয়ে এসে এবং বিরোধী পক্ষের সবার বক্তব্যের জবাব বা প্রতিক্রিয়া নিজে প্রকাশ না করে নিজ দলের সমপর্যায়ের নেতাদের দিয়ে পরিমিতিবোধ বজায় রেখে বলাবেন। এতে নিজেদের সাংস্কৃতিক মান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি সাধারণ মানুষও রক্ষা পাবে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে। এমন বাস্তব উপলব্ধির পর দুই পক্ষের নেতা-নেত্রীরা এখন থেকে শব্দে বচনে শিল্পমান সমৃদ্ধ করার পরোক্ষ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বেন।
স্বপ্ন-৬ : একটু বিলম্বে হলেও এ দেশের ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের আ@ে@@@াপলব্ধি হয়েছে যে বিরোধী দলে গেলেই লাগাতার সংসদ বর্জন গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি অপপ্রয়োগ। এর যেমন কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই, তেমনি এর প্রতি নেই মুক্তচিন্তার সাধারণ মানুষের সমর্থন। দেরিতে হলেও তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এই ধারার সংসদ বর্জন একদিকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা, সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যে চরম অবহেলা করা, গণমানুষের কল্যাণে অর্পিত দায়িত্বপালন না করে মানুষের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার শামিল। এই অপকাণ্ডের জন্য একদিন জনতার আদালতে তাদের দাঁড়াতেই হবে। এ কারণেই উদ্যোগ নেওয়া হবে নতুন আইন পাস করার। ওয়াকআউট ধরনের সাময়িক প্রতিবাদ করা যেতে পারে; কিন্তু লাগাতার সংসদ বর্জন নিষিদ্ধ হবে।
স্বপ্ন-৭ : গণতন্ত্রের পক্ষে নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকরা এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তাঁরা এখন বিশ্বাস করতে পারছেন প্রশাসন ও নানা প্রতিষ্ঠানে আর দলীয়করণের প্রয়োজন নেই। সব সংস্থাকে মুক্ত করে দিতে পারলে একদিকে যেমন সংস্থাগুলো আপন দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হবে, তেমনি কমে যাবে দুর্নীতির কলঙ্ক। প্রশাসনের কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষের সেবক হবেন। পুলিশ হবে অসহায় মানুষের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। মেধাবী শিক্ষকরা হবেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এভাবে একটি চৌকস জাতি গঠন অনেক বেশি নিশ্চিত হয়ে যাবে।
স্বপ্ন-৮ : রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-নেত্রী, সমর্থক এবং সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা হঠাৎ কূপমণ্ডূকতা ও অন্ধত্বের মায়াজাল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁরা ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে দেশপ্রেমের অনাবিল শক্তি অনুভব করছেন। যাঁর যাঁর দলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই দলকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে আত্মসমালোচনার পথ বেছে নিয়েছেন তাঁরা। অসংখ্য কর্মী-সমর্থক নিশ্চিত হয়েছেন দলীয় নেতাদের অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক ও অনৈতিক কাজের সমালোচক তাঁদেরই হতে হবে। এতে প্রয়োজনীয় রাশ টানা যাবে। সংযত হবেন নেতা-নেত্রীরা। তখনই তাঁরা সুপথে হাঁটতে বাধ্য হবেন। এভাবেই রাজনীতি থেকে অপচ্ছায়ার অন্ধকার দূর হবে। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের এমন মুক্তচিন্তার উদ্বোধন একদিকে যেমন যার যার দলের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ দৃশ্যমান হবে তেমনিভাবে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো হবে সুদৃঢ়।
এ দেশের স্বাপি্নক মানুষের আরো অনেক অস্বস্তি রয়েছে। তাই তারা স্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টিতে আরো স্বপ্ন বুনতে চায়। পাশাপাশি তারা জানে স্বপ্নভঙের বেদনা অনেক বেশি বিষময়। তাই এই আটটি স্বপ্নেই আপাতত বিভোর থাকতে চায়। কারণ তারা নিশ্চিত এই কয়টি স্বপ্নপূরণ খুব কঠিন নয়। এর জন্য বিদেশি ঋণের প্রয়োজন নেই। জরুরি নয় বিদেশি রাষ্ট্রের সমর্থন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির অপ্রতুলতাও স্বপ্ন পূরণে বাধ্য হয়ে দাঁড়াবে না। শুধু প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দেশপ্রেম আর নির্লোভ মানসিকতা। জনসমর্থন রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের একমাত্র হাতিয়ার এই সত্যটির প্রতি বিশ্বাসী হতে পারলে সব পক্ষই একদণ্ডে স্বপ্নের অলিন্দ থেকে সব চাওয়া-পাওয়ার পূর্ণতা বাস্তবের উঠোনে নামিয়ে আনতে পারেন। আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে। তাই এ দেশের অবজ্ঞাত প্রতারিত মানুষ এখনো বিশ্বাস করে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের মুক্তি সম্ভব। আর গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত হবে এসব স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথ ধরে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
স্বপ্ন-১ : জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন আর মুখে মুখে শুধু হুঙ্কার নয়, বাস্তবায়ন করা হবে। তাই প্রথমে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ওপর কঠিন সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করেছে। চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি আর সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-যুবলীগ নেতাদের দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এসব চাঁদার ভাগ কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যাঁরা যাঁরা গ্রহণ করতেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে তাঁদেরও। যেসব দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের তত্ত্বাবধানে দখলবাণিজ্য ও মাস্তানি চলছে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করাসহ নানা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ঘোষণা করা হয়েছে, অভিযুক্ত সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরবর্তী সময়ে আর দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের এই কঠোর নীতিকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধুবাদ জানাচ্ছে। এই বাস্তবতা দেখে বিমর্ষ বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতা-নেত্রীরা জরুরি বৈঠকে বসেছেন। দলের অস্তিত্ব রক্ষায় ইতিবাচক প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে তাঁদেরও। আওয়ামী লীগের আদলে তাঁরাও নিজ দলে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা এবং নতুন নীতি নির্ধারণে ঐকমত্যে পেঁৗছেছেন।
স্বপ্ন-২ : আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলই কোনো অন্ধকার পথে নয়, প্রকৃত জনসমর্থন আদায়ের মধ্য দিয়ে জননন্দিত দলে পরিণত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এসব দলের নেতা-নেত্রীরা অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন, দল পরিচালনা ও নির্বাচনে বেশুমার টাকার ব্যবহার করতে গিয়ে উভয় দলের নেতা-নেত্রীদের আপস করতে হয়েছে দুর্নীতির সঙ্গে। দলীয় ফাণ্ড বৃদ্ধি করতে তাদের নির্ভর করতে হয়েছে অসৎ ব্যবসায়ী আর ঘুষখোর আমলাদের ওপর। এ কারণে এসব ব্যবসায়ী ও আমলাদের অনেক অনৈতিক আবদার দলগুলোকে মেটাতে হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রকৃত রাজনীতিকদের কোণঠাসা করে এসব ভুঁইফোঁড় ব্যবসায়ী আর আমলাদের অনেককে সংসদ সদস্য বানিয়ে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রী বানিয়ে পার্টি ফাণ্ডে দেয় চাঁদার শতগুণ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এত দিনে আ@ে@@@াপলব্ধি হয়েছে দলগুলোর। নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে এই অসুস্থতা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে না। তাই দুই বড় দলই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতেই রাজনীতি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অর্থ শক্তিতে নয়, জনকল্যাণের শক্তিতেই মানুষের মনোরঞ্জন করবে দলগুলো। অতএব পার্টি-ফাণ্ড অনৈতিকভাবে প্রকাণ্ড করার প্রয়োজন নেই।
স্বপ্ন-৩ : আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় অপচয় রোধে গেজেট প্রকাশ করেছে। ঘোষণা হয়েছে সরকারি বা বিরোধী দল, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাষিত বা সামরিক অঞ্চল কোথাও ঘটা করে অমুক-তমুকের সম্মানে বিপুল আয়োজন ও খরচে ইফতার পার্টি এখন থেকে নিষিদ্ধ। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা গত রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজক সব সরকারি, বেসরকারি ও রাজনৈতিক দলের খরচের বাজেট সংগ্রহ করবে এবং পরবর্তী রমজানে কমপক্ষে সেই পরিমাণ অর্থ ইফতার আয়োজনের বদলে রাষ্ট্রীয় ফান্ডে জমা করবে। প্রতিবছর সেই টাকায় এক এক অঞ্চলের হতদরিদ্র জনগণের মধ্যে ঈদের পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হবে। সরকার বিশ্বাস করে, ইফতারের নামে এই অপচয়ের বদলে জনকল্যাণমুখী এ ধারার পদক্ষেপে সবারই সমর্থন থাকবে। সামাজিক এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যও তাতে পূরণ হবে। পরবর্তী সরকারগুলোর সময়ও তা অব্যাহত রাখা রেওয়াজে পরিণত হবে। একই সঙ্গে গেজেটের অন্য ধারায় বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আগমন উপলক্ষে অপ্রয়োজনীয় তোরণ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হবে। কারণ সরকার লক্ষ করেছে, এসব তোরণ নির্মাণের আড়ালে চাঁদাবাজি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যায় এবং দরিদ্র দেশের অর্থের অহেতুক অপচয় করা হয়।
স্বপ্ন-৪ : সব সরকারই আইন-আদালতের ওপর অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আসছে। এতে করে ক্রমে বিচারব্যবস্থার ওপর থেকে উঠে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের আস্থা। এই অবস্থা একটি অরাজক পরিবেশের সৃষ্টি করছে। দেশের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতার তিন বছরের মাথায় এসে মহাজোট সরকারের বোধোদয় হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছেন আদালতকে পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলার কলঙ্ক থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। এই সরকারের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আদালতকে দলীয়করণ মুক্ত রাখা হবে। যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সরকারি দল রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের মতো সুবিধাবাদী বন্য অবস্থার স্থায়ী অবসানের জন্য সংসদে আইন পাস করার ব্যবস্থা নেবে। স্বাধীন আদালতের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হবে বিচারের ভার।
স্বপ্ন-৫ : এ দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পাঠ আবশ্যিক করা হবে। যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন সেই আদিকাল থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতির উজ্জ্বল বিভায় বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল বাঙালি। এমন দেশের রাজনীতির অঙ্গন হবে অনেক বেশি পরিশীলিত। নানা দেশের জন্য অনুকরণীয়। প্রতিপক্ষ নেতা-নেত্রীরা স্থূল রাজনৈতিক ঝগড়া না করে বিতার্কিকের শিল্পমানে পরিশীলিত শব্দে চৌকস বাক্য বর্ষণ করবেন। এই নব চৈতন্যে অবগাহন করে বিএনপি নেত্রী যেমন 'এনারা' 'তেনারা' শব্দে এখন থেকে প্রতিদিন আর ভাঙা রেকর্ড বাজাবেন না, তেমনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর অবস্থানের প্রতি সুবিচার করে দু-কথা শুনিয়ে দেওয়ার মতো আত্মতৃপ্তি থেকে বেরিয়ে এসে এবং বিরোধী পক্ষের সবার বক্তব্যের জবাব বা প্রতিক্রিয়া নিজে প্রকাশ না করে নিজ দলের সমপর্যায়ের নেতাদের দিয়ে পরিমিতিবোধ বজায় রেখে বলাবেন। এতে নিজেদের সাংস্কৃতিক মান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি সাধারণ মানুষও রক্ষা পাবে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে। এমন বাস্তব উপলব্ধির পর দুই পক্ষের নেতা-নেত্রীরা এখন থেকে শব্দে বচনে শিল্পমান সমৃদ্ধ করার পরোক্ষ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বেন।
স্বপ্ন-৬ : একটু বিলম্বে হলেও এ দেশের ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের আ@ে@@@াপলব্ধি হয়েছে যে বিরোধী দলে গেলেই লাগাতার সংসদ বর্জন গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি অপপ্রয়োগ। এর যেমন কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই, তেমনি এর প্রতি নেই মুক্তচিন্তার সাধারণ মানুষের সমর্থন। দেরিতে হলেও তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এই ধারার সংসদ বর্জন একদিকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা, সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যে চরম অবহেলা করা, গণমানুষের কল্যাণে অর্পিত দায়িত্বপালন না করে মানুষের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার শামিল। এই অপকাণ্ডের জন্য একদিন জনতার আদালতে তাদের দাঁড়াতেই হবে। এ কারণেই উদ্যোগ নেওয়া হবে নতুন আইন পাস করার। ওয়াকআউট ধরনের সাময়িক প্রতিবাদ করা যেতে পারে; কিন্তু লাগাতার সংসদ বর্জন নিষিদ্ধ হবে।
স্বপ্ন-৭ : গণতন্ত্রের পক্ষে নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকরা এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তাঁরা এখন বিশ্বাস করতে পারছেন প্রশাসন ও নানা প্রতিষ্ঠানে আর দলীয়করণের প্রয়োজন নেই। সব সংস্থাকে মুক্ত করে দিতে পারলে একদিকে যেমন সংস্থাগুলো আপন দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হবে, তেমনি কমে যাবে দুর্নীতির কলঙ্ক। প্রশাসনের কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষের সেবক হবেন। পুলিশ হবে অসহায় মানুষের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। মেধাবী শিক্ষকরা হবেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এভাবে একটি চৌকস জাতি গঠন অনেক বেশি নিশ্চিত হয়ে যাবে।
স্বপ্ন-৮ : রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-নেত্রী, সমর্থক এবং সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা হঠাৎ কূপমণ্ডূকতা ও অন্ধত্বের মায়াজাল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁরা ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে দেশপ্রেমের অনাবিল শক্তি অনুভব করছেন। যাঁর যাঁর দলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই দলকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে আত্মসমালোচনার পথ বেছে নিয়েছেন তাঁরা। অসংখ্য কর্মী-সমর্থক নিশ্চিত হয়েছেন দলীয় নেতাদের অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক ও অনৈতিক কাজের সমালোচক তাঁদেরই হতে হবে। এতে প্রয়োজনীয় রাশ টানা যাবে। সংযত হবেন নেতা-নেত্রীরা। তখনই তাঁরা সুপথে হাঁটতে বাধ্য হবেন। এভাবেই রাজনীতি থেকে অপচ্ছায়ার অন্ধকার দূর হবে। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের এমন মুক্তচিন্তার উদ্বোধন একদিকে যেমন যার যার দলের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ দৃশ্যমান হবে তেমনিভাবে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো হবে সুদৃঢ়।
এ দেশের স্বাপি্নক মানুষের আরো অনেক অস্বস্তি রয়েছে। তাই তারা স্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টিতে আরো স্বপ্ন বুনতে চায়। পাশাপাশি তারা জানে স্বপ্নভঙের বেদনা অনেক বেশি বিষময়। তাই এই আটটি স্বপ্নেই আপাতত বিভোর থাকতে চায়। কারণ তারা নিশ্চিত এই কয়টি স্বপ্নপূরণ খুব কঠিন নয়। এর জন্য বিদেশি ঋণের প্রয়োজন নেই। জরুরি নয় বিদেশি রাষ্ট্রের সমর্থন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির অপ্রতুলতাও স্বপ্ন পূরণে বাধ্য হয়ে দাঁড়াবে না। শুধু প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দেশপ্রেম আর নির্লোভ মানসিকতা। জনসমর্থন রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের একমাত্র হাতিয়ার এই সত্যটির প্রতি বিশ্বাসী হতে পারলে সব পক্ষই একদণ্ডে স্বপ্নের অলিন্দ থেকে সব চাওয়া-পাওয়ার পূর্ণতা বাস্তবের উঠোনে নামিয়ে আনতে পারেন। আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে। তাই এ দেশের অবজ্ঞাত প্রতারিত মানুষ এখনো বিশ্বাস করে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের মুক্তি সম্ভব। আর গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত হবে এসব স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথ ধরে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments